ঢাকা     শনিবার   ২০ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  পৌষ ৫ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

জীবনের গল্প

মধুমাখা শৈশবের স্মৃতি

জুবায়ের আহমেদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:২৫, ১৩ জুন ২০২০   আপডেট: ১০:৩৯, ২৫ আগস্ট ২০২০
মধুমাখা শৈশবের স্মৃতি

মানুষ মাত্রই স্মৃতিকাতর। অবসর সময়ে পুরনো স্মৃতিচারণ করা এবং নিকটাত্মীয়-বন্ধুদের আড্ডায় মেতে উঠার চেষ্টার কমতি থাকে না আমাদের। কিন্তু বিদ্যমান করোনাভাইরাস সংকটকালীন গৃহবন্দির দিনগুলোতে বাসার কাজ, শিশুদের সময় দেওয়া, টিভি দেখা ও অনলাইনে সময় কাটানোর মাঝেও মনকে হাসিখুশি রাখতে পুরনো স্মৃতিতে হারিয়ে যেতে চাই আমরা সবাই। যাবোই না কেন, আমাদের মধুমাখা শৈশব কৈশোর কেটেছে যে বাঁধভাঙা উল্লাসে। আমরা ভুলতে চাইলেও ভুলতে পারি না শৈশব কৈশোরের দিনগুল। স্মৃতির অ্যালবাম হয়ে তা থেকে যায় সবসময়।

শৈশব নিয়ে কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ স্যার বলেছেন, ‘আমার শৈশবটা কেটে গেছে দুঃখমেশানো আনন্দে-আনন্দে। যতই দিন যাচ্ছে সেই আনন্দের পরিমাণ কমে আসছে। আমি জানি, একসময় আমার সমস্ত পৃথিবী দুঃখময় হয়ে উঠবে। তখন যাত্রা করব অন্য ভুবনে, যেখানে যাবতীয় আনন্দ বেদনার জন্ম’। সত্যিই তাই, আমাদের জীবনে শৈশব কৈশোরের মতো আনন্দ আর নেই।

প্রকৃতির অপরূপ রূপে সজ্জিত গ্রামীণ পরিবেশে আমরা যারা নব্বই দশকের আগে, মাঝখানে বা শেষেও জন্ম নিয়েছি আমাদের শৈশব কেটেছে খালে বিলে মাছ ধরে, বাড়ির পুকুর পাড়ে ও মাঠেঘাটে খেলাধুলা করে। এই বাড়ি, ঐ বাড়িতে ঘুরে টিভি, ভিডিও দেখে। দূরদূরান্তে গিয়ে পালাগান, যাত্রাপালা ও মাহফিল শুনে। দল বেঁধে মক্তবে, স্কুল, মাদ্রাসায় যাওয়া, কৃষি কাজ, ঘুড়ি উড়ানোসহ সবাই মিলে গ্রামীণ খেলা গোল্লাছুট, কাবাডি, দাড়িয়াবান্ধা, কানামাছি, বৌছি খেলেছি। নবান্নের উৎসবে কৃষাণের সাথে দিনে, রাত জেগে বাড়ির উঠানে গরু দিয়ে ধান মাড়িয়েছি, সেসব কাজের অনেক কিছুই এখন প্রযুক্তির ছোঁয়ায় বিলুপ্ত প্রায়। গ্রামীণ সংস্কৃতির অনেক কিছুই বিলীন হয়ে হারিয়ে গেছে কালের গর্ভে।

শৈশবে মাছ ধরা ছিল আমার অন্যতম নেশা। বর্ষা মৌসুমের শুরুতে জোয়ারের পানিতে খাল ভরে জমিতে পাতা পানি (গোড়ালি পর্যন্ত বা তার বেশি) উঠার সময়ে নানার সাথে, মাঝে মাঝে বন্ধুদের সাথে মাছ ধরা শুরু। জমিতে পুডা (সর পুটি) মাছ উঠতো। দেখা মাত্রই ‘কোচ’ ছুড়ে মারতাম মাছের উপর, আরও সহজ পদ্ধতি ছিল পলো (মাছ ধরার জন্য তৈরিকৃত এবং বাড়িতে হাস-মুরগি ঢেকে রাখা হতো এটা দিয়ে) ফেলতাম মাছকে মাঝখানে রেখে, প্রায় সময়ই মাছ ধরে ফেলতাম এভাবে।

