ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

মুক্তিযুদ্ধের মঞ্চনাটক

  মেসবাহ য়াযাদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:৩৭, ২৫ ডিসেম্বর ২০২০   আপডেট: ১২:১১, ২৬ ডিসেম্বর ২০২০
মুক্তিযুদ্ধের মঞ্চনাটক

আমাদের মঞ্চ নাটকের কথা বলা যাক। মঞ্চ নাটকে প্রতিনিয়ত উঠে এসেছে স্বাধীনতাকে অর্থবহ করার প্রত্যয়। মঞ্চের সামনে এবং পেছনে যে মানুষগুলো কাজ করছেন, তাদের অনেকেই সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। অনেকে আবার সরাসরি যুদ্ধে যেতে না পারলেও বিভিন্নভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য-সহযোগিতা করেছেন। যারা ট্রেনিং নিতে কলকাতা গিয়েছিলেন, তাদের অনেকে কলকাতা অবস্থানকালে দেখেছেন, সেখানকার মঞ্চের পরিবেশনাগুলো। নতুন ধারণা এবং নতুন ধরনের পরিবেশনায় নিজেরা সমৃদ্ধ হয়েছেন।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর, যুদ্ধ শেষ করে দেশে ফিরে এরা সবাই মন দিয়েছেন মঞ্চ নাটকের সংস্কার সাধনে। ফলে মঞ্চনাটকে সৃষ্টি হয়েছে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি নিয়ে নাটক। ১৯৭১ সাল থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধকে অবলম্বন করে প্রায় অর্ধশতাধিক নাটক মঞ্চায়িত হয়েছে। এসব নাটকের কাহিনিতে এসেছে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধ, রাজাকার-আলবদরদের সহযোগিতায় পাক বাহিনীর হাতে নারী ধর্ষণ, স্বাধীনতা পরবর্তী রাজাকারদের উত্থান, বাঙালির বীরত্বগাথা, রাজাকার-আলবদর-আল শামস তথা পাক নরপশুদের হাতে বুদ্ধিজীবী হত্যাসহ অমানবিক আর নিষ্ঠুরতার নানান চিত্র।

দেশ স্বাধীন হবার পর শিল্পের সবচেয়ে বেশি উৎকর্ষ সাধিত হয়েছে মঞ্চ নাটকে। তেমনিভাবে হয়নি চলচ্চিত্র বা সাহিত্যে। ১৯৭২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তঃহল নাট্য প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা-উত্তর আমাদের মঞ্চ নাটকের ভ্রুণের সঞ্চার হয়। সেই প্রতিযোগিতার একটি বড় শর্ত ছিল- নাটকের পাণ্ডুলিপি দলের নিজস্ব নাট্যকারের লেখা হতে হবে। বিশেষ এই শর্তের কারণেই বদলে গিয়েছিল প্রতিযোগিতার চেহারা। সেই প্রতিযোগিতা থেকে আমরা পেয়েছি বেশ কয়েকজন নাট্যকার, নাট্য নির্দেশক ও অভিনেতাকে। এঁদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন- ম হামিদ, সেলিম আল দীন, আল মনসুর, হাবিবুল হাসান, নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু, রাইসুল ইসলাম আসাদ, পিযূষ বন্দোপাধ্যায়। বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক নাট্য-চর্চায় বেরিয়ে আসা এই সব মানুষদের পাশাপাশি নাটকে নিবেদিত প্রাণ আরও অনেকে ছিলেন। যাঁরা স্বাধীনতার অনেক আগে থেকেই নাটকের সাথে নানাভাবে যুক্ত ছিলেন।  বাংলার মঞ্চ নাটকের সেসব গুণী মানুষেরা হচ্ছেন- আব্দুলাহ আল মামুন, মমতাজ উদ্দিন আহমেদ, মামুনুর রশীদ, আলী যাকের, রামেন্দু মজুমদার, ফেরদৌসী মজুমদার, আতাউর রহমান, শিমুল উইসুফ, নাজমা আনোয়ার, সারা যাকের প্রমুখ। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে এঁদের হাত ধরেই গড়ে উঠে গ্রুপ থিয়েটারের চর্চা।

