ঢাকা     রোববার   ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  অগ্রহায়ণ ২৯ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

বাকৃবির ছাত্র রাজনীতি: কেড়ে নিয়েছে ১৬টি তাজা প্রাণ

মো. লিখন ইসলাম, বাকৃবি || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:৪৩, ১০ আগস্ট ২০২৪  
বাকৃবির ছাত্র রাজনীতি: কেড়ে নিয়েছে ১৬টি তাজা প্রাণ

কৃষি শিক্ষা ও গবেষণার ব্রত নিয়ে ময়মনসিংহের পুরনো ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ে গড়ে ওঠা দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম সেরা বিদ্যাপিঠ বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি)। দেশের অন্যতম পুরোনো বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ায় ছাত্র রাজনীতিতে সরব ছিল এটি। এখানে ছাত্র রাজনীতির নামে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে অকালেই ঝরে গেছে ১৬টি তাজা প্রাণ। তবে এখনো একটি হত্যাকাণ্ডেরও বিচার হয়নি।

নিহতদের সবাই একজন দক্ষ কৃষিবিদ হওয়ার স্বপ্ন নিয়েই এ সবুজ ক্যাম্পাসে পা রেখেছিলেন। সে সঙ্গে মা-বাবাও ছেলের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের আশায় বুক বাঁধতেন। কিন্তু লেজুড়বৃত্তিক দলীয় ছাত্র রাজনীতির করাল গ্রাসে হারিয়ে গেছে সব স্বপ্ন।

সম্প্রতি ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর স্বাধীন দেশে ছাত্র রাজনীতির নামে অপরাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি জানিয়েছেন বাকৃবির শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষকও একই দাবি জানিয়েছেন।

শুধু ১৬ জন শিক্ষার্থীরই নয়, ১৬টি পরিবারের সেই স্বপ্ন বিধ্বস্ত করেছে ছাত্র রাজনীতি। মায়ের চোখের পানি হয়তো শুকিয়ে গেছে। কিন্তু হৃদয়ের রক্তক্ষরণ আজও অঝোর ধারায় বইছে। শেষ সান্ত্বনা ছেলের হত্যাকারীদের সুষ্ঠু বিচার হয়তো পাবেন। সময়ের পরিক্রমায় সে আশায় গুড়ে বালি। অনেক তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন আজও আলোর মুখ দেখেনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের এসব হত্যাকারীদের কোনো বিচার নেই? তারা কি আইনের ঊর্ধ্বে? এমন প্রশ্ন আজ সুধী সমাজের।

বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, স্বাধীনতার পর ছাত্র রাজনীতির জেরে বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘর্ষ হয়েছে শতাধিকবার। এতে নিহত হয়েছেন ১৬ জন এবং আহত হন সহস্রাধিক। প্রথম নিহতের ঘটনা ঘটে ১৯৭৩ সালে। কর্মচারী-শিক্ষক-ছাত্র সংঘর্ষে প্রথম নিহত হন রঞ্জিত। এরপর থেকে শুরু হয় হত্যার রাজনীতি। টানা ১০ বছরের শান্ত ক্যাম্পাস উত্তপ্ত হয় ১৯৮৩ সালে। ওই বছর ছাত্রদল নেতা এটিএম খালেদ নিহত হওয়ার জেরে প্রতিপক্ষের বুলেটে নিহত হন ছাত্রলীগ ও বাকসুর নেতা শওকত, ওয়ালী ও মহসিন।

আরও ১০ বছর পর ১৯৯৩ সালে টেন্ডারবাজি, সিট দখল, বাজেট বণ্টন ও অভ্যন্তরীণ কোন্দলে নিহত হন রেজাউর রহমান সবুজ। ১৯৯৪ সালে কর্মচারীর কলেজ পড়ুয়া ছেলে, ১৯৯৫ সালে বাকসু নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আলাউদ্দিন, শওকত, কবির ও হাসান নামে চার শিবিরকর্মী এবং ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে নিহত হন কামাল ও রণজিৎ নামে দুই ছাত্রলীগ কর্মী। অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি ক্ষমতায় এলে ছাত্রদল চার গ্রুপে বিভক্ত হয়ে যায়। তাদের অন্তর্কোন্দলে ২০০১ সালে নিহত হন ছাত্রদল নেতা হাসু।

