নিখোঁজ জিয়ার কঙ্কাল নিয়ে জনমনে প্রশ্ন
পাবনা প্রতিনিধি || রাইজিংবিডি.কম
জিয়াউর রহমান জিয়া
পাবনার বেড়ায় জুয়ার আসরে পুলিশ আসার খবর শুনে দৌঁড়ে পালিয়ে যাওয়ার পর থেকে নিখোঁজ জিয়াউর রহমান জিয়ার (৪৭) কঙ্কাল উদ্ধার করা হয়েছে। উপজেলার নতুন ভারেঙ্গা ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের চর এলাকা আগবাগশোয়া গ্রামের একটি নালা থেকে কঙ্কালটি উদ্ধার করেছে পুলিশ। নিহতের পরিবারের দাবি, জিয়াকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে।
মারা যাওয়া জিয়া উপজেলার আমিনপুর থানাধীন ঢালারচর কাজীপাড়া গ্রামের আজিজুল কাজীর ছেলে। গত বুধবার তার কঙ্কাল উদ্ধার হয়।
গত বৃহস্পতিবার সকালে মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য পাবনা মর্গে প্রেরণ করে থানা পুলিশ। ময়নাতদন্ত শেষে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করলে লাশ দাফন করেন স্বজনরা।
নিহতের পরিবার সূত্রে জানা যায়, জিয়া নিখোঁজ হন গত ২১ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার। এ ঘটনায় প্রথমে বেড়া মডেল থানায় সাধারণ ডায়েরি করতে গেলে পুলিশ আপত্তি জানায়। পরে তার ভাই আজাদ কাজী ২৩ সেপ্টেম্বর আমিনপুর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন। জিডি নম্বর- ১৮০৯।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বেড়া থানাধীন নতুন ভারেঙ্গা ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের চরসাফুল্লাহপুর গ্রামের জয়বাংলা বাজারে দীর্ঘদিন ধরে জুয়ার আসর বসত। প্রভাবশালী আমজাদ মোল্লা এই জুয়ার আসর পরিচালনা করতেন। উপজেলার নগরবাড়ি, রাকসা, বেড়া, ঢালারচর, আমিনপুর, সুজানগরসহ দূর দূরান্তের জুয়ারিরা জুয়া খেলতে সেখানে আসতেন। প্রতিদিন লাখ লাখ টাকার জুয়া খেলা চলতো সেখানে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় একাধিক ব্যক্তি জানান, ২১ সেপ্টেম্বর দুপুরে বেড়া মডেল থানার এএসআই আনোয়ার হোসেন পুলিশের ফোর্সসহ জুয়ার অসরে উপস্থিত হয়ে চারজনকে আটক করে। এসময় পুলিশ ধাওয়া করলে চার থেকে পাঁচজন পালিয়ে যান।
পুলিশের দাবি, আটককৃতদের থানায় এনে পরবর্তিতে জুয়া না খেলার মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, পুলিশ তিন-চারজনকে ধাওয়া করলে মকবুল নামের এক জুয়ারি পালানোর সময় আগবাগশোয়া গ্রামের একটি নালায় ঝাঁপ দেন। এসময় তার কাছে থাকা টাকা পানিতে পড়ে যায়। পালানোর সময় ওই ব্যক্তি এলাকার লোকজনকে বলে যান, নালায় আমার ২৯ হাজার টাকার হারিয়েছে তোমরা খুঁজে নিও, এতে আমার কোনো চাওয়া পাওয়া নেই। তোমরা নিয়ে নিও। পরদিন থেকে ওই নালায় দুইদিন ধরে চলে টাকার খোঁজ। প্রায় ২২ হাজার টাকা পায় লোকজন।
