রংপুরে আলুর দামে রেকর্ড
আমিরুল ইসলাম, রংপুর || রাইজিংবিডি.কম
আলু উৎপাদনে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম জেলা রংপুর। প্রতি বছর এখানকার উৎপাদিত আলু জেলার চাহিদা মিটিয়ে দেশের বিভিন্নস্থানে পাঠানো হয়। সেই আলুই এখন রংপুর জেলায় খুচরা বাজারে রেকর্ড ভেঙেছে দামে। প্রতি কেজি আলু বিক্রি হচ্ছে এখন ৬০ থেকে ৮০ টাকা কেজি দরে। এর ফলে অস্বস্তি বিরাজ করছে বাজারে।
শুক্রবার (৩ নভেম্বর) সকালে রংপুর নগরীর সিটি বাজার, স্টেশন বাজার, মর্ডান মোড় বাজার ঘুরে দেখা গেছে, বাজারগুলোতে আলু বিক্রি হচ্ছে সর্বনিম্ন ৬০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৮০ টাকা কেজি দরে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি বাজারে আলুর এই আকাশচুম্বী দাম ক্রেতাদের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে।
সিটি বাজারে কথা হয় আশিকুর রহমান নামের এক ক্রেতার সঙ্গে। তিনি বলেন, 'আমাদের এই জেলায় সবচেয়ে বেশি আলু উৎপাদন হয়। তারপরও আলুর দাম কেন কমছে না সেটি আমাদের বুঝে আসছে না। যে দামে ৫ কেজি আলু পাওয়ার কথা সেই টাকায় এখন এক কেজি আলুও মিলছে না বাজারে। সরকার ঘোষণা দিচ্ছে দাম নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে, কিন্তু সেটি এখন ঘোষণার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে। বাজার পর্যায়ে তা আর কার্যকর হচ্ছে না। ৮০ টায় এক কেজি শীল আলু কিনে ক্ষুব্ধ হওয়া ছাড়া কিছুই করার নেই।'
সিটি বাজারের মতো রংপুরের সবগুলো কাঁচাবাজারে খুচরা পর্যায়ে শীল আলু বিক্রি হচ্ছে ৭০-৮০ টাকা কেজি দরে, আর কার্ডিনাল আলু ৫০-৬০ টাকা কেজি দরে। এতে আশিকের মতো প্রায় সব ক্রেতারাই ক্ষুব্ধ আলুর এই ঊর্ধমুখী দামে।
রংপুর কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, এই জেলায় চলতি মৌসুমে ৫৩ হাজার ৩০৫ হেক্টর জমিতে আলুর আবাদ হয়েছে। উৎপাদন হয়েছে ১৬ লাখ ৪ হাজার ৫৫৬ টন। বাৎসরিক খাদ্য চাহিদা, বীজ ও ঘাটতি বাদ দিলেও এখানে ১৩ লাখ ১৬ হাজার ৩৯২ টন আলু উদ্বৃত্ত থাকে। তারপরও বছরের শুরু থেকে ঊর্ধ্বমুখী আলুর বাজার। ক্রেতারা বলছেন, উৎপাদন শীর্ষ জেলায় আলুর ঊর্ধমুখী দাম নিয়ন্ত্রণে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে সরকারকে।
এদিকে, ১ নভেম্বর থেকে সরকারের নির্দেশনা বাস্তবায়নে হিমাগার পর্যায়ে নির্ধারিত মূল্যে আলুর দর নিশ্চিত করতে রংপুরে মাঠে নেমেছে প্রশাসন। জেলার প্রতিটি হিমাগারের তালিকা করে বেঁধে দেওয়া দাম নিশ্চিত করতে তদারকিতে নামলেও কাজে আসছে না এই উদ্যোগও। আলুর দাম নিয়ন্ত্রণে হঠাৎ হিমাগরগুলোতে প্রশাসনের এই তদারকিতে সঠকে পড়েছেন মজুতদাররা। যে কারণে হিমাগার থেকে আলু বিক্রিও এখন প্রায় বন্ধ।
গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে রংপুরের কয়েকটি হিমাগার ঘুরে দেখা গেছে, দুই একজন করে কৃষক ভিত্তি বীজ আলু বের করছেন হিমাগরগুলো থেকে। তবে সেখানকার পাইকার ও আড়তদাররা বলছেন, মজুতদারদের সিন্ডিকেট ভাঙতে না পারলে সরকারের এই উদ্যোগ কোনো সুফল বয়ে আনবে না।
নগরীর রংপুর হিমাগারে তদারকিতে থাকা রংপুর সদর উপজেলার উপ সহকারী কৃষি কর্মকর্তা একেএম মোর্শেদুজ্জামান জানান, স্টোরগুলোতে এখনও ভিত্তি বীজ আলু ব্যতিত ১০-১৫ শতাংশ খাবার আলু মজুত আছে। আলু বেচাকেনায় সরকারের দেওয়া নির্ধারিত দাম নিশ্চিত করতে আমরা সার্বক্ষণিক তদারকি করছি। তবে, আমাদের তদারকিতে বেচাকেনা একদমে কমে গেছে। কৃষক ব্যবসায়ীরা বলছেন, হিমাগারে মজুত সব আলুই ভিত্তি বীজ।
রংপুরের একটি হিমাগারের স্টোর কিপার জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘গত সপ্তাহেও এই হিমাগারে পাইকারি দরে ব্যবসায়ীদের মধ্যে আলু কেনাবেচা হয়েছে ৪২ থেকে ৪৫ টাকা কেজি দরে। হঠাৎ ১ নভেম্বর থেকে হিমাগারে সরকারি লোকের তদারকিতে। ফলে যেসব আলু মজুত রয়েছে তা আর বের করছেন না মজুতদাররা। ফলে কৃত্রিম সংকটে বাজারে আলুর দাম আরও অস্থির হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।’
মৌসুমী আলু ব্যবসায়ী আমজাদ হোসেন বলেন, গত সপ্তাহেও আলুর দাম পাইকারি দরে ৪৫ টাকা ছিল। সেটি হঠাৎ করে সরকার ২৭ টাকায় নামিয়ে দিয়েছে। ফলে মজুতদারদের কেজিতে ১৫ থেকে ১৮ টাকা লোকশান হবে। হিমাগারগুলো থেকে মজুতদাররা আর আলু বের করছেন না। সরকারিভাবে এসব তদারকি দুই চার দিন হয়ে গেলে আবারও শিথিল হবে। শিথিল হলে বড় মজুতদাররা ফের আলু বের করবে তখন হয়তো আমরা স্টোর ব্যবসায়ীরা বেচাকেনা করতে পারব। এছাড়া এখন আমদের কোনো বেচাকেনা নেই।
অন্যদিকে, ভোক্তা পর্যায়ে আলুর দাম সহনীয় রাখতে রংপুরে খোলা ট্রাকে ৩৫ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে আলু। জেলা প্রশাসন এবং আলু চাষি ও ব্যবসায়ী সমিতি এই উদ্যোগ নিয়েছে। সিটি করপোরেশনসহ উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়েও চলছে এই কার্যক্রম। এতে কম দামে আলু পাওয়ায় ভোক্তাদের মাঝে কিছুটা স্বস্তি মিললেও চাহিদার তুলনায় সেটিও অপ্রতুল। আর কাচা বাজারগুলো থাকছে বেঁধে দেওয়া দামের ধরাছোঁয়ার বাইরে।
রংপুরের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোবাশ্বের হাসান বলেন, ‘ভোক্তা পর্যায়ে সরকারের বেঁধে দেওয়া দাম কার্যকর করতে হিমাগারের সঙ্গে বাজারগুলোতে নজরদারি করা হচ্ছে। পাশাপাশি টিসিবির কার্যক্রম জেলাসহ উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদ পর্যায়ে চালু করা হয়েছে। সাধারণ মানুষ যাতে সঠিক দামে আলু কিনতে পারেন আমরা সেটি নিশ্চিত করতে কাজ করছি।’
মাসুদ