ঢাকা     মঙ্গলবার   ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪ ||  অগ্রহায়ণ ১৮ ১৪৩১

এশিয়ান ইউনিভার্সিটির জরিপ

অন্তর্বর্তী সরকারকে অন্তত ২ বছর চায় ৫৭ শতাংশ মানুষ

সাভার (ঢাকা) প্রতিনিধি || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৭:৩১, ১১ নভেম্বর ২০২৪   আপডেট: ২০:৪৩, ১১ নভেম্বর ২০২৪
অন্তর্বর্তী সরকারকে অন্তত ২ বছর চায় ৫৭ শতাংশ মানুষ

দেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংস্কারের জন্য অন্তর্বতীর্কালীন সরকারকে অন্তত ২ বছর বা তারও বেশি সময় ক্ষমতায় থাকতে দেওয়া উচিত বলে মনে করেন ৫৭ শতাংশ মানুষ। 

আর ২৪ শতাংশ মনে করেন এই সরকারের ৬ মাসের বেশি ক্ষমতায় থাকা উচিত নয়। ১০ শতাংশ মত দিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের ক্ষমতার মেয়াদ এক বছর করার পক্ষে। 

এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের এক জরিপে এই তথ্য উঠে এসেছে।

সোমবার (১১ নভেম্বর) দুপুরে ঢাকার সাভারের আশুলিয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়টির সেমিনার হলে এই জরিপের ফলাফল প্রকাশ করা হয়।

ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ৮ আগস্ট নোবেলজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে শপথ গ্রহণ করে অন্তর্বর্তী সরকার। 

সেই হিসাবে তিন মাসের বেশি সময় দেশ পরিচালনা করা এই সরকারকে রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয় সংস্কার করার স্বার্থে আরও সময় দেওয়ার পক্ষে যে জনমত রয়েছে, এশিয়ার ইউনিভার্সিটির জরিপে তারই প্রতিফলন ঘটতে দেখা যাচ্ছে।

‘অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থনৈতিক উদ্যোগের কার্যকারিতা নিয়ে জনমত যাচাই: একটি পালস সমীক্ষা’ শিরোনামে জরিপটি পরিচালনা করেছে এশিয়ান ইউনিভার্সিটির অর্থনীতি বিভাগ।

জরিপে শহর ও গ্রাম মিলিয়ে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার নানা বয়সি ৪ হাজার ৮৬০ জন মানুষ অংশ নেয়, যাদের মধ্যে ৬০ শতাংশ পুরুষ ও ৪০ শতাংশ নারী। 

জরিপে অংশগ্রহণকারীদের প্রত্যেককে সুনির্দিষ্ট ১৫টি প্রশ্ন করা হয়, যার ভিত্তিতে ফলাফল প্রস্তুত করা হয়েছে।

ফলাফল প্রকাশ অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে এইউবি এর প্রতিষ্ঠাতা উপাচার্য অধ্যাপক আবুল হাসান মুহাম্মদ সাদেক, ট্রেজারার অধ্যাপক মো. নূরুল ইসলাম, অর্থনীতি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান রবিউল করিম মৃদুল বক্তব্য দেন।  

জরিপ প্রতিবেদনে তুলে ধরা তথ্য অনুযায়ী, অন্তর্বর্তী সরকারের নূন্যতম মেয়াদের সঙ্গে এই সরকারে ছাত্রদের সরাসরি অংশগ্রহণ বিষয়ক প্রশ্ন রাখা হয়েছিল। 

এই প্রশ্নের জবাবে ৬১ দশমিক ৪ শতাংশ মানুষ বলেছেন, তারা ছাত্রদের অংশগ্রহণের বিষয়টিকে ইতিবাচক হিসেবেই দেখছেন।

জরিপে বিগত সরকারের অস্বাভাবিক দুর্নীতি ও প্রভাবশালী রাজনীতিকদের সরাসরি হস্তক্ষেপের কারণে প্রায় মুমূর্ষু অবস্থায় পৌঁছে যাওয়া দেশের ব্যাংকিং খাত অন্তর্বতীর্কালীন সরকারের সময়ে আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারবে কি না, এমন একটি প্রশ্ন রাখা হয়েছিল। 

এই প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে ৬৭ শতাংশ মানুষ বলেছেন, তারা আশাবাদী। অবশিষ্ট অংশগ্রহণকারীরা হতাশা থেকে বের হতে পারেননি এখনও।