বর্ষার শুরুতে ধানি জমির মাঝখানে থাকা খালে নানার সাথে কনুই জাল (ডান হাতের কনুই থেকে ছুড়ে মারা হয়) এবং মাছ রাখার ডেগ নিয়ে যেতাম মাছ ধরতে। রাতের খাবার খেয়ে ৮টার পরই যাওয়া হতো। জোয়ারের স্রোত বুঝে বাঁশের কাটি দিয়ে বিশেষ উপায়ে পুরো খাল জুড়ে ফাঁদ পাততাম, যেখানে খালের নিচে পর্যন্ত যেতো জালের লোহাগুলো। সর পুটি, বোয়ালসহ দেশীয় অনেক মাছ আসতো, স্রোতের সাথে চলে যাওয়ার সময় জালে ধাক্কা খেয়েই লাফ দিতো উপর দিয়ে যেতে, এমনিতেই জালের একটা অংশে (মাছ আটকানোর জন্য তৈরি করা) পরতো মাছগুলো। সেখান থেকে আর লাফ দেওয়ার সুযোগ হতো না, হাত দিয়ে ধরে ফেলতাম সাথে সাথেই। এভাবে চলতো জমিতে পুরোপুরি পানি আসার আগ পর্যন্ত।

বর্ষাকালে ছিলো মাছ ধরার আরেক কৌশল। ফসল ছাড়া জমিতে ৩০-৪০ ফুট বা তারও বেশি লম্বা লাইলন সুতাতে এক হাত পরপর এক-দেড় হাত সুতার মাথায় বরশী লাগিয়ে মাছের আধার দিয়ে টোপ ফেলতাম। সেই সাথে ধানি জমি কিংবা ধইঞ্চাসহ অন্য ফসলী জমির মাঝে মাঝে লার পাততাম, তাও কচুরি পানার কঞ্চি কিংবা ধইঞ্চা দিয়ে তৈরি হাতলের মাঝে এক-দেড় হাত সুতায় বরশী লাগিয়ে জির-আটা দিয়ে টোপ ফেলতাম, বরশী পানির নিচে থাকতো, কচুরিপানা বা ধইঞ্চার হাতল ভেসে থাকতো পানির উপর। যেখানে কয়েক ঘণ্টা পরপর দেখতাম মাছ লাগছে কি না। মধ্যরাতে দেখে এসে, ঘুমিয়ে পুনরায় সকালে গিয়ে দেখতাম। মাছের পাশাপাশি প্রায় সময় শাপ, কুইঞ্চাও লাগতো বরশীতে। সেই সাথে কারেন্ট জাল পেতেও মাছ ধরা হতো।

বর্ষার শুরু বা শেষের দিকে চাঁই ও আন্টা দিয়ে মাছ ধরা হতো। যেগুলোতে মাছ ঢুকতে পারলেও বের হতো পারতো না। অনেকেই আবার ধর্মজাল ও খড়জাল দিয়ে মাছ ধরতো, যারা ছিলো নিয়মিত মৎস শিকারি। সমবয়সী মেয়েরাও সামিল হতো মাছ ধরায়। বয়ষ্ক মহিলারাও মাছ ধরতো তখন।

মাছ ধরা ছাড়াও পানিতে গোসল করা, শাপলা-শালুক তোলা কিংবা ঘুরতে যাওয়া তো ছিলই। পুরো বর্ষা এভাবেই কাটতো। বর্ষা শেষে আবারও মাছ ধরার নতুন উপায়। পানি চলে যাওয়ার পর কিছু ঢালু জমিতে পানি লেগে থাকতো, যেখানে আটকে থাকতো নানা প্রজাতির দেশি মাছ। যেগুলো হাত দিয়ে ধরতাম চারদিক থেকে বাধ তৈরি করে। সেই সাথে জমি থেকে পানি খালে নেমে যাওয়ার পর মইয়া জাল, পেলুন দিয়ে গুড়ো মাছ ধরতাম বন্ধুদের সঙ্গে। বড় বড় ডেকচি ভরে নিয়ে আসতাম মাছ দিয়ে।

মাছ ধরার সাথে জ্বিনের (কাল্পনিক শয়তান) ঘটনাও কম ঘটেনি। অন্যদের থেকেও শুনেছি অনেক। গ্রামে বা শহরেও প্রচলিত আছে সন্ধ্যার পর থেকে মাছের উপর জ্বিন ভর করে। সেই সাথে মাঝরাতে মাছ ধরতে গেলে কত ধরনের অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটত।

ছোটবেলায় জমির মাঝখানে গাছ দেখলেই ভাবতাম ভূত প্রেত, জ্বিন থাকে এগুলোতে। দিনের বেলায়ও অনেক সময় কাছ দিয়ে যেতাম না। রাতের বেলায় মাছ ধরতে গেলে দেখতাম গাছের উপর আগুলের উল্কা পরছে। কি যে ভয় পেতাম তখন, বলার মতো না।