এটা সত্যি যে, বাংলা নাটকের ইতিহাস হাজার বছরের। কিন্তু বাংলাদেশের নাট্যচর্চা মানে গ্রুপ থিয়েটার-এর শুরু হয় ১৯৭২ সালে, স্বাধীনতার পরে। নাটকের পাশাপাশি জন্ম দেয় বিনা পারিশ্রমিকে পেশাদারী থিয়েটারের ধারা। সে সময় ঢাকায় অনেকগুলো নাট্যদল সৃষ্টি হয়। তারমধ্যে থিয়েটার, আরণ্যক, নাগরিক, নাট্যচক্র, ঢাকা থিয়েটার অন্যতম। একাত্তরের আমাদের মুক্তিযুদ্ধ জয় বিশেষ এক ভূমিকা রাখে বাংলাদেশের থিয়েটারে। সেই সময় গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলনের জোয়ার বয়ে যায় ঢাকার মঞ্চে। এর আরেকটি কারণ, গ্রুপ থিয়েটারে বেশীরভাগ নাট্যযোদ্ধাই ছিলেন প্রত্যক্ষ মুক্তিযোদ্ধা। স্বাধীনতার স্বপ্ন পূরণের পর থিয়েটারই এঁদের কাছে নতুন স্বপ্ন হয়ে দাঁড়ায়।

মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকসেনাদের এক দোসরকে কেন্দ্র করে সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক রচনা করেছেন ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’। এটিকে প্রথম কাব্য নাটক হিসাবেও ধরা হয়। ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ মঞ্চে আনে ‘থিয়েটার’। নির্দেশনায় ছিলেন নাট্যজন আব্দুল্লাহ আল মামুন। সৈয়দ হকের আরেকটি নাটক ‘এখানে এখন’। যাতে তিনি উপজীব্য করে তুলেছেন মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী সময়টাকে। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক তার আরেকটি নাটক ‘যুদ্ধ এবং যুদ্ধ’। শহরের পটভূমিতে রচিত এ নাটকের বিষয়বস্তু মুক্তিযুদ্ধ হলেও পরিবেশ এবং ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গীর প্রকাশ পায় এতে।

নিজের দল থিয়েটারের জন্য সেসময় আব্দুল্লাহ আল মামুন রচনা করলেন ‘আয়নায় বন্ধুর মুখ’, ‘তোমরাই’, ‘দেশের মানুষ’সহ আরও কয়েকটি নাটক। এগুলোর বেশীরভাগ নাটকের নির্দেশকও ছিলেন তিনি। মামুনুর রশীদের নাটক ‘জয়জয়ন্তি’ মুক্তিযুদ্ধকালীন গ্রামের মানুষ বিশেষ করে শিল্পীদের জীবন ও সংগ্রাম নিয়ে রচিত। তার ‘সমতট’ নাটকেও মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সংকট উঠে এসেছে। তিনি তার সব নাটকে শ্রেণি বৈষম্যের কথা বলেছেন। তাঁর মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক নাটকগুলো ছিল '৭১ পরবর্তী জনজীবনে বিবিধ ঘটনা নিয়ে। যার মধ্যে কিছু বামপন্থী ভাবধারাও ছিল। ঢাকার অন্যতম সেরা থিয়েটার দল আরন্যক নাট্যদল প্রযোজনা করেছে তার নাটকগুলো। নির্দেশনা দিয়েছেন মামুনুর রশীদ নিজে।

নাগরিক নাট্যাঙ্গনের জন্য ড. এনামুল হক রচনা করেছেন ‘সেইসব দিনগুলো’। এসএম সোলায়মানের ‘এই দেশে এই বেশে’ নাটকেও মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন আর প্রাপ্তির বিষয়টা উঠে এসেছে। ঢাকা পদাতিক-এর বলিষ্ঠ প্রযোজনা ছিলো এটি। নির্দেশনা দিয়েছিলেন সোলায়মান নিজেই। এসএম সোলায়মানের কালজয়ী অনুবাদ ‘কোর্ট মার্শাল’। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নাটকটি অনুবাদ করে তা নির্দেশনা দেন তিনি। যার বিষয়বস্তু ছিল, যুদ্ধ পরবর্তী বীরাঙ্গনার সন্তানদের সামাজিক অবস্থা আর অবস্থান নিয়ে।

