ঢাকা     মঙ্গলবার   ২৩ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  পৌষ ৮ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

‘মরে গেলেও আজই কিস্তির টাকা দিতে হবে’

রাজশাহী প্রতিনিধি || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২২:৫৭, ৫ মে ২০২৫   আপডেট: ২৩:০৩, ৫ মে ২০২৫
‘মরে গেলেও আজই কিস্তির টাকা দিতে হবে’

রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন জহুরুল ইসলাম। পাশে দাঁড়িয়ে তার স্ত্রী নাজমা বেগম

রাজশাহীর পুঠিয়া উপজেলায় একটি এনজিও কর্মকর্তাদের কিস্তির চাপে জহুরুল ইসলাম (৫৫) নামে এক ব্যক্তি বিষপানে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। কিস্তির টাকা সময়মতো পরিশোধ করতে না পারায় জহুরুলকে অপমান করেছিলেন কর্মকর্তারা। সইতে না পেরে এনজিও কার্যালয়ের ভেতরেই বিষপান করেন তিনি। বর্তমানে জহুরুল রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।

পেশায় কোয়েল পাখির ব্যবসায়ী জহুরুলের বাড়ি পুঠিয়া উপজেলার বিড়ালদহ নয়াপাড়া গ্রামে। গত ২৯ এপ্রিল দুপুরে বানেশ্বর বাজার এলাকায় যশোরের এনজিও ‘রুরাল রিকনস্ট্রাকশন ফাউন্ডেশন’ (আরআরএফ)-এর শাখা কার্যালয়ের ভেতরে তিনি বিষপান করেন।

আরো পড়ুন:

পরিবার জানায়, এক বছর আগে ধারদেনা করে ছেলে মো. নাহিদকে মালয়েশিয়ায় পাঠান জহুরুল। সেই টাকা শোধে সাত মাস আগে আরআরএফ থেকে ৩ লাখ টাকা ঋণ নেন তিনি। মাসে কিস্তি প্রায় ৩০ হাজার টাকা। প্রতি মাসে ছেলে টাকা পাঠালে তা দিয়ে কিস্তি দিতেন। চার কিস্তি ঠিকমতো দিলেও সম্প্রতি দুর্ঘটনায় তার ছেলের দুই পা পুড়ে যায়। এ কারণে টাকা পাঠানো বন্ধ হয়ে যায়। কিস্তি বকেয়া পড়ে।

আরআরএফ-এর দুই ক্রেডিট অফিসার-আব্দুর রউফ ও মার্জিয়া খাতুন রাজশাহীর বিনোদপুরে জহুরুলের সদ্য বিবাহিত মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে তাকে অপমান করেন। সেখান থেকে জহুরুলকে ডেকে আনেন বানেশ্বর অফিসে। জহুরুল তখন কিস্তি পরিশোধে মাত্র দুই দিনের সময় চান। কর্মকর্তারা রাজি না হয়ে কটাক্ষ করলে তিনি অভিমানে অফিসের ভেতরেই ঘাষ মারা বিষ পান করেন।

ঘটনার সময় জহুরুলের ভাগ্নে মুকুল হোসেন তাকে উদ্ধার করে রামেক হাসপাতালে নিয়ে যান। তিনি বলেন, “কিস্তি চাইতে গিয়ে এনজিও কর্মীরা বলেন ‘মরে গেলেও আজই কিস্তির টাকা দিতে হবে।’ তখন মামা অফিস থেকে বেরিয়ে বিষ কিনে আনেন। ফিরে এসে বলেন, ‘মানসিক নির্যাতন যদি চলতেই থাকে, তাহলে আমি এখানেই বিষ খাব।’ কেউ পাত্তা না দিলে সেখানেই বিষপান করেন তিনি।”

রামেক হাসপাতালের ১৩ নম্বর ওয়ার্ডে জহুরুলের চিকিৎসা চলছে। সোমবার (৫ মে) সকালে দায়িত্বরত এক চিকিৎসক জানান, তিনি যে বিষপান করেছেন তা ‘প্যারাকোয়াট’ গ্রুপের ঘাষ মারা বিষ। এর কোনো কার্যকর প্রতিষেধক নেই। এমন বিষ শরীরে গেলে মৃত্যুঝুঁকি অনেক বেশি। তারা শুধু সাপোর্টিভ চিকিৎসা দিচ্ছেন।

হাসপাতালে শুয়ে থাকা জহুরুল অস্পষ্টভাবে বলেন, “তিনজনার চাপে বিষ খাই। একটার নাম রউফ, আরেকটা মার্জিয়া। বেটা একসিডেন্ট করছে, দুই পা পুড়ে গেছে। দুই দিনের সময় চাইছিলাম, দেয় নাই। মেয়ের শ্বশুরবাড়িতেও গিয়ে অপমান করছে। আমার সহ্য হয়নি।”

জহুরুলের স্ত্রী নাজমা বেগম বলেন, “মেয়ে শাহিদা খাতুনের শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে এমনভাবে অপমান করা হয় যে, তাতেই ভেঙে পড়েন জহুরুল। এনজিও অফিসে ডেকে নিয়ে গিয়ে তাকে বলা হয়েছিল, মরে গেলেও কিস্তি দিতে হবে। এ কথা শোনার পর আমার স্বামী বিষপান করে মরেই যেতে চান। পরে বাজার থেকে বিষ কিনে নিয়ে গিয়ে অফিসের ভেতর পান করেন।”

অভিযোগ নিয়ে বানেশ্বরের আরআরএফ অফিসে গেলে আঞ্চলিক ব্যবস্থাপক অজয় বিশ্বাস বলেন, “আমাদের লোকেরা বলেছিল, অফিসে বিষপান করবেন না। যা করার বাইরে গিয়ে করেন।” তিনি দাবি করেন, “জহুরুল অফিসে বসে বিষপান করেননি।” এরপর কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি তিনি।

সংস্থার যশোরের প্রধান কার্যালয়ে যোগাযোগ করা হলে নির্বাহী পরিচালক ফিলিপ বিশ্বাস বলেন, “ঘটনার বিষয়ে কিছু জানতাম না। আপনার কাছ থেকেই প্রথম শুনছি। এটা দুঃখজনক ও অপ্রত্যাশিত। আমাদের কেউ জড়িত থাকলে প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

পুঠিয়া থানার ওসি কবির হোসেন বলেন, “বিষয়টি আমরা জানি। জহুরুলের ভাগ্নে জানিয়েছেন। এখন আমাদের কিছু করার নেই। তিনি (জহুরুল) মারা গেলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এনজিওর কার্যক্রম নিয়ে কোনো অভিযোগ থাকলে তদন্ত হতে পারে।”

ঢাকা/কেয়া/মাসুদ

সম্পর্কিত বিষয়:

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়