ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

ইঞ্জিনিয়ার হয়েও উদ্যোক্তা সাদিয়া

জান্নাতুল ফেরদৌস || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:৩০, ৩০ নভেম্বর ২০২০   আপডেট: ১৩:৩৯, ৩০ নভেম্বর ২০২০
ইঞ্জিনিয়ার হয়েও উদ্যোক্তা সাদিয়া

সমাজে সফল ব্যবসায়ীর তালিকায় নারীর সংখ্যা খুব একটা নেই বললেই চলে। এর পেছনে বিভিন্ন ধরনের মানসিক, পারিবারিক ও সামাজিক কারণ সক্রিয়ভাবে কাজ করছে। তারপরেও কিছু কিছু নারী পিছপা হয়ে থাকেননি, সব বাঁধা পেরিয়ে নিজেদের সাফল্যের শিখরে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন। 

বর্তমানে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা পূর্বের তুলনায় সহজ। একজন জয়ী ব্যবসায়ী নারী হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে হবে অবশ্যই। এমনই একজন সাহসী নারী উদ্যোক্তা ইঞ্জিনিয়ার সাদিয়া ইসলাম। পেশায় একজন কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার হলেও তার ইচ্ছা ছিল গতানুগতিক চাকরি না করে ব্যতিক্রম কিছু করার। তিনি গড়ে তুলেন ‘Style Canvas’। রাইজিংবিডির সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তার জীবনের গল্প বলেছেন। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির শিক্ষার্থী জান্নাতুল ফেরদৌস।  

জান্নাত: কেমন আছেন?

সাদিয়া ইসলাম: ভালো আছি। 

জান্নাত: আপনার জীবনের গল্প জানতে চাই।

সাদিয়া ইসলাম: আমার জন্মস্থান কুমিল্লা ও সেখানেই বেড়ে ওঠা। দুই বোনের মাঝে আমি ছোট। বাবা পেশায় সিভিল ইঞ্জিনিয়ার ও মা গৃহিণী। কুমিল্লার নবাব ফয়জুন্নেছা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি ও কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে এইচএসসি সম্পন্ন করে ঢাকার মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজিতে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে ২০০৬ সালে ভর্তি হই। ফাইনাল ইয়ারে পড়াকালীন অবস্থায় ২০১০ সালে আমার বিয়ে হয়ে যায়। স্বামী বুয়েট থেকে পাস করা একজন ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার।

গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিটের পর আমার দুটি প্রতিষ্ঠানে চাকরির সুযোগ হয়। কিন্তু আমার বরাবরই সংসারের প্রতি ঝোঁকটা বেশি ছিল। তাই গদবাধা ৮টা ৬টার চাকরি করে, যাটজটে বসে থেকে দিনের অর্ধেকের বেশি সময় পার করাটা মেনে নিতে পারছিলাম না। সরকারি চাকরির প্রতিও তেমন একটা আকর্ষণ ছিল না। তাই প্রথমে বছরখানেক অনলাইন ফ্রিল্যান্সিংয়ের কাজ করলাম। কিন্তু তারপরও ইচ্ছে ছিল নিজ উদ্যোগে কিছু একটা করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা।

কারো কোনো ব্যবসা বা সরাসরি কোনো কিছুর অনুকরণ আমি বরাবরই অপছন্দ করি। তাই কী নিয়ে ব্যবসা শুরু করবো, সেটা নিয়ে প্রথমে কিছুটা দ্বিধাদ্বন্দ্বে ছিলাম। পরে আমার স্বামীর সঙ্গে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নিলাম ঢাকায় মহিলাদের জন্য ডোর টু ডোর টেইলারিং সার্ভিস শুরু করার। অর্থাৎ টেইলর আপনার বাসা থেকে পোশাক মাপ ও ডিজাইনসহ বুঝে নিয়ে আসবে, পোশাকগুলো তৈরির পর পুনরায় হোম ডেলিভারি দেওয়া হবে। 

আমার উদ্যোগের আরও একটি উদ্দেশ্য ছিল ঢাকায় কর্মব্যস্ত ও কর্মজীবী নারীরা প্রতিনিয়ত সমস্যার সম্মুখীন হয়, এমন একটি সমস্যার সমাধান করা। অনলাইনে পোশাক পাওয়া গেলেও সেই পোশাকগুলো বানাতে দেওয়ার জন্য নারীদের যানজট ঠেলে সময় নষ্ট করে দর্জির দোকানে যেতে হয়। আর সময়মত দর্জির দোকানে পোশাক ডেলিভারি না দেওয়া এইটি একটি চিরাচরিত সমস্যা।

