ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

নদীতে তলিয়ে যায় মানুষের স্বপ্ন

জুনাইদ আল হাবিব || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০১:৫৯, ২৩ জুন ২০২০   আপডেট: ১০:৩৯, ২৫ আগস্ট ২০২০
নদীতে তলিয়ে যায় মানুষের স্বপ্ন

নদীতে হারিয়ে যাওয়া স্বপ্ন খুঁজে মানুষ

নদী তীরের পথ। ভাঙনে আঁকাবাঁকা রেখা সৃষ্টি হয়েছে। কোথাও কম ভেঙেছে, আবার কোথাও বেশি। কিন্তু ভাঙন থেমে নেই। দুপুর-সন্ধ্যা-রাত নেই, নদী ভাঙন তাড়িয়ে বেড়ায় কূলের মানুষকে।

নিশ্চিন্তে ঘুমোনোর অবকাশও নেই। রাত জেগে পাহারায় থাকতে হয়, যদি ভাঙনের ভয়াল থাবা ভিটেমাটি সব কেড়ে নেয়! কিছুতেই যেন এই আতঙ্ক কাটে না মেঘনাপাড়ের মানুষের।

এই দৃশ্যপট লক্ষ্মীপুরের কমলনগরের। ভাঙনে স্থায়ী কোনো প্দক্ষেপ নেওয়া হয়নি। যুগ যুগ ধরে এ ভাঙন চলমান। প্রতিনিয়ত স্বপ্ন ভাঙছে কূলের মানুষের। নদী ভাঙনের ফলে এখন যেন নতুন করে স্বপ্ন দেখতে-ই ভুলে গেছেন নদীতীরের মানুষ। কোনোমতে জীবন চলছে ঝুপড়ি ঘরে, রাস্তার দ্বারে, অন্যের আশ্রয়ে, নয়তো ভাড়া করা জায়গায়। ভাঙনের কারণে এখানকার শত শত পরিবার এখন বিচ্ছিন্ন নিকটাত্মীয়দের কাছ থেকে।

তাদেরই একজন আলেফা বেগম। বয়স ৩৭। পাঁচ বছর আগে নদীতে বসতভিটা হারিয়েছেন। কমলনগরের চর কালকিনির দক্ষিণ সীমানার হাজীগঞ্জ বাজারের দক্ষিণ পাশে শান বাঁধানো পুকুর ঘাট আর বড় উঠোনের বাড়ি ছিল তার। কিন্তু নদী সব কেড়ে নিয়েছে। নিঃস্ব হয়ে আলেফা এখন পথে বসেছেন। আলেফার ঠাঁই মিলেছে অন্যের জায়গায়। পাশের ইউনিয়ন চর মার্টিনে এক আত্মীয় বাড়িতে।

এই অসহায়ত্বের কথা জানিয়ে আলেফা বেগম বলেন—‘গাঙে ভাঙছে, এখন কোনো ঢাল কূল নাই। ছেলে-সন্তান নিয়া খুবই কষ্টের মইধ্যে আছি। অন্যের জায়গায় থাই। দ্যাখেনতো, কী অবস্থায় আছি। আমাগো দিকে যদি একটু চাইতেন।’

আলেফার ছেলে নীরবের বয়স এখন ১৫ ছুঁইছুঁই। নদী ভাঙনের কারণে তৃতীয় শ্রেণিতে এসে থেমে গেছে তার পড়াশোনা। এখনো স্কুলে ফেরা হয়নি তার। স্বামী আবুল কাশেম কখনো নদীতে মাছ ধরেন, কখনো সিএনজি চালিয়ে কোনোমতে টেনেটুনে সংসার চালান। কিন্তু ভাগ্যবদল হয় না। কোথাও জমি কিনে একটু মাথা গোঁজার ঠাঁই হয় না আলেফার।

৩২ বছর বয়সি বেলাল। নদী ভাঙনে নিঃস্ব হয়ে পথে বসেছেন। চর মার্টিন ইউনিয়নের বলিরপোলের দক্ষিণে রাস্তার পাশে এক বাড়িতে আশ্রয় নেন। এক নদী ভাঙনই তাকে শেষ করে দিয়েছে। নদী ভাঙনে হারিয়েছেন কর্মও। এখন ফাঁকে ফাঁকে নদীতে মাছ ধরতে যান নৌকার কোনো মাঝির সঙ্গে। নদীতে মাছ না মিললে বেলালের চুলোয় আগুন জ্বলে না। এখানে বেলালের গল্পটা আরো নির্মম। কারণ তার স্ত্রী মানসিক বিকারগ্রস্ত। এ যেন মরার উপর খাঁড়ার ঘা।

