স্বরূপে ফিরছে ‘আমঝুপি নীলকুঠি’
মহাসিন আলী || রাইজিংবিডি.কম
আমঝুপি নীল কুঠিবাড়ির মূল ভবন
মহাসিন আলী, মেহেরপুর : মেহেরপুর সদর উপজেলার ‘আমঝুপি নীলকুঠি’ পুরাকীর্তি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। মেহেরপুর জেলা সদর থেকে প্রায় ৬ কিলোমিটার পূর্বদিকে মেহেরপুর-চুয়াডাঙ্গা সড়কের দক্ষিণে এবং কাজলা নদীর উত্তর ও পূর্ব তীরঘেঁষে আমঝুপি কুঠি বাড়ির অবস্থান। সংরক্ষণ ও সংস্কারের জন্য এর আংশিক দায়িত্বভার মেহেরপুরের জেলা প্রশাসন হতে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগে অর্পিত হয়েছে। আমঝুপি নীলকুঠিকে আবার স্বরূপে জাগিয়ে তুলতে কাজ শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে সীমানা প্রাচীর নির্মাণ কাজ শেষ করেছে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর খুলনার আঞ্চলিক পরিচালক মোঃ আমিরুজ্জামান বলেন, ‘২০১৪-২০১৫ সেশনে গত ২৬ এপ্রিল হতে ১৮ জুন পর্যন্ত প্রাথমিকভাবে মেহেরপুর সদর উপজেলার ১৫টি, গাংনী উপজেলার ৬টি ও মুজিবনগর উপজেলার ৬টি স্থান জরিপ করা হয়েছে। এসব জরিপের প্রতিবেদন প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ ঢাকা হতে যাচাই-বাছাই শেষে যেগুলো পুরাকীর্তি হিসেবে গেজেটভূক্ত হবে সেগুলো সংরক্ষণ ও সংস্কারের জন্য কাজ করা হবে। আমঝুপি নীলকুঠি প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের গেজেটভূক্ত পুরাকীর্তি বিধায় স্বল্পপরিসরে হলেও কাজ শুরু করা হয়েছে। সংস্কার শেষে এর সংরক্ষনের জন্য লোকবল নিয়োগ দেয়া হবে।’
আমঝুপি গ্রামের বাসিন্দা গাংনী ডিগ্রি কলেজের সহযোগি অধ্যাপক সাঈদুর রহমান বলেন, ‘১৮১৮ থেকে ১৮২০ সালের মধ্যে ইংরেজরা আমঝুপিতে ‘কুঠিবাড়ি’ গড়ে তোলে। প্রধানতঃ ব্যবসার উদ্দেশ্যেই তারা কুঠি বাড়িগুলো নির্মাণ করেছিল। কাজলা নদীর পাড়ে প্রায় ৭৫ একর জমির উপর গড়ে ওঠে আমঝুপি নীল কুঠিবাড়ি। ইংরেজরা কুঠিবাড়ির আশপাশের কৃষকদের জোরপূর্বক নীল চাষে বাধ্য করতো। প্রজারা খাজনা দিতে কিংবা নীল চাষে অবাধ্য হলে তাদের উপর চালানো হতো অমানবিক নির্যাতন। লাইন দিয়ে রোদে দাঁড় করিয়ে মাথায় কাদা লেপন করে রোপন করা হতো নীল গাছের বীজ। যতদিন না চারা গজাতো ততদিন তাদের দাঁড় করিয়ে রাখা হতো। কখনও কখনও হত্যা করে মৃত্যুকুপে নিক্ষেপ করা হতো। নীলগাছ পঁচা পানি জ্বাল দিয়ে তৈরি করা হতো নীল রঙ। যা ইংল্যান্ডে সরবরাহ করা হতো।
ইংরেজ কর্মচারীদের বে-দখল বাড়ি
মেহেরপুর প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি আশরাফুল ইসলাম বলেন, ‘কৃষক নির্যাতনের সাক্ষী হয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে সাহেবদের প্রমোদ ঘর, শয়ন কক্ষ ও বিলুপ্ত প্রায় নির্যাতন সেল সংবলিত আমঝুপি কুঠিবাড়ির ভবনটি। বুনো শূকরের পাশাপাশি বিষধর সাপেরও অত্যাচার ছিল। যে কারণে আমঝুপি কুঠির দু’টি কক্ষ সে আমলেইকে প্রুভ করা হয়। জেলখানা, মৃত্যুকুপ ও ঘোড়ার ঘর সবই বিলুপ্ত প্রায়। এগুলোর সংরক্ষণ করা প্রয়োজন ছিল।’
মেহেরপুরের জেলা প্রশাসক মোঃ শফিকুল ইসলাম জানান, বর্তমানে আমঝুপি কুঠি বাড়ির জমি রয়েছে ৩৩ একর। এর মধ্যে ৩.৬১ একর জমি ২০১৪ সালের ২২ অক্টোবর প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ কুঠিবাড়ি এলাকায় আরো কয়েকটি স্থাপনা পুরাকীর্তি হিসেবে চিহ্নিত করে জমি চাইলে বিধি মোতাবেক তা হস্তান্তর করা হবে।