জরিপে অংশ নেওয়া ৬৮ শতাংশ মানুষ মনে করেন ধারাবাহিকভাবে কমতে থাকা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক রিজার্ভ নতুন গভর্নর ও সরকারের নেতৃত্বে আবার একটি সন্তোষজনক জায়গায় পৌঁছাতে পারবে। তবে এর জন্য রিজার্ভের টাকা অগুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন খাতে ব্যয় করার প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে বলে মত দিয়েছেন তারা।

জরিপের ফলাফল প্রকাশের সময় বলা হয়েছে, ৫১ শতাংশ মানুষ মনে করেন বিদেশে পাচার হয়ে যাওয়া টাকা দেশে ফেরাতে সফল হবে অন্তবর্তী সরকার।

৪৯ শতাংশের বক্তব্য হলো- পাচার হওয়া টাকা ফেরাতে আরও কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। ৯৪ শতাংশ মানুষের মত পাচারকৃত টাকা দেশে ফেরাতে বিদেশি সরকারগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ ও তৎপরতা আরও ব্যাপকভাবে বাড়ানো প্রয়োজন।

বিভিন্ন ইসলামী ব্যাংক থেকে ‘লুটে নেওয়া’ বিপুল পরিমাণ অর্থ উদ্ধারে লুটেরা কোম্পানিগুলোর সম্পত্তি বিক্রি করে অর্থ উদ্ধারের পক্ষে ৭৭ দশমিক ৩ শতাংশ মানুষ।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শেয়ার বাজার কেলেংকারির হোতাদের বিচার করতে পারবে কি না- এই প্রশ্নের উত্তরে সরকারের পক্ষে মত দিয়েছে ৫৫ দশমিক ৭ শতাংশ মানুষ। অন্য উত্তরদাতারা মনে করেন, কেলেংকারির হোতারা ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাবে বরাবরের মতো।

পণ্য বাজারের অস্থিরতা বিশেষ করে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকার এখন পর্যন্ত যেসব উদ্যোগ নিয়েছে, তা যথেষ্ট নয় মনে করেন ৮৩ দশমিক ৮ শতাংশ মানুষ। সরকারকে আরও কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। ৯৬ দশমিক ৭ শতাংশ মানুষ মনে করেন দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট ভেঙে দিতে হবে সবার আগে।

বিগত সরকারের গ্রহণ করা অবাস্তবায়িত মেগা প্রকল্পগুলো পুর্নবিবেচনার পক্ষে মত দিয়েছে ৬৪ দশমিক ৬ শতাংশ মানুষ। তারা মনে করেন, এ সব মেগা প্রকল্প এই মুহূর্তে দেশের জন্য জরুরি নয়। এতে অর্থনীতির লাভের চেয়ে অর্থের অপচয় হয় বেশি।

দেশের ব্যাংকিং খাত ও বাজার ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আরও শক্তিশালী ভূমিকা পালন করতে হবে বলে মনে করেন ৯৭ শতাংশ মানুষ। ৭৬ শতাংশ মনে করেন তারল্য সংকট সমাধানের জন্য নতুন টাকা ছাপানো কোনো কার্যকর উদ্যোগ নয়। বিগত সরকার অনিয়ন্ত্রিতভাবে নতুন টাকা ছাপিয়ে অর্থনীতির ওপর চাপ তৈরি করেছে। অন্তর্বতীর্কালীন সরকারকে এই পথে হাঁটলে চলবে না। 

বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণ উদ্ধারে ঋণ খেলাপি কোম্পানিগুলোর স্থাবর-অস্থাবর সব সম্পত্তি সরকারি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেওয়া উচিত বলে মত দিয়েছেন জরিপে অংশ নেওয়া ৮৫ শতাংশ মানুষ। তারা মনে করেন, কোম্পানিগুলোর সব সম্পত্তি বাজেয়াপ্তের পাশাপাশি কার্যকর আইনি ব্যবস্থাও নেওয়া উচিত তাদের বিরুদ্ধে।

ছাত্র-জনতার অভ্যূত্থানের মাধ্যমে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়ে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে দেশ সঠিক পথে এগোচ্ছে কি না- এমন একটি প্রশ্নের জবাবে ৪৬ শতাংশ মানুষ জানাচ্ছেন, দেশ সঠিক পথে এগোচ্ছে।

দেশের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে হতাশা ব্যক্ত করেছেন ২২ শতাংশ মানুষ। কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি ৩২ শতাংশ। তারা মনে করেন, দেশ কোন পথে এগোচ্ছে তা নিয়ে মন্তব্য করতে হলে আরও অপেক্ষা করতে হবে।

