ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ০৯ মে ২০২৪ ||  বৈশাখ ২৬ ১৪৩১

মাগুরা-১ ও ২ আসন

আ.লীগ-বিএনপির অভ্যন্তরীণ বিরোধ ছাপিয়ে আলোচনার কেন্দ্রে সাকিব

শাহীন আনোয়ার, মাগুরা || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:১১, ২০ নভেম্বর ২০২৩   আপডেট: ১৬:৫৬, ২০ নভেম্বর ২০২৩
আ.লীগ-বিএনপির অভ্যন্তরীণ বিরোধ ছাপিয়ে আলোচনার কেন্দ্রে সাকিব

বাঁ থেকে সাইফুজ্জামান শিখর, ড. বীরেন শিকদার, অ্যাড. নিতাই রায় ও সাকিব আল হাসান/ ছবি: কোলাজ

মাগুরা-১ ও ২ সংসদীয় আসনে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ বিরোধ ছাপিয়ে এখন আলোচনার কেন্দ্রে জাতীয় ক্রিকেট দলের অধিনায়ক সাকিব আল হাসান। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হতে সাকিব এই দুটি আসনের জন্য আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরম কিনেছেন। সাকিবের পক্ষে তার একজন প্রতিনিধি গত শনিবার (১৮ নভেম্বর) রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেন। এ ছাড়াও, তিনি ঢাকা-১০ আসনের জন্যও মনোনয়নপত্র কিনেছেন।

সাকিব আল হাসান আওয়ামী লীগের মনোনয়ন সংগ্রহের পরই মাগুরায় দুটি সংসদীয় আসনের রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী ও সাধারণ ভোটারদের মধ্যে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়েছে। সবার একটাই প্রশ্ন, সাকিব আল হাসান মাগুরার কোন আসনে মনোনয়ন পাচ্ছেন? 

সাকিবের নির্বাচনে অংশ নেওয়ার বিষয়টি অনেকটাই ওপেন সিক্রেট। এরপর ক্ষমতাসীন দলের মনোনয়ন ফরম সংগ্রহের খবর ছড়িয়ে পড়লে বিভিন্ন মহলে শুরু হয় মিশ্র প্রতিক্রিয়া। বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও পক্ষে-বিপক্ষে মন্তব্য করেন অনেকে।

এদিকে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি ইতোমধ্যে শুরু করেছে মাগুরা আওয়ামী লীগ। জেলায় দলটির সাংগঠনিক ভিত্তি মজবুত হলেও গত পাঁচ বছরে নানা কারণে বিভক্তি উদয় হয়েছে। নেতাদের মধ্যে দৃশ্যমান বিরোধ না থাকলেও দুজন সংসদ সদস্যকে কেন্দ্র করে তৃণমূলে বিরোধ অনেকটাই ঊর্ধ্বমুখী। গত পাঁচ বছরে জেলা-উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে বিরোধের বিষয়টি স্পষ্ট হয়। অভ্যন্তরীণ বিরোধ মিটিয়ে নির্বাচনের আগে ঐক্যবদ্ধ থাকাটাই এখন আ.লীগের চ্যালেঞ্জ।

অন্যদিকে, মামলার চাপে কোণঠাসা জেলা বিএনপি। দীর্ঘদিন ধরে মাগুরায় দলটির অবস্থা নাজুক। রয়েছে কোন্দলও। এক দশক ধরে উন্মুক্ত মাঠে সমাবেশ করতে পারেননি দলটির নেতাকর্মীরা। দলীয় কার্যালয়ে প্রশাসনের বেঁধে দেওয়া সীমার মধ্যে তাদের কর্মসূচি পালন করতে হয়। গত ২৮ অক্টোবরের পর থেকে দলীয়ভাবে আর মাঠেই নামতে পারেনি বিএনপি। এ ছাড়া, নির্বাচন সামনে রেখে নিজেদের মতো করে সমর্থন বাড়ানোর চেষ্টা করছে জাতীয় পার্টি, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ-সহ সমমনা দলগুলো।

