ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

সিগারেট ছাড়ুন, চাইলেই পারবেন

মেসবাহ য়াযাদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৯:০২, ৩১ মে ২০২১  
সিগারেট ছাড়ুন, চাইলেই পারবেন

প্রতীকী ছবি

সিগারেট ছেড়ে দেওয়ার আজ বছরপূর্তি। গত বছরের এইদিনে সিগারেট ছেড়েছি।  কাকতালীয়ভাবে আজ ৩১ মে বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস। এই দিনটি উপলক্ষ করে কিন্তু সিগারেট ছাড়িনি।  ছেড়েছি বাধ্য হয়ে।  সে গল্পটাই বলছি।  সিগারেট ছাড়ার জন্য আপনার ইচ্ছে শক্তিটাই প্রথম এবং প্রধান কারণ হতে পারে। প্রবল ইচ্ছে থাকলে আপনিও আমার মতো ছেড়ে দিতে পারেন সিগারেটের নেশা।

দীর্ঘ ৩৬ বছরের নেশা ছিল আমার।  যা মিশে ছিল শরীরে।  অথচ গত এক বছর থেকে সহ্যই করতে পারছি না সিগারেটের গন্ধ। কী করে সিগারেট ছাড়লাম, তার আগে বলে নেওয়া দরকার- কী করে সিগারেট ধরলাম।

সরকারি চাকরিজীবী বাবার বদলির কারণে একদিন নারায়ণগঞ্জ ছেড়ে গ্রামের বাড়ি লক্ষ্মীপুর চলে যাই। সেখানে গিয়ে কলেজে প্রথম বর্ষে ভর্তি হই।  সে কলেজে একসাথে পড়তাম ছোটবেলার বন্ধু স্বপন, বাসু, মনু, শওকত, হারুন, আমি।  কলেজে দ্বিতীয় বর্ষে পড়ার সময় বন্ধু স্বপনের পাল্লায় পড়ে প্রথম সিগারেট ধরি। আমার জীবনের প্রথম সিগারেট ব্র্যান্ডের নাম ছিল স্টার।  তারপর ‘জন্ম থেকে জ্বলছি’র মতো সিগারেটের নিকোটিন নিতে থাকি। সেটা বিরতিহীনভাবে চলে। কেবল মাঝে মাঝে ব্র্যান্ড পরিবর্তন হয়।

স্টারের পর ক্যাপস্টান। এরপর গোল্ডলিফ। কদিন বাদে ট্রিপল ফাইভ। বেশ কয়েক বছর পরে আবার বদলাই। মনে আছে, সেই সময় বেনসন সিগারেটের একটা বিজ্ঞাপন ছিল জহর জুড়ে। বিশাল বিশাল বিলবোর্ডের মধ্যে। একটা ছেঁড়া-ফাটা জিন্সের প্যান্ট। ক্লিপ দিয়ে রোদে শুকাতে দিয়েছে একটা রশির মধ্যে। নিচে লেখা- ওয়ান অ্যান্ড অনলি। এক কোনায় লেখা- বি অ্যান্ড এইচ (বেনসন অ্যান্ড হ্যাজেস)। কী অসাধারণ সে আইডিয়া ছিল! এই বিজ্ঞাপন দেখেই ধরি বেনসন। এরপর বেনসন লাইট। তারপর বছর দু’য়েক ইজি লাইট। সেটা ছেড়ে মার্লবোরো লাইট এবং সবশেষ সিগারেটের ব্র্যান্ড ছিল- বেনসন প্লাটিনাম।

এবার কীভাবে সিগারেট ছাড়লাম, সে গল্প বলি। ২০২০ সালে বিশ্বময় করোনাকাল শুরু হয়। মার্চ মাসের শেষ দিকে আমাদের দেশেও ব্যাপক হারে সংক্রমণ শুরু হয়। ২৬ মার্চ থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য দেশের সবকিছু বন্ধ করে দেওয়া হবে বলে রাষ্ট্রীয়ভাবে ঘোষণা দেওয়া হয়। তার একদিন আগে লেখক বন্ধু, হাসান তারেক চৌধুরী তার কোম্পানি থেকে লোক মারফত আমার বাসায় এক কার্টন সিগারেট পাঠিয়ে দেন। আপদকালীন সময়ের জন্য।

লকডাউনের কারণে বাসায় বন্দি হয়ে যাই। হাসান ভাইয়ের দেওয়া সেই সিগারেট লুকিয়ে রাখি ওয়ারড্রবের ভেতর। বাসায় থেকে বেশি সিগারেট টানার সুযোগ একদম ছিল না। বাসা থেকে বেরুনোও যায় না। কোনো রকমে সকাল, দুপুর আর রাতে খাবারের পর একটা করে সিগারেট টানি। বারান্দায় গিয়ে, লুকিয়ে লুকিয়ে। আড়াই মাসের মতো সময় লাগে দশ প্যাকেট শেষ করতে।