নাট্য নির্দেশক নাসিরউদ্দিন ইউসুফের মুক্তিযুদ্ধের নাটক ‘একাত্তরের পালা’ আর ‘টিটোর স্বাধীনতা’।  প্রযোজনা করেছে ঢাকা থিয়েটার। তাঁর আরেকটি নাটক ‘ঘুম নেই’। এতে তিনি শহিদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্বপ্নের বর্ণনা দিয়েছেন, শহিদদের বাঁচিয়ে তোলার বিষয়টি এনেছেন। এটি অবশ্য প্রযোজনা করেছে ‘মহাকাল’। মমতাজউদ্দিন আহমেদ রচিত বেশ কয়েকটি নাটকে স্বাধীনতার প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তিটা বিশেষভাবে উঠে এসেছে। এর মধ্যে ‘সাতঘাটের কানাকড়ি’, ‘কি চাহো শঙ্খচিল’, ‘স্বাধীনতা আমার স্বাধীনতা’ আর ‘বর্ণচোরা’ উল্লেখযোগ্য। তাঁর নাটকের বেশীরভাগই প্রযোজনা করেছে থিয়েটার তোপখানা।

‘একাত্তরের ক্ষুদিরাম’ মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক একটি বহুল প্রদর্শিত পথনাটক। এটি রচনা করেন মান্নান হীরা। রেপার্টরি থিয়েটার ‘শূন্যন’ প্রযোজনা করে মুক্তিযুদ্ধের কাহিনী নিয়ে নির্মিত, মোমেনা চৌধুরীর একক অভিনীত ‘লাল জমিন’। এটিও মান্নান হীরার লেখা। নির্দেশনা দিয়েছেন সুদীপ চক্রবর্তী। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও পরবর্তী সময়ের গল্প নিয়ে গড়ে উঠেছে ‘লাল জমিন’ এর কাহিনি। নব্বই দশকের উল্লেখযোগ্য নাট্য নির্দেশকদের একজন শামসুল আলম বকুল।  তার রচনা ‘ঘর লোপাট’। এই নাটকে তিনি হানাদার বাহিনীর দোসরদের উত্থানকে তুলে এনেছেন।  নাটকটি মঞ্চে আনে দেশ নাটক।

মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি উঠে এসেছে গোলাম সরোয়ারের ‘ক্ষেতমজুর খইমুদ্দিন’ নাটকেও। খইমুদ্দিন সহজ সরল মানুষ। স্বাধীনতার অর্থ না বুঝলেও তিনি বোঝেন, স্বাধীনতা মানে সকলের মুক্তি। ফলে নিজেকে তিনি মুক্তিযোদ্ধা ভাবতে থাকেন। পরিণতিতে শান্তি কমিটির হাতে নিহত হন।  বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি এবং পরবর্তীতে পদাতিক নাট্যসংসদ মঞ্চে এনেছিলো ক্ষেতমজুর খইমুদ্দিন নাটকটি।

শহীদ বুদ্ধিজীবী জহির রায়হান তার ‘সময়ের প্রয়োজনে’ ছোটগল্পতে মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পের নানা ইতিহাস তুলে ধরেছেন। যুদ্ধকালীন উত্তাল সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে ঘটে যাওয়া নানা বিষয় অবলম্বনে লেখা এই ছোটগল্পটি মোহাম্মদ বারীর নাট্যরূপ ও নির্দেশনায় ‘সময়ের প্রয়োজনে’ নাটকটি মঞ্চায়ন করে থিয়েটার আর্ট ইউনিট।মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তির উত্থানের প্রতিবাদ জানিয়েও সেসময় রচিত হয়েছে বেশ ক’টি নাটক। মাসুম রেজার ‘রাজাকারের প্রত্যাবর্তন’ তেমনই একটি পথনাটক। কেবল ঢাকায় নয়, স্বাধীনতার পর চট্টগ্রাম, রাজশাহী, বরিশাল, ফরিদপুর, কুষ্টিয়াসহ দেশের অন্যান্য জায়গাতেও মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক অনেক নাটক মঞ্চায়িত হয়েছে। কুষ্টিয়ার বোধন থিয়েটার আশির দশকে মঞ্চে আনে সিরাজ হায়দারের লেখা নাটক ‘আলো একটু আলো’। 

ঢাকা/তারা

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়