ভোটের রাজনীতিতে তিন দশক ধরে মাগুরার দুটি আসনে আধিপত্য ধরে রেখেছে আওয়ামী লীগ। ১৯৯১ সালের পর ‘প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ’ চারটি সংসদীয় নির্বাচনের তিনটিতেই জিতেছেন দলের প্রার্থীরা। গত বছরের ১৪ মে সম্মেলনে আ ফ ম আবদুল ফাত্তাহ সভাপতি ও পঙ্কজ কুমার কুণ্ডু সাধারণ সম্পাদক হন। চলতি বছরের এপ্রিলে অনুমোদন পায় পূর্ণাঙ্গ কমিটি। সম্মেলনের মাধ্যমে উপজেলা ও পৌর কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিতে সংসদ সদস্যের অনুসারীদের আধিপত্যের কারণে তৃণমূলের পক্ষ তৈরি হয়েছে। যুবলীগ ছাড়া সহযোগী সংগঠনগুলোর হালনাগাদ কমিটি আছে।

আওয়ামী লীগ সূত্রে জানা গেছে, মাগুরা-১ (সদর-শ্রীপুর) আসনের সংসদ সদস্য সাইফুজ্জামান শিখর ও মাগুরা-২ (মহম্মদপুর-শালিখা-সদর) আসনের সংসদ সদস্য বীরেন শিকদারকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন এলাকায় দুটি করে পক্ষ তৈরি হয়েছে। এক পক্ষে নেতৃত্ব দিচ্ছেন সংসদ সদস্যের অনুসারীরা, অন্য পক্ষে আছেন তাদের প্রতিপক্ষ নেতাকর্মীরা। 

২০১৯ সালের চারটি উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের তিনটিতেই হারেন নৌকার প্রার্থীরা। ২০২২ সালে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনেও ১১টিতে ধরাশায়ী হয় আওয়ামী লীগ। কোনও কোনও এলাকায় ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থীরা জনপ্রতিনিধিদেরও সমর্থন পান।

মাগুরা-২ আসনের প্রায় প্রতিটি ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ দুই ভাগে বিভক্ত। সংসদ সদস্য বীরেন শিকদার ছাড়াও বেশ কয়েকজন নির্বাচন করতে চায়। তাদের মধ্যে জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা এস কে নুরুজ্জামান, শিক্ষা ও মানবসম্পদবিষয়ক সম্পাদক শরীফ উদ্দিন উল্লেখযোগ্য। সর্বশেষ, ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান এই আসনসহ তিনটিতে মনোনয়ন ফরম কিনেছেন।

জানা গেছে, সাকিব আল হাসান বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন। তিনি দেশে ফিরে মনোনয়ন জমা দেওয়ার পর বিষয়টি স্পষ্ট হবে। সম্প্রতি সাকিব, নতুন নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে (বিএনএম) যোগদানের গুঞ্জনও ওঠে। এ বিষয়ে জানতে সাকিবের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।

সাকিবের মনোনয়ন সংগ্রহের বিষয়ে তার ছোট বেলার ক্রিকেট গুরু সাদ্দাম হোসেন গোর্কির কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনিও এ ব্যাপারে কোনও মন্তব্য করতে রাজি হননি। এ ছাড়া, সাকিবের বাবা সাবেক ফুটবলার মাশরুর রেজা কুটিলও মন্তব্য করতে অনীহা প্রকাশ করেন।  

জানতে চাইলে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আ ফ ম আবদুল ফাত্তাহ বলেন, তিনি (সাকিব আল হাসান) কখনও জনগণের সঙ্গে মাঠে কাজ করেছেন বা কোনও দলের রাজনীতি করেছেন বলে তো শুনিনি। নেত্রী ভালো বুঝবেন, কাকে মনোনয়ন দিলে ভালো হয়। তার কাছে সব তথ্যই আছে।

অন্যদিকে, দলীয় সূত্র জানায়, এক দশকের বেশি সময় ধরে জেলা আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনে সংসদ সদস্য সাইফুজ্জামানের দাপট বেশি। এখানে এতদিন মনোনয়নপ্রত্যাশী কেউ প্রকাশ্যে আসেননি। কিন্তু গত শনিবার ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান দলীয় মনোনয়ন ফরম কেনায় এলাকায় বেশ আলোচনা হচ্ছে। সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে শ্রীপুরে একটি পক্ষ সক্রিয়। যাদের অনেকে মনে করেন, সংসদ সদস্য ত্যাগী নেতাদের মূল্যায়ন না করে কোণঠাসা করে রেখেছেন। যদিও সাইফুজ্জামান সেই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।

