ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

মানুষ ফিরতে চায় বিস্ময়-ভরা শৈশবে

এস এম জাহিদ হাসান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:০০, ১৭ মে ২০২৩   আপডেট: ১৪:১০, ১৭ মে ২০২৩
মানুষ ফিরতে চায় বিস্ময়-ভরা শৈশবে

একটি ভ্রূণ মানব শিশুরূপে জন্মগ্রহণ করার পর পৃথিবীর আলো-বাতাস আর প্রিয় মানুষের সান্নিধ্যে বড় হতে থাকে। একটা বয়স পর্যন্ত সেসব স্মৃতির সে কিছুই মনে রাখতে পারে না। এই সময়টাকে প্রাক্-শৈশব বা প্রাথমিক পর্যায় ধরা যেতে পারে। 

এ সময়ের অভিজ্ঞতা নিয়ে শিশু প্রবেশ করে শৈশবে। সে সামগ্রিক পরিবেশের ভেতরে নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখতে পায়। একে একে জীবনে যুক্ত হয় শৈশব, কৈশোর, তারুণ্য, পৌঢ়ত্ব এবং সবশেষে বার্ধক্যের অভিজ্ঞতা। জীবনের প্রতিটি ধাপে আলাদা আলাদা প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি আছে। একেকটি ধাপ একেক রকম স্বপ্ন নিয়ে হাজির হয়। কোনো কোনো ধাপে পাওয়া আর না-পাওয়ার অনুভূতি জীবনের ধারাপাত মিলিয়ে দেয়। তবুও কোথায় যেন অপূর্ণতা!

আমরা এই অপূর্ণতার খোঁজ পেতে শুরু করি সাধারণত শৈশবের পর থেকে। বলে রাখা দরকার শিশু অধিকার কনভেনশনের প্রথম অনুচ্ছেদে উল্লেখ রয়েছে: ‘১৮ বছরের কম বয়সী সকল মানুষই শিশু।’ বাস্তবতা এবং বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে শিশুর বেড়ে ওঠা এবং সামাজিক অভিযোজন যদি দেখি, দেখা যাবে যে একটি শিশু যখন বুঝতে শেখে; তিন-চার বছরের পর থেকে বারো বছর পর্যন্ত- এ সময় তাকে ঘোরগ্রস্ত করে রাখে। আমার মনে হয়, এ সময় একটি শিশু যা কিছু দেখে সেই দেখার সঙ্গে তার বোঝাপড়া মিলিয়ে বিস্ময় নিয়ে দেখে। সেই দেখা তার মনের মধ্যে গেঁথে থাকে। তার দেখার বাইরেও যেসব সুন্দর দৃশ্য রয়েছে সেসব তার বিবেচ্য নয়। কারণ সে তো সেগুলো দেখেনি! মানবশিশু শৈশবে যা দেখে, বোঝে সব কিছুতে শুধু বিস্ময় আর বিস্ময়! ফলে পুরো জীবনের রং, রূপ, গন্ধ শৈশব দ্বারা আক্রান্ত এবং মোহগ্রস্ত। 

কোনো মানুষকে যদি প্রশ্ন করা হয়- জীবনের কোন সময়ে ফিরে যেতে চান? আমার মনে হয় ৯৮ শতাংশ মানুষ বলবেন- শৈশবে ফিরে যেতে চাই। শৈশবের স্মৃতি রোমন্থন আমাদের সাধারণ চর্চার বিষয়। শৈশবের একটি সুন্দর দৃশ্যের বর্ণনা দিতে দিতে আমাদের চোখ চিক্চিক্ করে ওঠে। আমাদের হৃদয়ে আনন্দের অনুরণন ছড়িয়ে পড়ে। মন অজান্তেই খুশিতে ভরে ওঠে। পূর্ণ প্রতিযোগিতামূলক জীবনে চলার পথে একটু স্মৃতি রোমন্থন আমাদের সবুজ ও সতেজ করে তোলে।

শৈশব ছেড়ে ক্রমে কৈশোর, তারুণ্যের পথে হেঁটে যাওয়া প্রাকৃতিক নিয়ম। কিন্তু শৈশব আমাদের সঙ্গেই থেকে যায়। সুখে, দুঃখে, স্থিরতায়, মগ্নতায়, অনুভবে বারবার তার দেখা পাওয়া যায়। মানুষ চিন্তাশীল এবং সুন্দরের পূজারী। সম্ভবত সে কারণেই চিন্তায় চেতনায় বারবার ফিরে আসে শৈশবের দিনগুলো। হতে পারে সেখানে সব প্রাপ্তি সুখের প্রাপ্তি নয়, কিন্তু প্রথম প্রাপ্তিগুলো থাকে শৈশবের অনেকখানিজুড়ে। 