জরিপের ফলাফল প্রকাশ অনুষ্ঠানে অধ্যাপক আবুল হাসান মুহাম্মদ সাদেক বলেন, ‘রিজার্ভের টাকা বিগত সরকারের মতো অগুরুত্বপূর্ণ কোনো খাতে ব্যয় করার প্রবণতা একেবারে পরিত্যাগ করতে হবে। 

‘বিদেশে পাচারকৃত টাকা দেশে ফিরিয়ে আনাকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অগ্রাধিকার ভিত্তিক কাজের তালিকায় এনে যত দ্রুত সম্ভব, সব রকম তৎপরতা শুরু করতে হবে। বিভিন্ন ইসলামী ব্যাংকসহ সকল ব্যাংকের বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণ উদ্ধারে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।’

খেলাপি কোম্পানিগুলোর স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত ও সম্পত্তি বিক্রি করে হলেও টাকা উদ্ধার করতে হবে বলে মন্তব্য করে অধ্যাপক মুহাম্মদ সাদেক বলেন, ‘যে কোনো মূল্যে শেয়ার বাজারকে স্থিতিশীল করতে হবে। এখন পর্যন্ত যেসব উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, সেগুলো কেন কাজ করছে না; তার কারণ খুঁজে বের করে ত্বড়িৎ সমাধান খুঁজতে হবে। যেভাবেই হোক বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে হবে।’

অনুষ্ঠানে অধ্যাপক নূরুল ইসলাম বলেন, ‘অন্তর্বতীর্কালীন সরকারের সব শুভ উদ্যোগ যেন মার খেয়ে যাচ্ছে দ্রব্যমূল্যের কাছে গিয়ে। যতদ্রুত সম্ভব বাজারকে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আনতে হবে। সব ধরনের সিন্ডিকেট ভেঙে দিতে হবে।

‘বাজারে স্বস্তি ফিরলে অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার কাজে মনযোগ দিতে যথেষ্ট সময় পাবে সরকার। বাজার নিয়ন্ত্রণহীন থাকলে মানুষের আস্থা ধরে রাখা কঠিন হবে।’

অর্থনীতি বিভাগের প্রধান রবিউল করিম বলেন, ‘আমাদের সার্ভে রিপোর্টটি আপনাদের মাধ্যমে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ুক। আমরা আশা করি, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার এই রিপোর্টটিকে আমলে নিলে আগামীতে অর্থনৈতিক খাতসহ বিভিন্ন খাতে সিদ্ধান্ত নিতে সুবিধা হবে।’ 

অন্যান্যের মধ্যে অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন- এইউবি এর বিভিন্ন অনুষদের ডিন, বিভাগীয় প্রধান, শিক্ষকমণ্ডলী এবং জরিপ পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত শিক্ষার্থীরা। 
সমাজকর্ম বিভাগের শিক্ষক জহিরুল ইসলাম জুয়েল অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন।

গত ৮ আগস্ট গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের আকার কয়েক দফায় বেড়ে বর্তমানে এই সরকারে প্রধান উপদেষ্টাসহ ২৪ জন উপদেষ্টা দায়িত্ব পালন করছেন। সবশেষ ১০ নভেম্বর নতুন করে শপথ নিয়েছেন তিনজন উপদেষ্টা।

নির্দিষ্ট দিনক্ষণ এখনও ঘোষণা না করলেও উপযুক্ত সময়ে নির্বাচন আয়োজন করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার; এ জন্য যৌক্তিক সময় দিতে চায় রাজনৈতিক দলগুলো। 

বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ বিভিন্ন দল নির্বাচনমুখী সভা-সমাবেশ করে চলেছে; অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গেও আলোচনা চলছে তাদের। তবে এই মুহূর্তে অন্তর্বর্তী সরকারের গুরুত্বের শীর্ষে রয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার এবং জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে হত্যাকাণ্ডের বিচার প্রক্রিয়া।

এরই মধ্যে সরকারের গঠন করে দেওয়া ছয়টি সংস্কার কমিশন গত সপ্তাহে তাদের কাজের অগ্রগতি সম্পর্কে প্রধান উপদেষ্টাকে অবহিত করেছে; প্রত্যেক কমিশনপ্রধান বলেছেন- বেঁধে দেওয়া তিন মাসের মধ্যেই তারা সংস্কার প্রস্তাব পেশ করবেন।

ঢাকা/সাব্বির/রাসেল


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়