তাই ঢাকার নারীদের জন্য এই টেইলারিং সার্ভিসটি সর্বপ্রথম ২০১৫ সালে অনলাইন প্ল্যাটফর্মে আমি চালু করি। আমার ফেসবুক পেজের নাম দেই ‘স্টাইল ক্যানভাস’।

শুরুতে সবকিছু গুছিয়ে ওঠা আমার জন্য কিছুটা চ্যালেঞ্জিং হয়ে দাঁড়িয়েছিল কারণ এই সার্ভিস ঢাকায় তখন সর্বপ্রথম ও আমি যেহেতু ইঞ্জিনিয়ারিং লাইনে পড়াশোনা করেছিলাম, তাই এই বিষয়ে তেমন কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না। কিন্তু ডিজাইন সম্পর্কে ধারণা ও টেইলারিং কাজের ফিনিশিং যথাযথ বোঝার ক্ষমতা ছিল বলে, নিজের উপর বিশ্বাস স্থাপন করেছিলাম। 

জান্নাত: আপনার উদ্যোগের পেছনের কারণ কী?

সাদিয়া ইসলাম: শুরু থেকে টাকা উপার্জনের কোনো উদ্দেশ্যই আমার মূলত ছিল না। আমার উদ্যোগের মূলত তিনটি উদ্দেশ্য ছিল-
১. নিজেকে একজন নারী উদ্যোক্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা।
২. কর্মজীবী নারীরা প্রতিনিয়ত সমস্যার সম্মুখীন হয়, এমন একটি সমস্যার সমাধান করা।
৩. কর্মসংস্থান তৈরি করা। 

আমি সর্বদা মান সম্পন্ন কাজের ব্যাপারে ও যথাযথ সময় ডেলিভারি দিতে অনড় ছিলাম ও এখনও আছি। আমার গত পাঁচ বছরের রেকর্ডে সময়মতো অর্ডার সংগ্রহ না করা কিংবা ডেলিভারি না দেওয়ার কোনো রেকর্ড নেই, কারণ আমি মনে করি ‘কমিটমেন্ট’ শব্দটি একজন উদ্যোক্তার সঠিকভাবে আয়ত্ত করা উচিত। এই বিষয়গুলো যথাযথভাবে মেনে চলার জন্য আমি টেইলারিংয়ের নিজস্ব সেটআপ তৈরি করেছিলাম। 

সচরাচর দেখা যায় যারা অনলাইন ভিত্তিক সেবাগুলো প্রদান করেন, তাঁরা মূলত আউটসোর্সিং করে থাকেন। যেমন কেউ যদি পার্লার সার্ভিস দিয়ে থাকেন, তাহলে দেখা যায় বাইরের কয়েকটি পার্লারের থেকে কর্মী আউটসোর্স করে তারা সার্ভিসটা দিয়ে থাকেন। এমন আরও অনেক সার্ভিস আছে।

কিন্তু আমি সম্পূর্ণই নিজের সেটআপ তৈরি করে নিয়েছিলাম। কারণ, আমি মনে করি আউটসোর্সিং করলে গুণগত মান ও কাজের ধারাবাহিকতা বজায় রাখা সম্ভব হয় না।

জান্নাত: আপনি টেইলারিং সার্ভিসের পাশাপাশি আর কি কি সেবা দিচ্ছেন গ্রাহকদের?

সাদিয়া ইসলাম: টেইলারিং সার্ভিসের পাশাপাশি বর্তমানে আমি নিজস্ব ডিজাইনের ড্রেস, বিশেষ করে হ্যান্ড ব্লকের ড্রেসও সেল করছি। তাছাড়া করোনার এই ক্রান্তিলগ্নে চাকরির বাজার যেখানে অনেকটা ঝুঁকির মুখে পড়েছে, সেখানে পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও যাতে টেইলারিং কাজ শিখে কিছুটা পরিবারের আয়ে অংশগ্রহণ করতে পারে, সেজন্য অনলাইন টেইলারিংয়ের পাশাপাশি আমি অনলাইন টেইলারিং কোর্সেরও ব্যবস্থা করেছি।

জান্নাত: আপনার সার্ভিস কি শুধু ঢাকা ভিত্তিক?