২০১৩ সালের ১৯ জানুয়ারি নিয়োগ বাণিজ্য, অর্থ ভাগবাটোয়ারা ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে বাকৃবি ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক গ্রুপের গোলাগুলিতে নিহত হয় বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন এলাকার ১০ বছর বয়সী শিশু রাব্বী। এ ঘটনায় ছাত্রলীগের বাকৃবি শাখা বিলুপ্ত ঘোষণা করে কেন্দ্রীয় কমিটি। সর্বশেষ ২০১৪ সালের ১ এপ্রিল নিজ সংগঠনের নেতাকর্মীদের পিটুনিতে মারা যান মাৎস্যবিজ্ঞান অনুষদের শেষ বর্ষের ক্লাস প্রতিনিধি আশরাফুল হক এবং হল শাখা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সায়াদ ইবনে মোমতাজ (সাদ)। 

বাকৃবির এই ১৬টি রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের একটিরও বিচার পায়নি কোনো পরিবার। হদিস নেই তদন্ত রিপোর্টেরও।

সাধারণ শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করেন, দলীয় লেজুড়বৃত্তির কারণে ছাত্র রাজনীতি সাধারণ ছাত্রদের দাবি-দাওয়া নয়, দলীয় এজেন্ডা বাস্তবায়নে কাজ করছে। ফলে ক্যাম্পাসের সবুজ চত্বর সহপাঠীদের রক্তে রঞ্জিত হচ্ছে। বর্তমানে ছাত্র রাজনীতির নামে চলমান অপরাজনীতির ফলেই এসব হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ক্যাম্পাসে দলীয় লেজুড়বৃত্তির ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি তুলেছেন অনেকে। কেউ কেউ বলছেন নিষিদ্ধ নয়, দরকার সংস্কার। শিক্ষক রাজনীতির ফলে শিক্ষকেরাও সরকার দলীয় ছাত্র নেতার অপকর্মের বিরুদ্ধে কোনো ভূমিকা রাখতে পারেন না।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেটেরিনারি অনুষদের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী শামসুন নাহার অয়ন্তী বলেন, ছাত্র রাজনীতিতে ব্যক্তিস্বার্থ প্রাধান্য পায়। গত ক্ষমতাসীন দল সেটা বহুলাংশে প্রমাণ করে দিয়ে গেছে। ঠিক এই কারণে আমরা সাধারণ শিক্ষার্থীরা ছাত্র রাজনীতির বিরুদ্ধে। আমরা আশঙ্কা করি সামনের দিনগুলোতেও কিছু স্বার্থান্বেষী মহল ছাত্র রাজনীতির ছায়াতলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের উপর জুলুম করবে। আর শিক্ষার্থীদের ন্যায্য দাবি আদায়ের জন্য কোনো রাজনৈতিক ট্যাগের প্রয়োজনীয়তা নেই, কোটা সংস্কার আন্দোলন তার জ্বলজ্যান্ত প্রমাণ। আমরা সবাই একটি বৈষম্যহীন ও সাম্যবাদী ভবিষ্যতের আশা রাখি। 

বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যানাটমি ও হিস্টোলজি বিভাগের প্রভাষক মোছা. লতিফা আক্তার বলেন, আমি নিজেও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রাজনীতি চাই না। আমি ক্লাসে শিক্ষার্থীদের মাঝেও সবসময় সেটা প্রমোট করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু পরিস্থিতি এমন ছিল যে, বাধ্য হয়ে অনেক শিক্ষার্থী রাজনীতি করতো। এই একই বিষয় আবার জুনিয়র শিক্ষকদের ক্ষেত্রেও আছে, ইচ্ছে না থাকলেও শিক্ষকদের বিভিন্ন রাজনৈতিক গ্রুপে নাম লিখাতে হয়। কিন্তু সবকিছু দেখার পর আমার সবসময় এটাই মনে হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র, শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী কোনো রাজনীতিই থাকা উচিত না। কারণ শিক্ষা ও গবেষণার পরিবেশ এতে ব্যাপকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হয়। অনেক ছাত্রছাত্রীর ক্যারিয়ার ধ্বংস হয়ে যায় এই রাজনীতির জন্য এবং শিক্ষকদের মান মর্যাদা নষ্ট হয়। 

/মেহেদী/

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়