ঢাকা     শনিবার   ২৭ জুলাই ২০২৪ ||  শ্রাবণ ১২ ১৪৩১

ফায়ার ফাইটার রাসেলের জন্য মায়ের আহাজারি থামছে না

সাভার (ঢাকা) প্রতিনিধি || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২১:১০, ২৮ মে ২০২৪   আপডেট: ২১:৩৭, ২৮ মে ২০২৪
ফায়ার ফাইটার রাসেলের জন্য মায়ের আহাজারি থামছে না

ছেলের জন্য মায়ের আহাজারি থামছে না। ইনসেটে নিহত রাসেল হোসেন

খাগড়াছড়িতে ঘূর্ণিঝড় রেমালে ভেঙে পড়া গাছ সরাতে গিয়ে বিদ্যুতায়িত হয়ে প্রাণ হারানো রাসেলের (২১) বাড়িতে চলছে স্বজনদের আহাজারি। সন্তানের মরদেহের জন্য অপেক্ষারত স্বজনদের আহাজারিতে ভারী হয়ে উঠছে আকাশ-বাতাস।

সোমবার (২৮ মে) ঘূর্ণিঝড় রেমালে ভেঙে পড়া গাছ সরাতে গিয়ে বিদ্যুতায়িত হয়ে প্রাণ হারান ফায়ার ফাইটার রাসেল। খবরটি শেলের মতো এসে বেঁধে মায়ের বুকে।

সোমবার বিকেলের দিকে ঢাকার ধামরাই উপজেলার সোমভাগ ইউনিয়নের পশ্চিম বাসনা এলাকায় ফায়ার ফাইটার রাসেল হোসেনের বাড়ি গিয়ে দেখা যায়, সেফালি আক্তার বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন। কারও সান্ত্বনাই শান্ত করতে পারছে না তাকে।

জানান, মাধ্যমিক উত্তীর্ণ হওয়ার পর ফায়ার সার্ভিসে চাকরি নিয়েছিলেন রাসেল হোসেন। কর্মস্থল ছিল খাগড়াছড়িতে। শুক্রবার সবশেষ ভিডিওকলে মায়ের সঙ্গে কথা হয়। বলেছিলেন, ‘পাঞ্জাবি পরে বাবার সঙ্গে ঈদের নামাজ পড়তে যাব।’ আশায় ছিলেন মা। শেষ পর্যন্ত মা-ছেলে কারও আশাই পূরণ হলো না। ছেলের কথা বলতে বলতে বুক চাপড়ে আহাজারি করছিলেন মা সেফালি আক্তার। বলছিলেন ‘আমি ঘটনা শোনার পরেই আল্লাহর কাছে আমার বাবাকে ভিক্ষা চাইছি, আল্লাহ তুমি আমার বাবাকে ভিক্ষা দাও, আমার ছেলে থাকলে এত কষ্ট হইতো না।’

পশ্চিম বাসনা এলাকার আ. রাজ্জাক ও সেফালি আক্তার দম্পতির এক মেয়ে ও এক ছেলের মধ্যে ছোট রাসেল হোসেন। ২০২১ সালে এসএসসি পাস করে এইচএসসিতে ভর্তি হন ধামরাইয়ের ভালুম আতাউর রহমান খান স্কুল অ্যান্ড কলেজে। সেখানে পড়া অবস্থায়ই ২০২৩ সালে ফায়ার সার্ভিসে ফায়ার ফাইটার পদে চাকরি হয় তার।

সোমবার রাত ১০টার দিকে ঘূর্ণিঝড় রেমালের ফলে খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গা উপজেলার আলুটিলা এলাকায় গাছ ভেঙে পড়েছে, এমন খবর পেয়ে খাগড়াছড়ি ফায়ার সার্ভিস ঘটনাস্থলে যায় এবং গাছ অপসারণ করতে থাকে। গাছ অপসারণের একপর্যায়ে হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে আসায় ফায়ার ফাইটার মো. রাসেল হোসেন বিদ্যুতায়িত হন। গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে খাগড়াছড়ি সদর হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। রাতেই ছেলের মৃত্যুর খবর পান সেফালি আক্তার।

রাসেলের বাড়িতে তিন কক্ষের চৌচালা টিনের ঘর। চাকরিতে যাওয়ার পর বাড়ি ফিরলে মা-বাবার সঙ্গেই ঘুমাতেন। ছেলের স্মৃতি হাতড়ে ডুকরে কেঁদে ওঠেন মা। ছেলেকে মানুষ করতে পোশাক কারখানায় চাকরি নিয়েছিলেন জানিয়ে সেফালি আক্তার বলেন, ‘আমার ছেলের জন্য আমি কত কষ্ট করছি, আমার ছেলের যখন আট বছর বয়স তখন থেকে চাকরি করি। আজ ১৩ বছর আমি আমার ছেলের সুখের জন্য চাকরি করি। সেই ছেলে আমার কাছে থেকে চলে গেলো, এখন আমি কাকে নিয়ে বেঁচে থাকমু। সব মানুষ কয় তুমি চাকরি ছেড়ে দাও, আমার ছেলে ঋণ দেখে আমি চাকরি ছাড়ি নাই।’