সাদিয়া ইসলাম: আমাদের সার্ভিস শুধু ঢাকা কেন্দ্রিক হলেও বর্তমানে ঢাকার বাইরে এমনকি দেশের বাইরে থেকেও আমি টেইলারিং অর্ডার পাচ্ছি। গ্রাহকেরা আমার ঠিকানায় তাঁদের পোশাকগুলো পাঠিয়ে দিচ্ছে। সেলাইয়ের পর আমি পুনরায় লোকাল এবং আন্তর্জাতিক কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে পোশাকগুলো গ্রাহকের ঠিকানায় পাঠিয়ে দিচ্ছি।

জান্নাত: ইঞ্জিনিয়ার হয়েও উদ্যোক্তা হলেন, এতে কি পরিবারের সাপোর্ট পেয়েছেন?

সাদিয়া ইসলাম: উদ্যোগের ক্ষেত্রে নানা চড়াই-উৎরাই পারি দিয়ে আজ এই জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছি। ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে কেন এমন লাইনে কাজ করা, কেনইবা সরকারি গেজেটেড অফিসার হলাম না, এমন বহু কথা শুনেছি। কিন্তু এইসব কনজারভেটিভ চিন্তা ধারার পক্ষপাতী আমি কখনোই ছিলাম না। ‘পাছে লোকে কি বলে’ তার থেকেও আমার বড় উদ্দেশ্য ছিল আমার করতে কী ভালো লাগে। তাই আমি আমার উদ্যোগ সম্পর্কে কাউকে বলতে কখনোই ইতস্তত বোধ করিনি। সৎ থেকে ও কারো কোনো ক্ষতি না করে নিজে প্রতিষ্ঠিত হওয়াটাই আমার কাছে মূখ্য ছিল।

বাবা, মা ও বিশেষত স্বামীর কাছ থেকে যথেষ্ট সাপোর্ট পেয়েছি। যতবারই ভেঙে পড়েছি ও কোনো সমস্যার সম্মুখীন হয়েছি আমার স্বামী সর্বদা সেই জায়গা থেকে আমাকে টেনে তুলে এনে আবার গোছানো জায়গায় বসিয়ে দিয়েছে।

আমি আমার জীবনে দেখেছি, যত দুঃসময়গুলো এসেছে, তার টার্ন অ্যারাউন্ডগুলো আমার জন্য আরও বড় কোনো পুরস্কার নিয়ে এসেছে। সেই থেকে আমি প্রচন্ড পজিটিভ থাকার মানসিকতা অর্জন করেছি।

জান্নাত: আমাদের সমাজে কিছু লোক আছে যারা মনে করেন ‘নারীরা কেন উদ্যোক্তা বা ব্যবসায়িক হবেন?’ এই বিষয়টি আপনি কীভাবে দেখছেন?

সাদিয়া ইসলাম: আমি বলতে চাই, আমার উদ্যোগের আর একটি বড় উদ্দেশ্য হচ্ছে সমাজের টিপিক্যাল কনজারভেটিভ মানসিকতাকে পরিবর্তন করা, যাতে আমার বাবা-মাকে কেউ বলতে না পারে ‘আপনার একটি ছেলে থাকলে ভালো হত! আরে মেয়ে তো পরের বাড়ি চলে যায়, সে আর কি কিছু দিতে পারে?’ আমি প্রমাণ দিতে চেয়েছি, বাবা মায়ের সঠিক দিক নির্দেশনা পেলে একটা কন্যা সন্তানই ১০ জন পুত্র সন্তান থেকেও বড় সম্মান নিয়ে আসতে পারে। সবকিছু শুধু উপার্জনের টাকা বাবা মাকে দিয়ে তার মাপকাঠিতে বিচার বিশ্লেষণ করলেই হয় না, সেই সন্তান যদি বাবা মাকে সঠিক সম্মান না করতে শেখে।

আর একজন ইঞ্জিনিয়ার শুধু কর্পোরেট জবহোল্ডার বা সরকারি গেজেটেড অফিসারই হন না। তিনি একজন উদ্যোক্তাও হতে পারেন। আমি একজন ইঞ্জিনিয়ার হয়ে সেই পথেই এগিয়ে যাচ্ছি।

জান্নাত: আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?

সাদিয়া ইসলাম: Style Canvas" এর ষষ্ঠ বছর চলছে। আল্লাহর অশেষ রহমতে এখন "Style Canvas" এর অগণিত গ্রাহক। অক্লান্ত প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি, ব্যবসাটিকে সফলতার দ্বার প্রান্তে এমনভাবে নিয়ে যেতে চাই যেন "Style Canvas" কে সবাই এক নামে চেনে ও একটি ব্র্যান্ডে পরিণত হয়। পাশাপাশি যারা সেলাই জানেন, তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করার প্রচেষ্টায় কাজ করে যাচ্ছি।

ঢাকা/মাহি

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়