ড. শ্রী বীরেন শিকদার বলেন, স্থানীয় নির্বাচন আর জাতীয় নির্বাচন এক নয়। নির্বাচনের আগে এসব সমস্যার পুরোটা না হলেও বেশিরভাগই সমাধান হয়ে যাবে।

জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পঙ্কজ কুমার কুণ্ডু বলেন, পাওয়া-না পাওয়া নিয়ে অনেকের হতাশা থাকতে পারে। জাতীয় নির্বাচনে দলের বিরোধিতা করার সুযোগ নেই। এই প্রশ্নে আওয়ামী লীগ এক ও ঐক্যবদ্ধ।

এদিকে, বিএনপি দলীয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১৬ সালের পর থেকে আহ্বায়ক কমিটি দিয়েই চলছে জেলা বিএনপির রাজনীতি। সর্বশেষ ২০১৯ সালে আলী আহমেদকে আহ্বায়ক ও আখতার হোসেনকে সদস্যসচিব করে ৩৩ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করে কেন্দ্র। মহম্মদপুর, শালিখা ও দক্ষিণ মাগুরা ইউনিটে আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করা হলেও সদর, শ্রীপুর ও মাগুরা পৌর ইউনিট একজন নেতা দিয়েই চলছে দলীয় কার্যক্রম। 

২০২০ সালের প্রথম দিকে সদর, শ্রীপুর ও মাগুরা পৌরসভায় কমিটি গঠনের উদ্যোগ নেয় জেলা বিএনপি। তৃণমূলের নেতাকর্মীদের ভোটে পৌর ইউনিটের আহ্বায়ক হিসেবে মাসুদ হাসান খান ও সদর উপজেলায় কুতুব উদ্দিন এবং শ্রীপুর উপজেলা বিএনপির সদস্যসচিব হিসেবে মুন্সী রেজাউল ইসলাম নির্বাচিত হন। এরপর কমিটির আকার আর বাড়েনি।

জেলা বিএনপির সদস্যসচিব আখতার হোসেন বলেন, সম্মেলন আয়োজন করতে নেতাকর্মীদের জড়ো করতে হয়। গত কয়েক বছরে আওয়ামী লীগ ও পুলিশ প্রশাসন তাদের সেই জায়গাও দেয়নি।

বিএনপি নেতারা বলছেন, ক্ষমতাসীনরা কর্মসূচিতে বাঁধা দেওয়ার পাশাপাশি গায়েবি মামলা দিয়ে বিএনপি নেতাকর্মীদের কোণঠাসা করে রেখেছে। ২০১৪ সাল থেকে মাগুরায় বিএনপির নেতাকর্মীদের নামে ৪৫টির বেশি মিথ্যা ও গায়েবি মামলা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ২৮ অক্টোবর ঢাকায় মহাসমাবেশের পর মামলা হয়েছে পাঁচটি। বিএনপির ১২ জনের বেশি নেতার বিরুদ্ধে ২০টির বেশি মামলা আছে।

মামলা-হামলার চাপের মধ্যেও জেলা বিএনপি দুটি ধারায় বিভক্ত। এক পক্ষের নেতৃত্বে আছেন ২০১৮ সালে মাগুরা-১ আসনে মনোনয়ন পাওয়া জেলা বিএনপির সদস্য মোনোয়ার হোসেন খান এবং মাগুরা-২ আসনের প্রার্থী বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান নিতাই রায় চৌধুরী। অন্য পক্ষের নেতৃত্বে আছেন জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আলী আহমেদ।

আলী আহমেদ বলেন, এটা বিরোধ নয়, প্রতিযোগিতা। স্থানীয় নেতৃত্ব নিয়ে প্রতিযোগিতা থাকতে পারে। তারা সবাই দল ও নেতা তারেক রহমানের অনুগত। নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে দল যাকে মনোনয়ন দেবে, তারা তার পক্ষে কাজ করবেন।

জেলা জাতীয়তাবাদী আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক শাহেদ হাসান বলেন, মাসে আদালত চলে ২২ দিন। এর মধ্যে বিএনপির নেতাকর্মীদের অন্তত ১৫ দিন হাজিরা দিতে হয়। গত কয়েক মাসে ইউনিয়ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদেরও মামলায় আসামি করা হয়েছে। মামলার কারণে নেতাকর্মীদের ব্যবসা-বাণিজ্য, পরিবার, স্বাভাবিক চলাফেরা সবকিছু বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

মাসুদ/এনএইচ

ঘটনাপ্রবাহ

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়