ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

আগুন খুন কী হচ্ছে আমাজনে?

ইকবাল মাহমুদ ইকু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:৫৭, ১১ নভেম্বর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
আগুন খুন কী হচ্ছে আমাজনে?

এইত কিছুদিন আগেই জ্বলছিল আমাজন, পুড়ছিল লাখো গাছ-গাছালীতে ঘেরা অক্সিজেনের ভাণ্ডার ও ‘পৃথিবীর ফুসফুস’খ্যাত এই অরণ্য।

যদিও এই ধরনের ঘটনা এবারই প্রথম নয়। বরং প্রায় সময়েই আমাজনে এই ধরনের ঘটনা ঘটে। তবে এবার যেন সবকিছুর মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছে। কয়েকটি প্রশ্ন কড়া নাড়ছে বেশ কিছুদিন ধরেই- সরকার কী করছে? কেউ কি নেই আমাজন বাঁচানোর জন্য? প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে যদি সরকারের প্রসঙ্গ চলে আসে তাহলে সেখানে অবহেলা, অবজ্ঞা এবং স্বার্থান্বেষী মহল এবং মনোভাবের কথাটাই আগে বলতে হবে। 

তবে সরকারের এই বিরূপ মনোভাবের পরেও বেশ কিছু স্থানীয় মানুষ এখনও সোচ্চার, তারা এগিয়ে এসেছে আমাজন রক্ষায়! আমাজন রেইনফরেস্টে এখন গুয়াজারা উপজাতি গোষ্ঠীগুলো তাদের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতেও নিয়মিত টহল দিয়ে যাচ্ছে। যেহেতু বনরক্ষায় পুলিশের সংখ্যা বেশ কম, তাই স্থানীয়রা এগিয়ে এসেছেন নিজ থেকেই। উদ্দেশ্য একটাই, বন বাঁচিয়ে রাখতে হবে। বাঁচিয়ে রাখতে হবে এই আশ্চর্য জীব বৈচিত্র্যের সমাহার! পাহারা দিতে থাকা এই স্থানীয় গোষ্ঠীগুলো নিজেরাই ‘বনরক্ষক’ বলে নিজেদের নামকরণ করেছেন।

এদিকে থেমে নেই বন দস্যুরা! জঙ্গল উজাড় করতে তারা দিনদিন হয়ে উঠছে আরো বেশি ভয়ঙ্কর। গত ১ নভেম্বর তারা এই বনরক্ষকদের একজনকে নৃশংস ভাবেহত্যা করেছে। ২৬ বছর বয়সি পাওলো পলিনো ‍গুয়াজারা বনরক্ষকদের মধ্যে বেশ বহুল পরিচিত এবং জনপ্রিয় একটি মুখ ছিল। পাওলো পলিনো পাঁচজন সাথীকে নিয়ে বনের মধ্যে শিকার অভিযানে গিয়েছিলেন। তখন অবৈধ অনুপ্রবেশকারী বনদস্যুরা তাদের অতর্কিত আক্রমণ করে এবং মুখে গুলি করে হত্যা করে। রয়টার্সের একটি সূত্র মোতাবেক জানা গেছে, একজন বন দস্যুও তাদের পাল্টা আক্রমণে নিহত হয়েছে।

ব্রাজিলের আমাজন অঞ্চলে প্রায় আট লাখ স্থানীয় অধিবাসী রয়েছে। যদিও তারা ব্রাজিলের মূল জনসংখ্যার তুলনায় বেশ কম। তবুও এখানে প্রায় ৩০৫টি জনগোষ্ঠী রয়েছে যারা প্রায় ২৭৪টির মতো ভাষা ব্যবহার করে। গত এপ্রিল মাসে প্রায় চার হাজার স্থানীয় অধিবাসী ব্রাজিলের রাজধানীতে এসে জমায়েত হয়েছিলেন। এপিআইবি নামক এই জোট ২০০৪ সাল থেকেই ফ্রি ল্যান্ড ক্যাম্প নামে এই অহিংস আন্দোলনের মাধ্যমে নিজেদের দাবি উপস্থাপন করে আসছে।

