ঢাকা     সোমবার   ২২ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  পৌষ ৭ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

চলনবিলে মাছের সংকট, শুঁটকি উৎপাদনে ভাটা 

অদিত্য রাসেল, সিরাজগঞ্জ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৮:৫২, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৩   আপডেট: ১৯:০১, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৩
চলনবিলে মাছের সংকট, শুঁটকি উৎপাদনে ভাটা 

দেশের বৃহত্তর জলাভূমি চলনবিলে আগের মতো নেই থই-থই পানি। কমে যাওয়ায় দেশি মাছের সংকটে হারিয়ে যাচ্ছে মিঠা পানির শুটকি। এই মৎস্য ভাণ্ডার ঘিরে যুগের পর যুগ ধরে চলে আসা শুঁটকি পল্লীতে দেখা দিয়েছে স্থবিরতা। ফলে শুঁটকি তৈরির সাজ-সরঞ্জাম বেশির ভাগ ফাঁকা পড়ে রয়েছে। এতে বেকার হওয়ার আশঙ্কায় রয়েছে ৫ চাতালের শতাধিক নারী ও পুরুষ শ্রমিক।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চলনবিল অঞ্চলে প্রায় ১২০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের ২২টি জলাশয় ও ১৬টি নদীর সমন্বয়ে এ বিলের প্রায় সাড়ে ৪ হাজার হেক্টর জলাভূমিতে মাছ আহরণ করা হয়। এই মৎস্য ভাণ্ডার খ্যাত সিরাজগঞ্জ, পাবনা ও নাটোরের তিন জেলাজুড়ে বিস্তৃত। এটি দেশের মিঠাপানির মাছের বড় উৎস। এই বিশাল জলাভূমির একদিকে বড় শস্য ভাণ্ডার, তেমনই মাছেরও বড় যোগান আসে এখান থেকে। আর এখানকার হরেক প্রজাতির মাছ ঘিরে চলে এলাকার ভিন্ন এক কর্মব্যস্ততা। বছরের নির্দিষ্ট সময়ে কর্মতৎপর হয়ে ওঠে এখানকার শুঁটকি পল্লীর চাতালগুলো। এই জনপদের তিন জেলার ৯টি উপজেলার নারী-পুরুষেরা ভোরের আলো ফোটায় সঙ্গে সঙ্গে চলনবিলের শুঁটকি তৈরিতে নেমে পড়ে। এখানে দেশীয় পদ্ধতিতে শুঁটকি তৈরি করা হয়। সৈয়দপুর, নীলফামারী, রাজধানীসহ ১০-১২টি দেশের বিভিন্ন স্থানে পৌঁছে যায় এ সব শুঁটকি মাছ। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, কাতার, ওমান, দুবাই, ইরাক, কুয়েত, লিবিয়া, ইন্দোনেশিয়াসহ ২৫টি দেশে শুঁটকি রপ্তানি হয়।

আরো পড়ুন:

বুধবার (২০ সেপ্টেম্বর) সরজমিন দেখা যায়, উত্তরবঙ্গের প্রবেশদ্বার হাটিকুমরুল-বনপাড়া হাইওয়ে রাস্তার দুই পাশে বিশাল এলাকাজুড়ে বিভিন্ন স্থানে শুঁটকি তৈরির চাতাল। আশপাশের গ্রামের নারী-পুরুষেরা এখানে কাজ করেন। চলনবিলের অধিকাংশ মাছ চলে আসে জেলা-উপজেলা সদরের আড়ত ও বাজারে। সেখান থেকে পাইকাররা শুঁটকির জন্য কিনে আনেন শত শত মণ মিঠা পানির মাছ।

শুটকির চাতাল সূত্রে জানা যায়, তাড়াশের মহিষলুটি মাছের আড়ত, চাটমোহর উপজেলার বোয়ালমারি, সিংড়া বাজারসহ বিভিন্ন আড়ত থেকে মাছ ক্রয় করা হয়। এরপর তা পৌঁছে যায় শুঁটকির চাতালে। ভোরের আলো ফোটা থেকে শুরু হয় নারী-পুরুষদের কর্মযজ্ঞ। মাছে লবণ মাখানো, মাপজোখ করা, বহন করে মাচায় নেওয়া, শুঁটকি উল্টে-পাল্টে নাড়া, শুঁটকি বাছাই করাসহ আরও কত কাজ। এ সব চাতালে শোল, বোয়াল, খলসা, টাকি, টেংরা, পুটি, কৈ, শিং, মাগুর, রূপচাঁদা, ডানকোনা, রয়না, বেলে, সরপুটি, ছোট চিংড়ি, বাইম, চাপিলা, চেলাপুটি ও চাঁদা মাছসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ শুকিয়ে শুঁটকি করা হয়।

তাড়াশ উপজেলার ঘরগ্রামের শুঁটকি চাতাল মালিক আবু বক্কার বলেন, সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত চলবে মাছ সংগ্রহ। বর্ষার পানিতে চলনবিল অঞ্চলে যেসব মাছ বেড়ে ওঠে, সেসব মাছই ধরা হয় এ সময় পর্যন্ত। বর্তমানে চাতালে এ মৌসুমে প্রতিদিন শুঁটকি মাছের পরিমাণ দাঁড়ায় ৫০ থেকে ৬০ মণ।