কেমন আছেন জানতে চাইলে বেলাল বলেন, ‘কেমন আর আছি, দেন না? কষ্টের কোনো শ্যাষ আছে? নদী ভাঙার পর জীবন কি আর আগের মতো চলে? টাকা-পয়সা থাকলে অন্যের জায়গায় থাকতাম না। টাকা-পয়সা যে কামাই করমু, সে পথও তো নাই। একবার এইটা, আরেকবার ওইটা। এইভাবে আইলাই বিলাই কামে কোনো লাভ আছে? কোনো লাভ নাই। যদি মনে করেন, একাধারে একটা কাম করতাম, তবেই না কিছু টাকা জোগাইতে হাইত্তাম। এখন দ্যাখেনতো, আরেকজনের জায়গাতে থাকি। এটা কেউ ভালোভাবে নেয় না।’

নদী ভাঙার পর মাহিনুর বেগম ধার-দেনা করে দুই কড়া জমির ওপর বাড়ি করেছেন। ঘরও এক চালা। দেনার বোঝায় প্রতিদিন দুশ্চিন্তা মাথায় নিয়ে ঘুরেন তিনি। খাবারের তালিকায় ভালো কিছু যোগ হয় না তার। কোনোমতে তরিতরকারি দিয়েই দিন চলে। ‘গাঙে ভাঙনের পর থেইকা রত হাত সব ভাইঙা গ্যাছে। অন আর রত চলে না। বেডার কামাই তেমন নাই। চিটাগাং-এ কাম করে। কিন্তু কাল বেডার কামাইও ঠিকমতো পাই না৷ দেনাপাওনার লাইগা মাইনষের কাছে মুখ ছোড়। এই সব আমরা কপালে কইরা নিয়া আইছে। নদী না ভাঙলে এমন হতো না।’—বলেন মাহিনুর বেগম।

চর কালকিনির মেঘনা তীরের বাসিন্দা রাবেয়া বেগম। পাঁচবারের নদী ভাঙনের পর শেষ বসতি নাজিরগঞ্জ বাজারের কলোনিতে। রাবেয়া বেগমের মনে প্রতিনিয়ত আতঙ্ক কাজ করে। কখন যে নদীতে ভিটে হারাতে হয়। রাবেয়া বেগম বলেন, ‘বলতে গেলে নদীর মইধ্যে আছি। নদীর মইধ্যে ঘর। এই যে এই নদীটা, প্রায়ইতো বাড়ির কাছাকাছি। এক চাইনের দূরত্ব। পুকুরটা নদীতে পড়লে আর থাকা যাইবো না। কোন ঢাল কূল নাই আমাগো। সব কিছুরই সমিস্যা। কামাই রুজি নাই। ক্যামনে থাকি, ক্যামনে চলি। সরকারে চাল দেয়, ডাল দেয়, আমরা কিচ্ছু পাই না।’

চর কালকিনি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাইফুল্লাহ বলেন, নদী ভাঙনে কবলে কয়েকবার পড়েছি। কয়েকবার ইউনিয়ন পরিষদের ভবন বদল করেছি। নিজের বাড়িটাও আরেক ইউনিয়নে। ইউনিয়ন পরিষদও আরেক ইউনিয়নে। নদীভাঙন প্রতিরোধে বড় ধরণের কোনো প্রকল্পের বাস্তবায়ন না হবার কারণে এ সব সমস্যা দিন দিন বাড়ছে। আমরা আমাদের অস্তিত্ব নিয়েও শঙ্কায় আছি।

স্থানীয় নদী ভাঙন নিয়ে আন্দোলনরত সংগঠন, কমলনগর-রামগতি বাঁচাও মঞ্চের আহ্বায়ক, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আবদুস সাত্তার পালোয়ান বলেন, নদীতে ড্রেজিং না করা এবং বাঁধ না দেওয়ার কারণে এখানে ভাঙন থামছে না। নদী ভাঙনে প্রতিনিয়ত এখানকার মানুষ আশাহত হচ্ছে। নদী ভাঙা মানুষকে শুধুই আশা দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু সেটার বাস্তবায়ন হচ্ছে না। ১৭ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে এখানে নদী ভাঙছে৷ নদীর ভাঙন ঠেকাতে আমরা বিভিন্ন সময়ে নানা কর্মসূচি পালন করেছি। নদী ভাঙনে বেড়িবাঁধের পাশে, রাস্তার দ্বারে মানুষ মানবেতর জীবনযাপন করতেছে। দ্রুতই যদি ভাঙনের হাত থেকে রক্ষার কোনো উদ্যোগ না নেওয়া হয়, তাহলে বহু বছরে গড়ে ওঠা একটি জনপদ চিরতরে বিলীন হয়ে যাবে৷


ঢাকা/শান্ত

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়