এই বছরের সমাবেশে তারা নিজেদের জনবল এবং জমির উপর প্রতিনিয়ত হয়ে আসা বিভিন্ন আক্রমণ এবং সরকারের আদিবাসীবিরোধী মনোভাবের বিরুদ্ধে নিন্দা জ্ঞাপন করে এবং ন্যায়বিচার দাবি করে। আদিবাসীদের প্রতিরক্ষা এবং তাদের সাংবিধানিক অধিকার সংহত এবং শক্তিশালী করার জন্যই এপিআইবি তৈরি করা হয়েছিল।

বর্তমানে আদিবাসীদের মধ্যে যুবক শ্রেণী তাদের প্রতি হয়ে আসা অন্যায়ের বিরুদ্ধে নিজেদের প্রতিবাদী কণ্ঠ ছড়িয়ে দিতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করতে শুরু করেছে। এক সাক্ষাৎকারে এরিসভান নামের একজন যুবক বলেন, আমাদের উদ্দেশ্য হলো ব্রাজিলের অন্যান্য অধিবাসীসহ বিশ্ববাসীকে জানানো যে, আমরা কতটা কষ্টে আছি! আমাদের উপর কীভাবে আক্রমণ হচ্ছে এবং আমাদের অধিকারগুলো কীভাবে কেড়ে নেয়া হচ্ছে, এগুলো বিশ্ববাসীর জানা উচিৎ।

২০০৫ সাল থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত স্থানীয়দের হাজারো প্রচেষ্টার পর বন উজাড় হওয়ার পরিমাণ অনেকাংশেই কমে গিয়েছিল। স্থানীয়দের সঙ্গে বিগত সরকারের বন উজাড় সম্পৃক্ত বিভিন্ন নীতিও এখানে বেশ জোরালো ভূমিকা পালন করে। তবে সময় এবং সরকার পরিবর্তনের ফলে বিগত কয়েক বছর ধরে আমাজন জঙ্গলে সংকটপূর্ণ পরিস্থিতি বিরাজমান। এমনকি এই বছরেই আমাজন জঙ্গলে আগুন দেয়া এবং বন উজাড়ের পরিমাণ পূর্বের সকল পরিসংখ্যানকে ছাড়িয়ে গেছে।

ব্রাজিলিয়ান স্পেস রিসার্চ ইন্সটিটিউটের দেয়া একটি তথ্যমতে, গত ১২ মাসের মধ্যে আমাজনের প্রায় চব্বিশ হাজার বর্গ মাইল এলাকার জঙ্গল ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। আমেরিকার নিউ ইয়র্ক শহরের তুলনায় প্রায় আটগুণ বড় এলাকা শুধুমাত্র নিজেদের সামান্য স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে উজাড় করে দেয়া হয়েছে। বন উজাড়ের পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে স্থানীয়রা, অসহায় অবস্থায় মৃত্যুর সাথে প্রতিনিয়তই পাঞ্জা লড়ছে আমাজন জঙ্গলের জীব বৈচিত্র্য!

স্থানীয় আদিবাসীদের সঙ্গে সহিংসতার পরিমাণ দিন দিন বেড়েই চলছে ব্রাজিলে। বর্তমানে আদিবাসী এবং পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোর জন্য বেশ বিপজ্জনক একটি স্থানে পরিণত হয়েছে ব্রাজিল। কেননা, বিগত বছর ২০১৮ সালেই প্রায় ১৩৫ জন আদিবাসী খুন হয়েছিল। এ সম্পর্কে প্যাক্সটন নামক কায়াপো গোষ্ঠীর একজন আদিবাসী বলেন, আমাদের গতানুগতিক জ্ঞান এখন খুবই সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে। আমাদের বেঁচে থাকার জন্য এবং নিজেদের অধিকার আদায়ের নতুন কোনো উপায় খুঁজে বের করতে হবে। তিনি আরো বলেন, আমাদের নিজেদের জীবন এবং জমি রক্ষায় প্রযুক্তির দিকে আমাদের জ্ঞান আরেকটু প্রসারিত করতে হবে, তা না হলে আমাদের টিকে থাকাই এখন হুমকির মুখে।

