ঢাকা     রোববার   ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  অগ্রহায়ণ ৩০ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

মধ্যপ্রাচ্যে ক্ষমতার ভারসাম্যের পালাবদল ও তুরস্কের উত্থান

রুশাইদ আহমেদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২১:৩৩, ২১ ডিসেম্বর ২০২৪  
মধ্যপ্রাচ্যে ক্ষমতার ভারসাম্যের পালাবদল ও তুরস্কের উত্থান

সিরিয়ায় আসাদ সরকারের পতন, ইরানের শিয়া কর্তৃত্বের অবসান ও তুরস্কের পূর্ণচন্দ্রের উত্থানের মধ্য দিয়ে আফ্রিকা শৃঙ্গ থেকে শুরু করে আফগানিস্তান পর্যন্ত ভূরাজনৈতিক দৃশ্যপট পাল্টে দিয়েছে। কারণ তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেব এরদোয়ান সমর্থিত সিরিয়া বিদ্রোহীরা অঞ্চলটির অন্যদের ওপর প্রভাব বিস্তার করে আঙ্কারাকে আঞ্চলিক পাওয়ার হাউজে উন্নীত করেছেন।

সিরিয় বিদ্রোহীদের বিস্ময়কর বিজয়ে তুরস্ক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে বুদ্ধিবৃত্তিক দিকনির্দেশনা ও রাজনৈতিক সমর্থন দেওয়ার মাধ্যমে। ফলে গত ১৩ বছরের মধ্যে এবার কোনো সহিংস ধ্বংসযজ্ঞ ছাড়াই অভিযান শুরু হয়েছে।

সিরিয় সংঘাত শুরুর বছরগুলোতে কিছু দেশ বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোকে বিচ্ছিন্নভাবে সমর্থন করলেও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের বিদ্রোহীদের প্রতি তুরস্কের অঙ্গীকার বজায় ছিল ধারাবাহিকভাবে। ২০১৯ সালে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পর বিদ্রোহীরা যেন পুনরায় সশস্ত্র ও সংগঠিত হতে পর্যাপ্ত স্থিতিশীল পরিবেশ পায়, সেটা তুরস্ক নিশ্চিত করেছে।

লেবানন ও সিরিয়ায় হিজবুল্লাহ এবং ইরান-সমর্থিত গোষ্ঠীগুলোর ওপর ইসরায়েলি হামলা অব্যাহত থাকায় ইরান লোকবল ও সহায়তা সরবরাহ করতে পারেনি। এতে আসাদ শাসনের পতন অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছিল। অন্যদিকে, রাশিয়া ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধে ব্যস্ত থাকায় তারা আসাদকে খুবই সীমাবদ্ধ সহায়তা করতে পেরেছিল।

তুরস্কের এ সফলতার প্রভাব প্রতিবেশী রাষ্ট্র ইরাকেও পড়তে পারে। দেশটির উত্তরাঞ্চলে তুরস্ক দীর্ঘদিন ধরে ইরাকি কুর্দিদের সহায়তায় নিজেদের উপস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টিকে (পিকেকে) লক্ষ্যবস্তু বানিয়েছে। সিরিয়ায় সুন্নি নেতৃত্বাধীন সরকারের উত্থান ইরাকের সুন্নি-অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে তুরস্কের হাতকে আরও শক্তিশালী করবে, যা ২০১৯ সালে ইসলামিক স্টেটের পতনের পর থেকে ইরান সমর্থিত শিয়া মিলিশিয়াদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। ইরাক থেকে ইরানের এ ধারাবাহিক প্রভাব নিশ্চিহ্ন হওয়ার ঘটনা সিরিয়ায় পরিবর্তন আসার দৃশ্যকে প্রতিফলিত করে।

আঙ্কারার এ ধরনের উচ্চাকাঙ্ক্ষা সিরিয়া ও ইরাক ছাড়িয়ে আফ্রিকা, ককেশাস ও মধ্য এশিয়ায় পৌঁছে গেছে। সিরিয়ায় বিদ্রোহীদের জয়ের চারদিন পরেই তুরস্কের অন্যতম দুই মিত্র ইথিওপিয়া এবং সোমালিয়ার মধ্যকার আঞ্চলিক দ্বন্দ্ব নিরসনে চুক্তি স্বাক্ষরে এরদোয়ান মধ্যস্থতা করেছেন। এ ছাড়া, লিবিয়ার জাতিসংঘ স্বীকৃত সরকারকে সামরিক সহায়তা দেওয়াসহ দেশটির ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে শক্তিশালী প্রভাব নিশ্চিতের সঙ্গে সঙ্গে উত্তর আফ্রিকার গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

