শিক্ষকদের পদত্যাগে বাধ্য করা কতটুকু যৌক্তিক?
ফারজানা ইসলাম || রাইজিংবিডি.কম
বহুল প্রচলিত একটি প্রবাদ ‘শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড’। আর এই মেরুদণ্ডকে শক্তিশালী করার পিছনে সবচেয়ে বড় অবদান আমাদের শিক্ষক সমাজের। অন্যভাবে বলতে গেলে, জাতি গঠনের কারিগর বলা হয় শিক্ষক সমাজকে।
তবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিজয় লাভের পরপরই আমরা কিছু নেতিবাচক ঘটনার সম্মুখীন হই। দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও স্কুলগুলোতে জোরপূর্বক পদত্যাগ করানো হচ্ছে শিক্ষকদের।
আমরা সবাই জানি, মানুষ ভুলের ঊর্ধ্বে নয়। আমাদের সম্মানিত শিক্ষকদেরও ভুল-ত্রুটি থাকতেই পারে। তার প্রেক্ষিতে তাদের হেনস্তা করা বা জোরপূর্বক পদত্যাগ করানোর অধিকার আপনার বা আমার কারো নেই। শিক্ষক সমাজের কারো যদি কোনো প্রকার দুর্নীতি কিংবা অনিয়মের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত হয়, সেটা দেখার জন্য দেশের নিরপেক্ষ প্রশাসন বিদ্যমান।
বেশ কিছুদিন হলো বিভিন্ন গণমাধ্যমে একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। যেখানে দেখানো হচ্ছিলো, কোনো এক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষককে জোরপূর্বক পদত্যাগ করানো হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের জোরাজুরির ফলে শিক্ষক পদত্যাগ পত্রে স্বাক্ষর করার সময় স্ট্রোক করেন। ভিডিওটি দেখার পর একজন শিক্ষার্থী হিসেবে আমি লজ্জিত।
শিক্ষক সমাজে যে কোটি কোটি টাকা লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে, এমনটিও নয়। শিক্ষার্থীদের এমন আচরণের মূল কারণ হলো, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের সহায়তা পাননি, যেমনটি তারা চেয়েছিলেন। তাদের একটি ভুলের জন্য আমরা শিক্ষার্থীরা এটা ভুলে গেলে চলবে না, আমাদের জীবন গঠনের পথে হাজারো ভুল-ভ্রান্তি নিমিষেই ক্ষমা করে দিতেন এ শিক্ষকরাই। আজ যারা শিক্ষকের হাতে কলম তুলে দিচ্ছেন পদত্যাগ পত্রে স্বাক্ষর করানোর জন্য, একদিন এই শিক্ষকই আপনাদের হাতে কলম তুলে দিয়েছিলেন জীবনকে সুন্দর ভাবে গড়ে তোলার জন্য।
অন্যান্য অনেক পেশায় যেমন মাস শেষে মোটা অংকের বেতন ঘরে আসে, শিক্ষকতা পেশার ক্ষেত্রে তা নয়; একদমই আলাদা। আমাদের দেশে সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তুলনায় বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা অনেক বেশি। সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা সময় মতো বেতন পেলেও বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা বেতন পান প্রায় মাসের শেষ দিকে। এমনটিও নয় খুব মোটা অংকের বেতন পান তারা।
বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে এমন অনেক শিক্ষক আছেন যারা এখনো বিনা বেতনে পাঠদান করান। নামমাত্র সম্মানী দেওয়া হয় তাদের। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে শিক্ষকদের সম্মান ও বেতন দুটোই অনেক বেশি। কিন্তু আমাদের দেশে সবকিছুর দাম বাড়লেও বাড়তে চায় না শিক্ষকের বেতন।
আর যদি আসে সম্মানের কথা, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শিক্ষকতা বাদে সব পেশার মানুষই কি ছাত্রদের সাহায্য করেছিল? উত্তর হবে- না। তাহলে আজ এতো অসম্মান আর হেনস্তার শিকার কেনো শুধু শিক্ষক সমাজই হবে?
এখন অনেকেই বলতে পারেন, ছাত্রদের অধিকার আদায়ের বিষয়গুলো শিক্ষকরা যেভাবে বুঝবেন, অন্যান্য পেশার মানুষরা সেভাবে নাও বুঝতে পারেন। আমিও মেনে নিচ্ছি, এটি শিক্ষকদের ভুল। তবে তাদের এ ভুলের জন্য এখন শিক্ষার্থীদের নেওয়া পদক্ষেপগুলো কি সঠিক? না সঠিক নয়।
আমাদের যাদের পরিবারে বাবা-মা, ভাই-বোন বা অন্যান্য আত্মীয়-স্বজন শিক্ষকতা পেশার সঙ্গে নিয়োজিত, শুধু তারাই বলতে পারবেন- ওই সময়ে তাদের কতটা চাপের মধ্যে রাখা হয়েছিল। এখন এখানেও প্রশ্ন উঠতে পারে যে, তাহলে যে শিক্ষকরা সাহায্য করেছিলেন তাদের চাপে রাখা হয়নি? হ্যাঁ, তাদেরও চাপে রাখা হয়েছিল।
তবে যাদের মনে এই প্রশ্ন আসবে, তাদের কাছে আমার একটি প্রশ্ন রেখে গেলাম- বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে কি সব ছাত্র-ছাত্রীরা অংশগ্রহণ করেছিলেন? উত্তরটা হবে- না। সকল ছাত্র-ছাত্রী অংশগ্রহণ করেননি। তাহলে যে সব শিক্ষার্থীরা অংশগ্রহণ করেননি, তারা কি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন বিরোধিতা করেছেন? এটিরও উত্তর হবে- না। তারা বিরোধিতাও করেনি, আবার আন্দোলনে অংশগ্রহণও করেননি। কারণ হতে পারে পরিবারিক চাপ বা তাদের ব্যক্তিগত দায়বদ্ধতা। তাহলে শিক্ষকদের ক্ষেত্রে কেনো এর বিকল্প হবে?
প্রকৃতপক্ষে একজন শিক্ষকের জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি, তার শিক্ষার্থীদের থেকে প্রাপ্ত সম্মান। এই সম্মানটুকু নিয়েই তারা বাঁচতে চায়। আর আজ আমরা শিক্ষার্থীরা যদি তাদের সেই সম্মানটুকুই না দিতে পারি, তাহলে আমরা শুধু শিক্ষার্থী হিসেবেই নই, জাতি হিসেবেও লজ্জিত। তাই শিক্ষার্থীদের উচিৎ, আমাদের শিক্ষকদের দায়বদ্ধতা বুঝে তাদের প্রতি মনঃক্ষুণ্ন না হয়ে সম্মানের জায়গাটি ফিরিয়ে দেওয়া এবং তাদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া।
লেখক: শিক্ষার্থী, সমাজকর্ম বিভাগ, রাজশাহী কলেজ, রাজশাহী
/মেহেদী/