ব্রাজিলের বর্তমান প্রেসিডেন্ট জেইর বলসোনারো উন্নয়ন এবং বিকাশের ফাঁক গলেই মাইলের পর মাইল বন উজাড় হচ্ছে বলেই স্থানীয়রা দাবি করেন। সরকারের এই বিরূপ মনোভাব কেবলমাত্র আমাজন জঙ্গলের জন্যই হুমকিস্বরূপ নয় বরং স্থানীয়দের জীবনযাপনের উপরেও প্রভাব বিস্তার করছে। আর যেন এই কথাটিকেই সত্য প্রমাণিত করতে মৃত্যুবরণ করতে হলো পাওলো পলিনো ‍গুয়াজারাকে। তবে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, তারা যথেষ্ট চেষ্টা করে যাচ্ছেন। এমনকি মারানাহো রাজ্যের গভর্নর, আদিবাসীদের জীবন রক্ষার জন্য একটি টাস্কফোর্স গঠনের ঘোষণা দিয়েছেন এবং বিচার মন্ত্রী সর্জিও মোরো এই গুরুতর অপরাধের জন্য দায়ীদের বিচারের আওতায় আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

কিন্তু যেখানে বলসোনারোর অধীনেই উজাড় হচ্ছে মাইলের পর মাইল জঙ্গল, সেখানে আর কার কি করার থাকতে পারে! ব্রাজিলীয় এই প্রেসিডেন্ট ব্যবসার জন্য আমাজন জঙ্গলকে উন্মুক্ত করে দেয়ার ব্যাপারে বেশ প্রচার করেছিলেন। আর তাই স্থানীয়দের মধ্যে এখন রীতিমতো আতঙ্ক বিরাজ করছে। কেননা, তাদের ধারণা পাওলোর মৃত্যু হয়তো কেবল মাত্র শুরু। সরকারের পক্ষ থেকে বিরূপ মনোভাব না কাটা পর্যন্ত আমাজন জঙ্গলে বসবাসকারী এই স্থানীয়দের দিন কাটছে এখন অজানা আশঙ্কায়!

হিউম্যান রাইট ওয়াচের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বলসোনারোর আমলের প্রথম আট মাসের মধ্যেই বন উজাড়ের সংখ্যা বেড়ে প্রায় দিগুণ হয়ে গিয়েছে। এছাড়া কয়েকদিন আগে লাগানো আগুনে ‘পৃথিবীর ফুসফুস’ নামে খ্যাত এই আমাজনের বিশাল একটি অংশ জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে গিয়েছে।

এখন যেখানে অনেকেই প্রার্থনা করছে আমাজন জঙ্গল বাঁচানোর জন্য, সেখানে অনেকেই নিজেদের অধিকার রক্ষায় ঝুঁকছে প্রযুক্তির দিকে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এবং ইউটিউবের সাহায্যে নিজেদের অধিকার নিয়ে কণ্ঠ জোরালো করার পাশাপাশি ব্যবহৃত হচ্ছে মোবাইল অ্যাপ! আইপিএএম নামক একটি বেসরকারি কোম্পানি ‘অ্যালার্টা ক্লাইমা ইন্ডেজেনা’ নামে একটি মোবাইল অ্যাপ বানিয়েছে। এই অ্যাপের মাধ্যমে তারা বনে আগুন ও বন দস্যুদের আগমন সম্পর্কে একে অন্যকে সতর্ক করতে পারছে। যদিও স্থানীয় সব অধিবাসীর কাছে এখনো মোবাইল ফোন এবং ইন্টারনেট নেই। তবুও তরুণদের মধ্যে প্রযুক্তি বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।

পরিশেষে বলা যায় যে, বনরক্ষক পাউলিনো হত্যার সাথে সাথে স্থানীয় গোষ্ঠী এবং সেখানে কাজ করে যাওয়া বিভিন্ন আন্তর্জাতিক এনজিওগুলোর মধ্যেও তীব্র প্রতিক্রিয়া শুরু হয়েছে। সবার দৃষ্টি এখন সরকারের দিকে নিবদ্ধ। দেশের এমন পরিস্থিতিতে সরকারের পদক্ষেপ কী হতে পারে এবং বন ও আদিবাসী রক্ষায় সরকার কি আদৌ কোন জোরাল পদক্ষেপ গ্রহণ করবে কি না সময়ই তা বলে দিবে।


ঢাকা/মারুফ/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়