এর মধ্যে রোজা আসে। রোজার পর ঈদ আসে। করোনাকালের এক অন্যরকম ঈদ কাটাই আমরা সবাই। ঈদের দু’দিন পরের ঘটনা। সেদিন আবার একটা লাইভ প্রোগ্রামে অংশ নিই।  সেটা শেষ হতে হতে রাত প্রায় সাড়ে এগারোটা বেজে যায়। খাওয়া-দাওয়া সেরে ডিভানে হেলান দিয়ে টিভি দেখছিলাম।  রাত প্রায় একটার মতো বাজে।  হঠাৎ মাথাটা চক্কর দিয়ে ওঠে।  চোখ বন্ধ করে শুয়ে পড়ি। কিন্তু মাথা ঘোরার পাশাপাশি ঘর, ঘরের আসবাবপত্রও ঘুরতে থাকে। সাথে আমাকে নিয়ে। রোলার কোস্টারের মতো।  অথবা বিল্ডিং বানানোর সময় মিকচার মেশিনে যেভাবে পাথর, বালি, পানি, সিমেন্ট ঘুঁটা দেওয়া হয়, সেরকম।  আসলে যত উপমাই দিই, ঠিক বোঝাতে পারব না!

আমার শরীর নিয়ে এই ‘অজ্ঞাত ঘূর্ণি’র কারণে কয়েক মিনিটের মধ্যে ছয়-সাতবার বমি করি। বাসার সবাই আমার এ অবস্থা দেখে ভয় পেয়ে যায়।  যাওয়ারই কথা। আমিও কম ভয় পাইনি।  শরীর একেবারে নেতিয়ে পড়ে। এরমধ্যে বড় ছেলেকে দিয়ে ডাক্তার বন্ধুকে ফোন করাই। উপসর্গ শুনে উনি বিপি আর সুগার মাপতে বলেন। কিন্তু মাপব কী করে! বাসায় তো সেসব মাপার মেশিন নেই! শোনার পর তিনি বমি আর মাথা ঘোরানো বন্ধের জন্য দুটো ট্যাবলেটের নাম বলেন।  পাশের কোনো হাসপাতাল থেকে লোক এনে তাড়াতাড়ি বিপি আর সুগার মাপাতে বলেন।  মাপামাপির সে রেজাল্ট তাকে জানালে পরবর্তী ওষুধ দেবেন।

বাবার এ অবস্থা দেখে ছেলে রোদ্দুর করোনাকালে, রাত দেড়টায় একা বাইরে যায়।  ফার্মেসি থেকে মাথা ঘোরানো আর বমি বন্ধের ট্যাবলেট নিয়ে আসে। ওষুধ খাইয়ে দেয় আমাকে। তারপর আবার গ্রিনলাইফ হাসপাতালে যাবে, লোক নিয়ে আসতে।  ওষুধ খাওয়ার পর আবারও বমি করি। ওষুধগুলো বমির সাথে বেরিয়ে যায়। মাথা আর পুরো শরীর তখনও ঘুরছে। ছেলে আবারও বেরিয়ে পড়ে। বুদ্ধি করে লোক না এনে, হাসপাতাল থেকে একটা অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে আসে। সাথে ড্রাইভারসহ দুজন লোক।  তারপর তিনজনে মিলে ধরাধরি করে আমাকে নামায়। পাঁচতলা থেকে। বিছানার চাদরে পেঁচিয়ে।  আমি নিজেকে ছেড়ে দিই ওদের হাতে।

এরপর কত কী! ইসিজি, এক্সরে, বিপি দেখা, রক্তের বিভিন্ন পরীক্ষা। ইতোমধ্যে রাত দুটো পেরিয়ে যায়। আমাকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়।  পরদিন শুক্রবার। মরার ওপর খাঁড়ার ঘা- করোনাকাল। তবুও পরদিন সকাল দশটার দিকে আমাদের অবাক করে দিয়ে মেডিসিনের অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ সাহেব এসে আমাকে দেখেন। এর মধ্যে সব টেস্টের রেজাল্টও চলে আসে। তিনি সব দেখে-শুনে আমাকে বলেন, ‘সব টেস্টের রিপোর্ট ভালো। দুশ্চিন্তা, ভালো ঘুম না হওয়ার কারণে হয়ত এমন হয়েছে। ওষুধের পাশাপাশি দুদিন বিশ্রাম নিন, ভালো খাবার-দাবার খান, ঠিক হয়ে যাবে।’