গত ২৩ জুন’১৫ তারিখে মেহেরপুর-১ আসনের সংসদ সদস্য অধ্যাপক ফরহাদ হোসেন ঐতিহাসিক আমঝুপি নীলকুঠির সীমানা প্রাচীর নির্মাণ, প্রত্নতাত্ত্বিক সংস্কার সংরক্ষণ ও উন্নয়ণ কাজের উদ্বোধন করেন।
বর্তমানে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর খুলনা এ বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি পুরাকীর্তির সংস্কার-সংরক্ষণ ও উন্নয়ন কর্মসূচির আওতায় ৩৮ লাখ ৩৫ হাজার টাকার প্রস্তাবিত বাজেটে আমঝুপি নীলকুঠি প্রত্নতত্ত্বস্থলের সীমানা প্রাচীর নির্মাণ কাজ করেছে। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর খুলনা বিভাগের উপ-সহকারি প্রকৌশলী খোন্দকার জিল্লুর রহমান এ কাজের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রকৌশলী।
এমপি অধ্যাপক ফরহাদ হোসেন বলেন, ‘অর্থ সংকুলান না হওয়ায় ইচ্ছা থাকা সত্বেও প্রাথমিকভাবে কুঠিরঘরটিসহ অতি গুরুত্বপূর্ণ মাত্র কয়েকটি স্থাপনা সীমানা প্রাচীরের মধ্যে নেয়া হয়েছে। পরবর্তীতে বাকি স্থাপনাগুলো প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের মধ্যে নিয়ে সংরক্ষণ ও সংস্কার করা হবে। সীমানা প্রাচীরের মধ্যে ফুলের বাগানসহ গবেষণাগার করা হবে।’
তিনি বলেন, পর্যটন মন্ত্রীকে নিয়ে আমঝুপি নীলকুঠি পরিদর্শন করিয়ে সেখানে পর্যটন কেন্দ্র করা হবে। সেখানে হোটেল-মোটেল করা হলে মেহেরপুরের ঐতিহাসিকস্থানগুলো দেখার জন্য পর্যটক আসবে। এতে অর্থনৈতিক উন্নয়নসহ মেহেরপুর জেলার মান আরো বৃদ্ধি পাবে।’
নীলকরদের ডাক বহণকারী কবুতরের ঘর
আমঝুপি গ্রামের বাসিন্দা মুজিবনগর সরকারি ডিগ্রি কলেজের প্রভাষক জাহির হোসেন চঞ্চল জানান, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ কুঠিবাড়িসহ সামান্য জমি গ্রহণ করেছে। এরপরও প্রায় ৩০ একর জমি জেলা প্রশাসনের হাতে রয়েছে। যার উপর নীলকরদের তৈরি ঘরে আমঝুপি ইউনিয়ন ভূমি অফিস চলছে। নীলকর কর্মচারীদের থাকার ঘর দখল করে আশ-পাশের অনেকগুলো পরিবার বসবাস করছে। এ ছাড়াও রয়েছে পানিশূন্য একটি বিশাল পুকুর ও একটি আমের বাগান। এসব জমি অরক্ষিত থাকার কারণে বেদখল হবার আশংকা করছেন এলাকাবাসী।
তিনি বলেন, ‘এখানে ইংরেজদের ব্যবহৃত ট্যাঙ্ক, আসবাপত্র, পোশাক, চাবুক, তলোয়ারসহ বহু মূল্যবান জিনিসপত্র চুরি হয়ে গেছে নাকি প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের হাতে হস্তান্তর করা হয়েছে তা জানেন না এলাকাবাসী।
কুঠিবাড়িটি যথাযথ সংরক্ষণসহ তৎকালীন সময়ে আমঝুপি কুঠিবাড়ির ইংরেজদের ব্যবহৃত ট্যাঙ্ক, আসবাপত্র, পোশাক, চাবুক, তলোয়ারসহ বহু মূল্যবান প্রত্নতত্ত্ব সম্পদগুলো ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করা হবে বলে জানালেন প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর খুলনা বিভাগের উপ-সহকারি প্রকৌশলী খোন্দকার জিল্লুর রহমান।
তিনি বলেন, ‘এ কাজের পরে কুঠিবাড়িটির সংস্কারের কাজে হাত দেওয়া হবে। কেয়ার টেকারদের থাকার ঘরের পশ্চিম পাশের উঁচু ইটের ঢিবিটি এবং আরো পশ্চিমের মাটির নীচের একটি চওড়া দেওয়ালসহ সম্ভাব্য বেশ কিছুস্থান খুঁড়ে প্রত্নতত্ত্ব সম্পদ উদ্ধারের চেষ্টা করা হবে। ২০১৪-২০১৭ সাল কর্ম সম্পন্ন কালের মধ্যে এসব কাজ শেষ করে উদ্বোধন ও দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করা হবে।’
রাইজিংবিডি/মেহেরপুর/৩১ জানুয়ারি/মহাসিন/শাহ মতিন টিপু
রাইজিংবিডি.কম