২০২১ সালে তালেবান ক্ষমতায় ফেরার পর আফগানিস্তানের পূর্বে ইরান সীমান্তেও আঙ্কারার প্রভাব বৃদ্ধি পেয়েছে। পাশাপাশি ২০২০ সালে আর্মেনিয়ার বিরুদ্ধে নাগোরনো-কারাবাখ যুদ্ধে আজারবাইজানকে সামরিক ও কূটনৈতিক সহায়তা দিতে ইরানের উত্তরাঞ্চলীয় সীমান্তে ককেশাস অঞ্চলে তুরস্ক নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়ে পরিণত করেছিল।

তুরস্কের এ উত্থান আঞ্চলিক শক্তিচর্চাকে আরও জটিল করে তুলেছে, বিশেষত সৌদি আরব ও তাদের জোটের জন্য। তবে তুরস্কের সুন্নি পরিচয়কে আরও চ্যালেঞ্জিং করার মাধ্যমে ইরানের শিয়াপন্থী পরিচয় তাকে সুস্পষ্ট প্রতিদ্বন্দ্বী করে তুলেছে ।

ইরানের শিয়া প্রভাব মোকাবেলা করতে সৌদি আরব দীর্ঘদিন ধরে নিজেকে সুন্নি মুসলিম বিশ্বের নেতা হিসেবে দাবি করে আসছে। কিন্তু তুরস্কের উত্থান এ ভাষ্যকে বিঘ্নিত করছে। উপরন্তু, আঙ্কারার ইসলামপন্থী নীতিমালা সুন্নি মুসলিম এবং রাজনৈতিক ইসলামপন্থীদের একটি বিরাট অংশকে উপসাগরীয় রাজতন্ত্রের বিকল্প হিসেবে দাঁড় করাতে প্রভাবিত করছে।

দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে ইরানের শিয়া অর্ধচন্দ্র মধ্যপ্রাচ্যে দেশটির আধিপত্যবাদী উচ্চাকাঙ্ক্ষার প্রতীক হিসেবে টিকে আছে। তেহরান থেকে ভূমধ্যসাগর করিডোর পর্যন্ত হিজবুল্লাহর মতো প্রক্সি গোষ্ঠী শক্তি প্রদর্শনের মাধ্যমে ইরানকে সৌদি আরব ও ইসরায়েলের হুমকি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। ২০১৯ সালের মধ্যে চার আরব রাজধানী— বাগদাদ, দামেস্ক, বৈরুত ও সানায় ইরান তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে। তবে এ অতিরিক্ত কৌশলগত সম্প্রসারণের মূল্য হিসেবে তেহরানকে ক্রমবর্ধমান আত্মবিশ্বাসী তুরস্ক এবং আগ্রাসী ইসরায়েলের সামনে দুর্বল করে তুলেছে।

আজ সেই অর্ধচন্দ্র ভেঙে পড়ছে। সিরিয়ায় বিদ্রোহীদের বিজয় এবং তুরস্কের ক্রমবর্ধমান প্রভাব লেবাননের সঙ্গে ইরানের স্থলপথের সংযোগকে ছিন্ন করেছে, যা তাদের সরবরাহ লাইন ব্যাহত করছে এবং প্রক্সিগুলোকে বিচ্ছিন্ন করছে। এ পতন লেবাননেও প্রতিফলিত হচ্ছে, যেখানে হিজবুল্লাহর আধিপত্য ক্রমবর্ধমান অভ্যন্তরীণ সংকট এবং ইসরায়েলের ধারাবাহিক সামরিক চাপে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। ইরানের ক্ষতি ও তুরস্কের লাভ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। কারণ দামেস্ক প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে ইরানের মিত্র থাকলেও এখন তুরস্কের মিত্রে পরিণত হচ্ছে।

ফলে আগামী বছরগুলোতে এ অঞ্চলের ক্ষমতার লড়াই আর ইরানের আকাঙ্ক্ষার ছায়াকে কেন্দ্র কর আবর্তিত হওয়ার পরিবর্তে তুরস্কের পরিসরকে কেন্দ্র করে ঘুরবে। তুরস্ক অঞ্চলটি দখল করবে কি-না এ প্রশ্ন প্রতিদ্বন্দ্বী ও মিত্র উভয়ের কাছেই আর হবে না।

মূল: হাসান হাসান, নিউ লাইনস ম্যাগাজিনের প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী সম্পাদক

(দ্য গার্ডিয়ান থেকে সংক্ষিপ্তাকারে ভাষান্তর করেছেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী রুশাইদ আহমেদ)
 

ঢাকা/মেহেদী

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়