শুক্রবার সারাদিন হাসপাতালে ছিলাম। এছাড়া আমার করারও কিছু ছিল না।  ভাই-বোন- আত্মীয় যারা গত রাতে হাসপাতালে আসতে পারেননি, তারা দিনের বেলা এসেছেন। ভালোয় ভালোয় সেদিন গেল। রাত গেল। পরদিন আর রাতও গেল।  একটু ভালো বোধ করছিলাম। রোববার ডাক্তার সাহেব এসে পনেরো দিনের ওষুধ লিখে দিয়ে রিলিজ করে দেন আমাকে।  হাসপাতাল ছেড়ে বাসায় চলে আসি।  বাসায় ফেরার তিন চারদিন পর আস্তে আস্তে শরীরে ভারসাম্য ফিরে পাই।  ওষুধ, পথ্য, আর বিশ্রাম সমানতালে চলতে থাকে।

অসুস্থ হওয়ার দিন সাতেক পরে একদিন দুপুরে খাওয়ার পর সিগারেটের খুব তেষ্টা পায়। বাসার লোকজনকে লুকিয়ে ওয়ারড্রব খুলি। পুরো ওয়ারড্রবের ভেতরে আমার সব জিনিসপত্র ঠিকঠাক আছে। কেবল সিগারেটের প্যাকেটটা নেই। যার ভেতরে দশ-বারোটা সিগারেট ছিল। নেই তো নেইই।  কী আর করা।  লাজ শরমের মাথা খেয়ে বউয়ের কাছে জানতে চাই।  শুনে সে যেন আকাশ থেকে পড়ে। এমন ভাব করলো, যেন সিগারেট কী জিনিস, দেখতে কেমন- তার কিছুই জানে না।  অবশেষে গোয়েন্দা লাগাই আমি।  ছোট ছেলে সমুদ্দুর কানে কানে এসে গোয়েন্দা রিপোর্ট জানায়, ‘বাবা, সিগারেটের প্যাকেট মা এখান থেকে নিয়ে গেছে...।’
‘নিয়ে গিয়ে কী করেছে?’
‘তা তো জানি না, বাবা...!’
এরপর আর কোন প্রশ্ন করে লাভ নেই। যা বুঝার, বুঝে যাই।
এবার স্ত্রী মুখ খোলেন।  বলেন, ‘ফেলে দিয়েছি...।’

আমার কিন্তু তার কথা বিশ্বাস হয় না।  তারপরও করোনা আর শারীরিক দুর্বলতার কারণে, সিগারেট কিনতে পাঁচতলা থেকে নিচে নামার সাহস পাই না। পরপর কয়েকদিন খাবার পরে সিগারেট চাই তার কাছে। কী ভাবছেন, সিগারেটের নেশার কারণে? তা পুরোপুরি ঠিক না। নেশাতো আছেই। তার ওপর ভাবুন একবার, দশ-বারোটা সিগারেট! এভাবে নষ্ট হয়ে যাবে? আপনারা যারা ধুমপায়ী না, তারা এ কষ্ট আর মায়া বুঝবেন না! কিন্তু আমার স্ত্রী অনঢ়, অটল। পাহাড়ের মতো। আমাকে সিগারেট দেবেই না, সম্ভবত এমন প্রতিজ্ঞা করেছে সে!

কী আর করা! রাগে, দুঃখে, ক্ষোভে, কষ্টে আর অভিমানে তার কাছে আর সিগারেট চাই না।  ২০২০ সালের ৩১ মে হাসপাতালে যাওয়ার দিন রাতে শেষ সিগারেট টেনেছিলাম।  তারপর সেই যে জেদ করে সিগারেট টানা ছেড়েছি, এখনও সেটা আর ধরিনি। এর মধ্যে বাসার বাইরে একবার গিয়েছি পাঁচদিনের জন্য। আরেকবার দুদিনের জন্য। পর্যাপ্ত সুযোগ থাকলেও সিগারেট আর ছুঁয়েও দেখিনি।  আশেপাশের অনেক বন্ধুরা টানছে। কিন্তু আমার নিজের একবারও সিগারেট টানার ইচ্ছে হয়নি। প্রতিজ্ঞা করছি, জীবনে কোনোদিন আর সিগারেট ঠোঁটে ছোঁয়াব না।

আপনাদেরও অনুরোধ করছি, যারা ধরেননি, তারা ধরবেন না। আর যারা সিগারেটে অভ্যস্ত, তার ছেড়ে দিন।  হিসেব করে, দিন দিন কমিয়ে সিগারেট ছাড়তে পারবেন না।  ছাড়তে হবে হঠাৎ করেই।  প্রচণ্ড মনোবল থাকলেই সেটা আপনি পারবেন। পারতেই হবে। এই বাজে অভ্যাস আপনার সব ধরনের ক্ষতি করছে। তো, শুরু হোক আজ থেকেই। সিগারেটকে না বলুন।  সুস্থ থাকুন।

লেখক: গদ্যকার, গণমাধ্যমকর্মী

ঢাকা/এসবি

সম্পর্কিত বিষয়:

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়