চাটমোহরের হান্ডিয়ালের চাতাল মালিক আমিনুল ইসলাম বলেন, গত বছরের তুলনায় এ বছর মাছের উৎপাদন একেবারেই কম। বিল থেকে ধরা মাছের দামও তুলনামূলক বেশি। তবে হিমশিম খাচ্ছেন শুঁটকির দাম নিয়ে। শুটঁকির মোকামে সিন্ডিকেটের কারণে গত বছরের চেয়ে এ বছর মহাজনেরা কম দামে শুঁটকি কিনছেন। ফলে লোকসানের মুখে পড়তে হচ্ছে এই ব্যবসায়।

তিনি বলেন, চলনবিলে ২২টি জলাশয় ও ১৬টি নদীর জলাভূমিতে মাছ আহরণ করে শুঁটকি তৈরি হচ্ছে। গত বছর এই বিলের বিভিন্ন পল্লী থেকে প্রায় ৮০০ টন শুঁটকি উৎপাদন করা সম্ভব হয়েছে।

সিরাজগঞ্জ, পাবনা ও নাটোরের কয়েকজন শুঁটকি চাতাল মালিকরা জানান, এ বছর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ১ হাজার টন। কিন্তু চলনবিলে মাছের সংকট দেখা দিয়েছে। এতে গত বছরের তুলনায় এবার উৎপাদন কম হবে।

গুরুদাসপুর এলাকার শুঁটকি চাতাল মালিক আলম হোসেন বলেন, ব্যক্তি মালিকানার জায়গা লিজ নিয়ে চালানো চলনবিল অঞ্চলের বিভিন্ন শুঁটকি পল্লীতে বর্তমানে কাজ করছেন কয়েক শত নারী। মাছের আকারভেদে শুঁটকির দাম হয় ভিন্ন ভিন্ন। ছোট আকারের মাছের শুঁটকি প্রতিমণ ১৫ থেকে ২০ হাজার এবং বড় আকৃতির মাছের শুঁটকি বিক্রি হচ্ছে ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা। 

চাতাল শ্রমিক ছকিনা বেগম, আল্পনা খাতুন ও রোমেছা বেগম বলেন, ‘মহাজনেরা শ্রমিকদের খেতে দেন। সেজন্য কম মজুরিতে কাজ করেও খুশি আমরা। প্রতিদিন একজন নারী শ্রমিকের মজুরি ১৫০ টাকা আর পুরুষের ৩০০ টাকা। তবে এই মৌসুমে শুঁটকি তৈরির জন্য মাছ সংকট দেখা দিয়েছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে আগামীতে শুঁটকি চাতাল বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।’ 

উল্লাপাড়ার চাতাল মালিক আলতাব ও দেলবার হোসেন জানান, প্রভাবশালী ব্যক্তিরা বাদাই জাল দিয়ে পোনা মাছ ধরায় চলনবিলে মৎস্য সংকট দেখা দিয়েছে। তাছাড়া খরা মৌসুমে অনেকে পানি সেচ দিয়ে মাছ ধরে, যার কারণে বিলে মাছ কমে গেছে। বেশি দামে কেনা মাছ দিয়ে শুঁটকি করায় খরচও বেশি হচ্ছে। চলতি বছরে সৈয়দপুর এলাকার শুঁটকি মহাজনদের ব্যবসার সিন্ডিকেটে পড়ে এ ব্যবসায় লোকসান হয়েছে। এখন পর্যন্ত তাদের দেড় লাখ, কারও ৫০ হাজার, ৬০ হাজার টাকা লোকসান হয়েছে। 

মহিষলুটি মৎস্য আড়ৎদার গোলাম কিবরিয়া জানান, মাছ সংকটের কারণে এলাকার অনেক চাতাল বন্ধ হয়ে গেছে। অন্যগুলো বন্ধ হওয়ার পথে। বেকার হওয়ার আশঙ্কায় ভুগছে চলনবিলের প্রায় ৩ শতাধিক শুঁটকি চাতালের প্রায় ৫ শতাধিক নারী ও পুরুষ শ্রমিক।

তাড়াশ উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মশগুল আজাদ বলেন, চলনবিলের মাছের শুঁটকির গুণগত মান, সুনাম ও চাহিদা দেশ-বিদেশে। তবে বর্ষা মৌসুমে মা মাছ নিধন, কীটনাশক প্রয়োগে মাছ ধরা, প্রাকৃতিক মাছের প্রজননক্ষেত্র সংরক্ষণ করতে না পারলে চলনবিলে মাছ সংকট দেখা দেবে। এ বছর চলনবিলে কয়েক দফায় পানি আসা ও দ্রুত শুকিয়ে যাওয়ার কারণে মাছের সংকট দেখা দিয়েছে। গত বছর এ উপজেলা থেকে ১৪৩ মেট্রিকটন শুঁটকি উৎপাদন করা সম্ভব হয়েছে। গত বছরের তুলনায় এ বছর ৩০ থেকে ৪০ মেট্টিক টন শুঁটকি উৎপাদন কম হবে। এখন পর্যন্ত সঠিক হিসাব করা সম্ভব না হলেও ধারণা করা যাচ্ছে ১০০ থেকে ১১০ মেট্টিক টন শুঁটকি উৎপাদন হবে।
 

/বকুল/

সম্পর্কিত বিষয়:

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়