১১ বছর ধরে ‘গুম’ কুমিল্লায় সাবেক এমপি হিরু
কুমিল্লা প্রতিনিধি || রাইজিংবিডি.কম
নিখোঁজ সাইফুল ইসলাম হিরু ও হুমায়ূন কবীর পারভেজ
প্রায় ১১ বছর আগে র্যাবের হাতে আটক হয়ে কুমিল্লা থেকে ‘নিখোঁজ’ হন লাকসাম উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য সাইফুল ইসলাম হিরু। এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন লাকসাম পৌর বিএনপির সাবেক সভাপতি হুমায়ূন কবীর পারভেজ।
দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেলেও ওই দুই নেতার কোনো সন্ধান মেলেনি। স্বজনরা তাদের ফিরে আসার অপেক্ষায় দিন গুনছেন। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর কথিত আয়না ঘর থেকে ‘গুম’ একাধিক ব্যক্তি ফিরে এসেছেন। এ খবরে নতুন করে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাছে খোঁজখবর নিচ্ছেন দুই পরিবারের স্বজনরাও। হিরু ও পারভেজ বেঁচে আছেন নাকি মারা গেছেন এই সংবাদ দুই পরিবারের কারও কাছে নেই। পরিবারের লোকজন তাদের ফিরে আসার অপেক্ষায় আছেন।
সেদিন যা ঘটেছিল
মামলার অভিযোগ ও পরিবার সূত্রে জানা গেছে, ২০১৩ সালের ২৭ নভেম্বর রাতে কুমিল্লার হরিশ্চর এলাকা থেকে র্যাব সদস্যরা ঢাকাগামী অ্যাম্বুলেন্স থেকে সাবেক এমপি হিরু, বিএনপির নেতা কবীর ও পৌর বিএনপি নেতা জসিম উদ্দিনকে তুলে নিয়ে যায়। পরে র্যাব জসিমকে কুমিল্লার পদুয়ার বাজার বিশ্বরোড এলাকায় অন্য একটি মাইক্রোবাসে তুলে দেয়। তবে তাদের থানায় হাজির করেনি র্যাব। এরপর থেকে তারা দু’জন ‘নিখোঁজ’ রয়েছেন।
থানায় মামলা নেয়নি
দু’জনকে তুলে নেওয়ার ঘটনায় থানায় মামলা নেয়নি পুলিশ। পরে ২০১৪ সালের ১৮ মে হুমায়ূন কবীর পারভেজের বাবা রংগু মিয়া কুমিল্লার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা করেন। মামলায় র্যাব-১১-এর চাকরিচ্যুত প্রধান কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, কোম্পানি অধিনায়ক মেজর সাহেদ রাজী, ডিএডি শাহজাহান আলী, এসআই সুলতান আহমেদ ও অসিত কুমারকে আসামি করা হয়। ওই বছরের ৩১ আগস্ট মামলার বাদী রংগু মিয়া মারা যান। পরে ২০১৪ সালের ১৫ অক্টোবর পারভেজের ছোট ভাই গোলাম ফারুককে এ মামলার বাদী করা হয়। ২০১৫ সালে মামলাটি সিআইডিতে স্থানান্তর করা হয়।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার জালাল উদ্দিন আহম্মদ ২০২০ সালের ২৭ আগস্ট তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করেন। এতে র্যাব কর্তৃক দু’জনকে ‘অপহরণের বিষয়টি প্রমাণিত হয়নি’ বলে উল্লেখ করা হয়। প্রতিবেদনে দুই ব্যক্তি স্বেচ্ছায় ‘আত্মগোপনে’ থাকতে পারেন বলে উল্লেখ করা হয়।
মামলার আইনজীবী বদিউল আলম সুজন বলেন, ‘পুলিশের তদন্তের পর সিআইডি সাড়ে পাঁচ বছরে অন্তত ৬৩ বার আদালত থেকে সময় নিয়ে একটি মনগড়া ও মিথ্যা প্রতিবেদন দিয়েছে। পরে বাদীর নারাজির প্রেক্ষিতে আদালত মামলা পিবিআইতে স্থানান্তর করে। মামলা এখন তদন্ত করছেন পুলিশের লাকসাম সার্কেলের একজন এএসপি। আশা করি, স্বজনরা বেঁচে থাকলে তাদের ফিরিয়ে দেওয়া হবে।’
দুই পরিবারের সদস্যরা যা বলেন
সাইফুল ইসলাম হিরুর একমাত্র ছেলে রাফসানুল ইসলাম। ঘটনার সময় বয়স ছিল ১৭ বছর। বর্তমানে বাবার ব্যবসা দেখছেন। তিনি বলেন, ‘বাবার খোঁজ চেয়ে অনেকের দ্বারস্থ হয়েছি। লাকসাম থানায় মামলা নেয়নি। পরে কোনো উপায় না পেয়ে ‘বাবা হারিয়ে গেছে’– এই মর্মে একটি জিডি করি। সেখান থেকে আমরা যাই র্যাব-১১-এর নারায়ণগঞ্জ অফিসে। র্যাব সেদিন অভিযান চালালেও আমার বাবাকে আটক করেনি বলে জানানো হয়। সেই থেকে যেখানেই বাবার খোঁজ আছে শুনেছি, সেখানেই ছুটে গেছি। এখনও বাবাকে খুঁজছি। আমরা ডিজিএফআইর সঙ্গে দেখা করেছি, তারা প্রয়োজনীয় কিছু তথ্য-প্রমাণ চেয়েছে, আমরা সব দিয়েছি। আশা করি বাবাকে ফিরে পাব।’
হিরুর স্ত্রী ফরিদা ইসলাম হাসি বলেন, ‘সন্তানরা বাবার জন্য সারাক্ষণ কাঁদে। সরকার পরিবর্তনের পর অনেকেই ফিরে আসছে। তাঁর ফিরে আসার অপেক্ষায় আছি। আশা করি নতুন সরকার এ বিষয়ে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেবে।’
নিখোঁজ হুমায়ূন কবীর পারভেজের স্ত্রী শাহনাজ আক্তার বলেন, ‘আমার স্বামীর কী অপরাধ ছিল? বিএনপি করা কী অপরাধ? আমরা প্রিয় মানুষটিকে ফিরে পেতে চাই।’
পারভেজের ছেলে শাহরিয়ার কবির রাতুল বলেন, ‘আশা করি নতুন সরকারের কাছ থেকে একটি ইতিবাচক খবর পাব।’
মামলার বাদী গোলাম ফারুক বলেন, ‘একটি স্বাধীন দেশে প্রকাশ্যে দুটি মানুষকে উঠিয়ে নিয়ে গুম করা হলো কার নির্দেশে? সিআইডি মনগড়া একটি প্রতিবেদন দিয়েছিল।’
রুবেল/সনি