এদিকে, তখন থেকেই নিখোঁজ হন জিয়া। পরদিন জিয়াকে খুঁজতে তার গ্রাম থেকে শত শত মানুষ আসেন চর এলাকায়। দুইদিন চরের বিভিন্ন এলাকায় খুঁজেও জিয়ার কোনো সন্ধান পাননি তারা। এ ঘটনার সাতদিন পর চর এলাকার আগবাগশোয়া গ্রামের সেই নালা থেকে একজন মানুষের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। তবে মরদেহের পাশে পরে থাকা লুঙ্গি ও পড়নের গেঞ্জি দেখে তা জিয়ার বলে শনাক্ত করেন তার ছেলে আব্দুর রহিম ও তার চাচা আজম কাজী।
জিয়ার ছেলে আব্দুর রহিম বলেন, ‘যে নালায় লাশটি পাওয়া গেল সেখানে দুইদিন লোকজন টাকা খুঁজলো। তখন কারো চোখে পড়লো না। আর এখন এখানে বাবার লাশ আসলো কিভাবে। তাও আবার প্রায় কঙ্কাল। আর লাশের পাশে বস্তা দেখে বুঝাই যায়, বাবাকে অন্য জায়গায় হত্যা করে লাশ এখানে ফেলে গেছে দুর্বৃত্তরা।’
নিহতের চাচা আজম কাজী জানান, ‘পুলিশের ধাওয়াতেই জিয়া নিখোঁজ হয়েছিল। আমার ভাতিজাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। জিয়া নিখোঁজ হওয়ার পরের দিন আমাদের এলাকার প্রায় ২০০ লোক তাকে খুঁজেজে। কিন্তু কোথাও তার সন্ধান মেলেনি। যেখানে লাশ পাওয়া গেল সেখানেও আমরা খুঁজেছিলাম। জিয়ার ভেকু গাড়ি বিক্রি করার ৮ থেকে ১০ লাখ টাকা নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়েছিল।’
নিহত জিয়ার স্ত্রী রহিমা খাতুন বলেন, ‘আমার স্বামী বাড়িতে থাকা টাকাসহ ভেকু বেচার টাকা নিয়ে বের হন। আমার স্বামীও নাই, টাকা পয়সাও নাই। তাকে হারিয়ে পাগল হয়ে গেছি। আমার সোনার সংসারে তিন ছেলে এক মেয়ে রয়েছে। তাদের কিভাবে লালন-পালন করবো, কিভাবে সংসার চালাবো বুঝতে পারছি না। আমি আমার স্বামীর হত্যাকারীদের বিচার চাই।’
এ বিষয়ে নতুন ভারেঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবু দাউদ বলেন, ‘আমি ওই দিন শুনলাম চরসাফুল্লা জুয়ারিদের পুলিশ ধাওয়া করেছে। চারজনকে আটক করে থানায় নিয়ে গেছে পুলিশ। পরে জানলাম আটক করা চারজনকে মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। তার দুইদিন পর শুনি পুলিশের ধাওয়ায় একজন নাকি নিখোঁজও হয়েছে। ঢালারচর থেকে অনেক লোকজন এসে তাকে দুইদিন ধরে খুঁজেছে। সাতদিন পর শুনি আগবাগশোয়া গ্রামের একটি নালার পাশে মানুষের মরদেহ পাওয়া গেছে। পুলিশ লাশ উদ্ধার করার সময় আমি সেখানে উপস্থিত ছিলাম। পুরো ঘটনাটাই আমার কাছে রহস্যজনক বলে মনে হয়েছে।’
এ বিষয়ে জানতে আমজাদ মোল্লার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও সম্ভব হয়নি। তার ফোন নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়।
বেড়া মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ হাদিউল ইসলাম বলেন, ‘ওইদিন পুলিশ কাউকে ধাওয়া করেনি। তবে জুয়ার আসর বসার খবর পেয়ে পুলিশ অভিযান চালায়। দূর থেকে পুলিশের নৌকা দেখে জুয়ারিরা দৌঁড়ে পালিয়ে যায়। নিখোঁজ জিয়াউরের লাশ ৬ দিনের ব্যবধানে কঙ্কালে রূপ নেওয়া অস্বাভাবিক। ময়নাতদন্ত শেষে বোঝা যাবে ঘটনার রহস্য কি।’
শাহীন/ মাসুদ