রাসেলের ঈদে ছুটিতে আসার কথা ছিল জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমার বাবা রোজার ঈদে আসছিল, আবার ঈদের পরেও আসছিল। রোজার আগে স্যারেরা ছুটি দেয় নাই, সেজন্য আমার কাছে অনেক দুঃখ করছে। পরে অন্য স্যার আসার পর ছুটি দিছে। আমার বাবাকে আজকে হারাইলাম, আমি কেমনে সহ্য করুম, আমার বাবা আমাকে মাটি দিত। আর আমি আমার বাবাকে কেমনে মাটি দিমু? আমার সংসারের প্রদীপ হারিয়ে গেল।’

আহাজারি করতে করতে তিনি আরও বলেন, ‘আল্লাহ কাছে আমি কিছুই চাইনি তো, শুধুই একটা ছেলে চাইছিলাম। আল্লাহ কাছে চাইছিলাম আল্লাহ আমাকে ছেলে দিছিল, দিয়ে আজকে আমার ছেলেকে নিয়া গেল। আমার ছেলে লম্বা ছিল, সুন্দর ছিল, আমি সবার কাছে গৌরব করতাম। আল্লাহ আমাকে অনেক সুন্দর ছেলে দিছে। আমার বাবার ছবি আমি মনে ভেতর গাঁইথা রাখছি। আমি গার্মেন্টসে চাকরি কইরা আমার ছেলেকে মানুষ করছি। কত মানুষকের ছেলেরা ১৫ বছর ২০ বছর চাকরি করে আর আমার বাবা চাকরিতে মাত্রই গেছে।’

অসুস্থ হওয়ায় ছেলের কাছে মাফ চেয়েছিলেন জানিয়ে সেফালি আক্তার বলেন, ‘গত শুক্রবার ভিডিওকলে শেষবার কথা বলছি। ডিউটিতে কাজের চাপ দেখে কম কথা বলি। আমার শরীরটা ভাল না, আমার শরীর অসুস্থ। আমি আমার বাবাকে বলি, আমি কখন যেন মরে যাই, আমি আমার বাবাকে বলছি আমাকে মাফ করে দিও। যদি হঠাৎ করে মরে যাই, তুমি আমাকে মাফ করে দিও। এসব বলি দেখে আমার বাবাটা মন খারাপ করে থাকে। চাকরিতে যাওয়ার পর থেকেই এই জায়গায় থাকতে চায় না। এই জায়গার মানুষ ভালো না। কিন্তু আমি তো বুঝি নাই আমার বাবার মনে কী কইছে।’

ঈদে ছেলের আসার কথা ছিল জানিয়ে রাসেলের মা আরও বলেন, ‘এই মাসের ২০ তারিখ তার ছুটি ছিল। সে আমারে কইছে, মা এখন যদি ছুটিতে আসি তাহলে ঈদের মধ্যে আমাকে ছুটি দেব না। রোজার ঈদে ছুটি পাই নাই। তাই আমি বলছি একা একা বাড়িতে ঈদ করি আমার ভালো লাগে না। এই ঈদ আমার সঙ্গে করব। আমার বাবা বলছিল ঈদের মধ্যে বাড়িতে আসুম। রোজার ঈদের আগে আসছিল, তখন পাঞ্জাবি কিনে দিছিলাম। সেই পাঞ্জাবি বাড়িতে রেখে গেছে। আমার বাবা বলছিল, পাঞ্জাবি পরে ঈদের মাঠে যামু। আশা করছিল, আমার সঙ্গে ঈদ করব। আমার বাবা আর আইবো না। যদি আমি জোর দিয়ে বলতাম ২০ তারিখ আসার জন্য, তাহলে আমার বাবা আসতো। আমি না করছি, একসঙ্গে ঈদ করমু দেখে। আমি আমার বাবাকে বলছি তুমি তোমার সুযোগ মত আইবা যে সময় তুমি ছুটি পাইবা, আসবা।’

বাবা আব্দুর রাজ্জাক আর্তনাদ করে কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘আমার দিন কেমনে যাইবো, আবার বাবা আমাকে রেখে কেমনে পলাইলো। আমি এত কষ্ট করে ওরে মানুষ করছি। আমি বুকের মধ্যে রাইখা ওরে মানুষ করছি। এখন পর্যন্ত এক চড়ও দিইনি। আমি ওরে কেমনে ভুইলা থাকুম, আমার বাড়ির প্রদীপ শেষ। আমাকে ভাত কাপড় না দিত, আমাকে মাটি তো দিত। আমি কইছি আল্লাহ ওরে তুমি বাঁচিয়ে রাইখো, আমাকে যেন মাটি দিতে পারে। আমার সেই ভাগ্য হইলো না। আল্লাহ আজকে আমার হাতে ওরে মাটি দেওয়াইবো। আমার দিন কেমনে যাইব।’

সাব্বির/ফয়সাল/এনএইচ

ঘটনাপ্রবাহ

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়