আর সব প্রথমের অসাধারণ ক্ষমতা আছে মানুষকে ভাবিয়ে তোলার এবং বিস্মিত করার। শৈশবের স্মৃতিবিজড়িত গ্রাম, শহর, নদী, মাঠ এগুলো যেন একেকটি বিস্ময়কর সুন্দরের বৈশিষ্ট্য। পরে দেখা অনিন্দ্য সুন্দরও সেসব সুন্দরকে ছাড়িয়ে যেতে পারে না! কিন্তু মানুষের ফেরার কথা ছিল তারুণ্যে-যৌবনে। কেউ কেউ হয়তো বলে থাকেন যৌবনে ফেরার কথা। তাদের সংখ্যাটা খুব বেশি হবে না। বাকি ধাপগুলো বাদই দিলাম! একটি শিশু শৈশবকাল থেকে একের পর এক সম্পর্কের নতুন নতুন মানে খুঁজে পায়। ব্যতিক্রম গল্পগুলো বাদ দিলে এই সময় শিশুর জীবনে শুধু প্রাপ্তি আর প্রাপ্তি। 

দাদা, দাদি, নানা, নানি, খালা, ফুফু, চাচি- সবার সঙ্গে সে আন্তঃসর্ম্পকীয় সংযোগের মধ্যে দিয়ে বড় হয়। শৈশবে আত্মীয়-স্বজনের মৃত্যু সে খুব একটা দেখে না। বরং নতুন অনেক মুখ চারপাশে সে দেখে। তারই হয়তো ছোট ভাই-বোন জন্মগ্রহণ করে। ফলে এক আনন্দ অভিজ্ঞতা অর্জন করে। অনেকের মামা বিয়ে করে নতুন মামি নিয়ে আসে। এ সময় প্রাপ্তিগুলো চমকে ভরা। সম্পর্ক ভেদে সবাই কিন্তু আলাদা কেয়ার নেয় শিশুটাকে। অনেক সময় দেখা যায় যে, বাড়িতে নতুন জামাই এলো, ছোট শিশুটিকে নিয়ে সে কোনো মেলায় গেল অথবা স্থানীয় বাজারে ঘুরল। এই স্মৃতিগুলো শিশুর মনে অমলিন থাকে।

ছোটবেলায় একটি শিশু যে শিক্ষা পায় তা আনন্দময় ভ্রমণের মতো। সেই সময়ে ছড়া, গল্পগুলো থাকে সহজবোধ্য, ছন্দমিলের। আমরা ছোটবেলায় বইয়ের পাতায় যেসব ছড়া ও গল্প পড়েছি সেগুলো মনে গেঁথে আছে। অর্থাৎ সে প্রথম যে গানটি শুনেছে, যে কবিতাটি পড়েছে সেটা সে ভুলবে না। যে প্রকৃতির মধ্যে শিশু বড় হয় সেই প্রকৃতি, পরিবেশ, মানুষে মানুষে সম্পর্ক শিশুর মধ্যে এমন প্রভাব ফেলে যা ভুলে যাওয়া যায় না। এরপরেই সে আত্মীয় বিয়োগের কষ্ট পায়। কৈশোরে বা তারুণ্যে একজন মানুষ কাছের মানুষ বা চেনা মানুষকে পৃথিবী থেকে চিরতরে চলে যাওয়ার দৃশ্য দেখে। জীবন ক্রমান্বয়ে হতে থাকে জটিল। চাওয়া-পাওয়ার সমীকরণ জীবনের জটিলতা আরো বাড়িয়ে তোলে। এরপর টিকে থাকার যুদ্ধটা ক্রমে একা একজনের হয়ে ওঠে। দেখা যায়, যে মানুষগুলো তাকে শৈশবে আদর-যত্ন করত; সেই মানুষগুলোর চেহারা পাল্টে যাচ্ছে। হয়তো শৈশবে যে মামা বা চাচা খুব আদর করতেন সেই মামা-চাচার আচরণও পরিবর্তন হয়। কারণ সেই সময়ে হয়তো তাদের সংসার ছিল না। এরপর যখন তাদের সংসার- সন্তান হয় স্বাভাবিকভাবেই তাদের আচরণে পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। 

কিন্তু যে তাদের ভালোবাসায় বেড়ে উঠেছে সে সেই সময়ে বারবার ফিরে যেতে চায়, ধরে রাখতে চায়। কিন্তু পারে না। তখন শৈশবটা আরও মনে পড়ে। ক্রমে জটিল হওয়া জীবনে যখন একজন মানুষ পেছনে ফিরে তাকায়, শৈশবের দৃশ্যগুলো, মানুষগুলো, সেই সময়ের প্রকৃতি সব কিছু তাকে টানে। সে জন্যই হয়তো আমরা ফিরে যেতে চাই শৈশবের সোনালি দিনে। জীবনের জটিলতা আমাদের যত গ্রাস করে আমরা শৈশবের নির্মলতা তত বেশি করে অনুভব করি। কখনও হাহাকারের মতো বাজে শৈশবে ফিরে যেতে না পারার আক্ষেপ। কারণ শৈশবে ফিরতে চাওয়ার মানে জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়া সুন্দরের খোঁজ পাওয়া।

তারা//

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়