ঢাকা     সোমবার   ২২ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  পৌষ ৭ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

আক্তার নেসা যেভাবে হয়ে উঠেছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের ‘মা’

রফিক সরকার, কালীগঞ্জ (গাজীপুর) || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৯:২০, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩   আপডেট: ১৯:৩৫, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩
আক্তার নেসা যেভাবে হয়ে উঠেছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের ‘মা’

নিজ বাড়িতে রেখে তিন বেলা মুক্তিযোদ্ধাদের রান্না করে খাবার খাওয়াতেন আক্তার নেসা

মুক্তিযুদ্ধকালীন গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলা প্রহ্লাদপুর ইউনিয়নের দমদমা গ্রামে ২৫ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা আক্তার নেসার বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। এই বাড়িটি তখন মুক্তিযোদ্ধাদের ছোট একটি ক্যাম্পে পরিণত হয়। আক্তার নেসা সে সময় বীর মুক্তিযোদ্ধাদের তিন বেলা রান্না করে খাওয়াতেন। তাদের অস্ত্র সব সময় পরিষ্কার করে দিতেন। সেই থেকে তিনি হয়ে উঠেছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ‘মা’। আক্তার নেসার স্বামী মরহুম ইসমাইল হোসেন বাগমারও ছিলেন মহান মুক্তিযুদ্ধের একজন সংগঠক। 

এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন ওই বাড়িতে আশ্রয় নেওয়া বীর মুক্তিযোদ্ধা জেড আই জালাল।

আরো পড়ুন:

জেড আই জালাল বলেন, নিজ সন্তানের মতো পরম দরদ দিয়ে রান্না করে আমাদের খাবার খাইয়েছেন ইসমাইল বাগমারের স্ত্রী আক্তার নেসা।

আরও পড়ুন: গাজীপুরের সংসদ সদস্য ইকবাল হোসেনের মা আর নেই

তিনি আরও বলেন, ট্রেনিং শেষে অস্ত্র হাতে আখাউড়া হয়ে চলে আসি নরসিংদীর বেলাব উপজেলায়। তখন গভীর রাত। মাঝেমধ্যে দু-একটি গুলির শব্দ ছাড়া কোনো শব্দই শোনা যায় না। পাকিস্তানি সেনারা কিছুক্ষণ পরপর ফাঁকা গুলি চালাতো। আমরাও থেমে নেই। সম্মুখ যুদ্ধ চলছে। এভাবে শেষ রাত পর্যন্ত চলে। পরে খবর পেয়েছিলাম, আমাদের গুলিতে ছয়-সাতজন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়েছিলেন। ভোর বেলায় সেখান থেকে সোজা চলে আসি প্রহদ্মাদপুরের দমদমা গ্রামে। এখানকার ইসমাইল হোসেন বাগমারের বাড়িটি ছিল বাঙালি যোদ্ধাদের অস্থায়ী ক্যাম্প। আমরা ওই ক্যাম্পে এসে উঠলাম। দিনের বেলায় যুদ্ধ করি আর রাতে গিয়ে ওই বাড়িতে থাকি। এভাবে চলতে থাকল। দেশ শত্রুমুক্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত আমরা ওই বাড়িতেই অবস্থান করি।