এক সময় ভয় কেটে যায়। দিনের বেলায় জমির মাঝখানে গেলে গাছে উঠতাম। বসে আড্ডা দিতাম। তবে কাক, ঈগলের বাসা থাকতো অনেক। জমির মাঝখানে একটা গাছ মানে, রোদে পুড়ে কাজ করা কৃষকদের রোদকে ফাঁকি দিয়ে একটু শান্তির পরশ পাওয়া। বাড়ি থেকে নেওয়া খাবারগুলো গাছের ছায়ায় বসে খাওয়া।

আগে দূরদূরান্তে হেঁটে যেতে হতো। শৈশবে নানার সাথে কত হেঁটেছি বলার মতো না। কয়েক মাইল পথ হেঁটে যেতাম আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে, বড় বাজারে। রাস্তায় এমন গাছ থাকলে জিরিয়ে নিতাম কয়েক মিনিট। বর্ষাতেই একটু রেঁহাই হতো, ট্রলার বা নৌকায় যাতায়ত করা যেতো।

গাছ মানুষকে ছায়া দেয়, প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা করে। জমির মাঝে এসব গাছ কেউ পরিকল্পিতভাবে রোপন না করলেও কোনো না কোনোভাবে গাছগুলো বেড়ে ওঠে মানুষকে ছায়া দিতে, পাখিদের ঘর বেঁধে থাকার সুবিধা দিতে।

এখনতো এক কিলোমিটারও হাঁটা হয় না, ব্যতিক্রম কিছু না হলে। গ্রামে গেলেও জমিতে যাওয়া হয় কম। আবার জমির মাঝখান দিয়ে কাঁচা পাকা রাস্তা নির্মাণের মাধ্যমে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতিকরণ করা হচ্ছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে পাল্লা দিয়ে কৃষি জমি বাড়িতে রূপান্তর হচ্ছে। তাই সড়ক ফেলে জমির আইল ধরে আর হাঁটা হয় না। গ্রামে গিয়ে সব পেলেও সবকিছুতে আধুনিকায়ন ও মানুষের বসবাসের জন্য বাড়ি নির্মাণের ফলে শৈশবের মতো করে আর কিছু উপভোগ, অনুভব করা যায় না।

নদী, নালা, খাল-বিল ভরাট, কৃষি জমিতে বাড়ি তৈড়ি ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এখন বর্ষাকালে আমাদের কুমিল্লার অনেক অঞ্চলেই ঠিকমতো পানি হয় না। গত ১৫ থেকে ২০ বছর আগের মতো মাছও পাওয়া যায় না এখন। ছেলেরা এখন এতটাই প্রযুক্তি নির্ভর যে তাদের অনেকের সময়ও হয় না গ্রামীণ সংস্কৃতিতে মিশে যাওয়ার। অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নয়নের কারণেও এখন অনেকে টাকা খরচ করে সব করতে চায়, নিজ হাতে প্রয়োজনীয় কাজ করার সময় কোথায়।

শিশু কিশোরদের লেখাপড়ার জন্য এখন নতুন চাপ। ভালো রেজাল্টের ভাবনা মাথায় ঢুকিয়ে দিয়ে তাদের দুরন্তপনার শৈশব কৈশোরকে নষ্ট করে দেওয়া হচ্ছে। কেউ কেউ চাপ সইতে না পেরে আত্মহত্যা করছে। ভালো রেজাল্ট করলেও এরা অথচ সর্বশেষ নব্বই দশকের এবং তারও আগে জন্ম নেওয়া শিশুরাই আজকে দেশের প্রতিটি মাধ্যমে প্রতিনিধিত্ব করছে।

সরকারি, বেসরকারি চাকরিজীবী, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, বিজ্ঞানী, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, জজ, ব্যারিস্টার, অ্যাডভোকেট, সাংবাদিক, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব, শিল্পী, লেখক, কবি সাহিত্যিকসহ সব গুণীজনরাই গ্রামীণ পরিবেশে তাদের শৈশবকে রাঙিয়ে এসেছেন। সেসব সময় মনে পড়লেই সুখের অনুভূতি তৈরি হয় আমাদের মনে। আর মন বলে ‘ইশ, আবার যদি শৈশবে ফিরে যেতে পারতাম’! 

লেখক: শিক্ষার্থী, ডিপ্লোমা ইন জার্নালিজম, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব জার্নালিজম অ্যান্ড ইলেকট্রনিক মিডিয়া (বিজেম)।


বিজেম/হাকিম মাহি

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়