শ্রীপুরের স্থানীয় বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চারদিকে থইথই করছে বর্ষার জল। পার্শ্ববর্তী পারুলী নদীতে পাকিস্তানি বাহিনীর হিংস্র মহড়া। একদিন রাতে ইসমাইল বাগমারের বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধা আলাউদ্দিন, ইউসুফ আলী ও আবদুল মোতালেব এসে হাজির হন। এ খবর পৌঁছে যায় পাকিস্তানি বাহিনীর কাছে। বাড়িটি ঘিরে ফেলে শত্রুপক্ষ। আক্তার নেসা সেদিন মুক্তিযোদ্ধাদের নিজ আত্মীয় বলে পরিচয় দিলে পাকিস্তানিরা চলে যায়। এরপর ওই বাড়িতে থেকেই যুদ্ধ চালাতে থাকেন ওই তিন বীর যোদ্ধা। এরই মধ্যে পূবাইল থেকে পারুলী নদী পথে আরও ২০-২২ মুক্তিযোদ্ধাকে বাড়িতে নিয়ে আসেন ইসমাইল বাগমার। মুক্তিযোদ্ধাদের অস্থায়ী এক ক্যাম্পে পরিণত হয় তার বাড়ি। প্রতিদিন তিন বেলা এই ২৫ জন মুক্তিযোদ্ধাকে রান্না করে খাবার দিয়েছেন আক্তার নেসা।

তারা আরও জানান, বাড়িতে ধান-চালের অভাব ছিল না। আক্তার নেসার পুকুরে মাছ ছিল, শাক সবজিরও আবাদ করতেন বাড়িতেই। হাঁস-মুরগি পালন করতেন। প্রতিদিন সকাল-দুপুর ও রাতে সব মুক্তিযোদ্ধাকে তিনি রান্না করে খাবার দিয়েছেন। আক্তার নেসার পরম যত্নে তার বাড়িতেই দিন-রাত কাটিয়েছেন লড়াকু তরুণরা। বাড়িতে তখন তিনটি মাটির ঘর ছিল। একটিতে স্বামী, ছেলেমেয়ে ও শাশুড়িকে নিয়ে থাকতেন তিনি। আর বাকি দুটি ঘর ব্যবহার করতেন মুক্তিযোদ্ধারা।

বীর মুক্তিযোদ্ধারা বলেন, ২৫ জন মানুষের জন্য তিনবেলা রান্না করা খুব সহজ ব্যাপার ছিল না। তারঁ কোলে তখন তিন মাসের ছেলে ইকবাল হোসেন সবুজ (বর্তমানে গাজীপুর-৩ আসনের সংসদ সদস্য)। দেশ স্বাধীন করার জন্য যে বীররা লড়ছে, তাদের জন্য রান্না করে খাবার দেওয়ার মধ্যে পরম একটা তৃপ্তি ছিল তাঁর। রাতভর যুদ্ধ করতেন আর দিনের বেলায় এসে ওই বাড়িতে বিশ্রাম নিতেন বীর মুক্তিযোদ্ধারা। টানা তিন মাস আক্তার নেসা এসব বীরযোদ্ধাকে সেবা দিয়েছেন। তখন কেউ তাকে ডাকতেন খালা, কেউ ডাকতেন ভাবি, কেউ কেউ ডাকতেন আবার আম্মাজান বলে। এভাবেই আক্তার নেসা হয়ে ওঠেন বীর মুক্তযোদ্ধারে ‘মা’।

গতকাল রোববার ভোরে মুক্তিযোদ্ধাদের ‘মা’ খ্যাত আক্তার নেসা ইন্তেকাল করেছেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তিনি গাজীপুর শহরের উত্তর ছায়াবিথী এলাকায় নিজ বাসায় ইন্তেকাল করেন। তিনি চার ছেলে ও এক মেয়েসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। পরে ওইদিন বাদ জোহর জয়দেবপুর রাজবাড়ী মাঠে তার প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। পরে বাদ আসর শ্রীপুর উপজেলার দমদমা গ্রামে দ্বিতীয় জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।

বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মাতা খ্যাত আক্তার নেসা মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তিনি এক বিবৃতিতে তিনি আক্তার নেসার আত্মার মাগফিরাত কামনা এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।

এছাড়া মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, বাংলাদেশ মহিলা আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি মেহের আফরোজ চুমকি এমপি, গাজীপুর জেলা, সদর উপজেলা ও শ্রীপুর উপজেলা আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন গভীর শোক ও শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানিয়েছেন।

মাসুদ

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়