অন্ধকবির আলোয় আলোকিত বিশ্বসাহিত্য
মিলন আশরাফ || রাইজিংবিডি.কম
হোমার, রুদকি ও জন মিল্টন
মিলন আশরাফ : যে ক’জন মহাকবি বিশ্বসাহিত্য সমৃদ্ধ করেছেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম তিনজন হোমার, জন মিল্টন ও রুদকি। অবাক করা বিষয় হলো, এদের কারও স্বাভাবিক দৃষ্টিশক্তি ছিল না। পৃথিবীতে এমন অনেক বিখ্যাত আছেন বা ছিলেন যাঁদের কেউ জন্মগতভাবে অথবা জীবনের এক পর্যায়ে এসে দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছেন। এই তালিকায় অনেকের নামই উল্লেখ করা যায়। যেমন আরবি সাহিত্যের খ্যাতিমান কবি বার্শা শার বিন বোরদ, সিরিয়ার আবুল আলা আল-মা’আরবি, মিশরের বিশিষ্ট লেখক তাহা হোসাইন, লেখিকা হেলেন কেলার, বাংলার চিত্রকর বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়। তবে এই নিবন্ধে আমরা দৃষ্টিশক্তিহীন সেরা তিন মহাকবির কথা বলার চেষ্টা করবো।
হোমার : তিনি ছিলেন আমাদের লালন ফকিরের মতো চারণ কবি। তার জন্ম-পরিচয় নিয়ে সে সময় অনেকের মনেই সংশয় ছিল। সেই সংশয় এখনও দূর হয়নি। হোমার তার লেখায় মহাবীর অ্যাকিলিস, অ্যাজাক্স, অ্যাগামেনন, ডায়োমেডিস ও অডিসির বংশ পরিচয়ের সবিস্তারে বর্ণনা দিলেও নিজের পরিচয় গোপন করেছেন। তবে ইতিহাসবিদ হিরোডোটাস জানান, মোটামুটি খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম শতকে জন্মগ্রহণ করেন হোমার। আবার কেউ কেউ বলেন, ট্রয় যুদ্ধের সময়ে অর্থাৎ খ্রিস্টপূর্ব দ্বাদশ শতকে তাঁর জন্ম হতে পারে।
তাঁর জন্মস্থান নিয়েও আছে বিভ্রম। তিনি চারণ কবি হওয়ায় কোনো জায়গায় স্থির থাকেননি। ভ্রমণের খুব বাতিক ছিল। সব চারণ কবির ক্ষেত্রে যা হয় আর কি। তবে গবেষকরা বলেন, স্মর্ণা, কলোফিন, কিয়স, এথেন, আর্গস, ইথাকা, রোডস ও সাইপ্রাস এই আটটি জায়গার যে কোনো একটিতে তিনি জন্মগ্রহণ করেছেন। লুসিয়ান নামে এক ইতিহাসবিদ জানান অন্য তথ্য। তিনি দাবি করেন, হোমার ব্যাবিলীয়। এর পেছনে তিনি যুক্তি দেখান, হোমার নামটা পরে দেওয়া হয়, যখন গ্রিক রাজা তাকে বন্দি করেন। ‘হোমার’ শব্দটি বিশ্লেষণ করে তিনি এ তথ্য দেন। অর্থাৎ হোমার শব্দের অর্থ বন্দি বা আটককৃত এই অর্থে তিনি তার যুক্তি খাড়া করেন। তবে অন্যান্য ইতিহাসবিদ ও জনগণ তার মতের বিরুদ্ধে।
অধিকাংশ ইতিহাসবিদের মতে, তিনি এশিয়া মাইনরের আইয়ন অঞ্চলের স্মর্ণা নামক এলাকা থেকে এসেছেন। এখন পর্যন্ত এটিই সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য ও প্রচলিত। হোমার যে মুখে মুখে কবিতা বলতেন, এটা তিনি তার বাবার কাছে থেকে পেয়েছিলেন। কারণ বাবাও ছিলেন চারণ কবি। বাবার কাছ থেকে জ্ঞানের দীক্ষা নেন মহাকবি হোমার।
জানা যায়, হোমারের কণ্ঠ খুব সুমধুর ছিল। তিনি বীণাবাদন সহকারে গান গাইতেন। কোনকিছুই আগে থেকে লেখা থাকতো না। বলা যায় রীতিমত গানের মজমা বসতো তখন। এক নাগাড়ে সাতদিন পর্যন্ত চলতো মজমা। হোমার প্রায়ই বীরদের জীবনগাঁথা নিয়ে পদ রচনা করতেন। এর ফলে বিশ্বভা-ারে যোগ হয়েছে দুইটি মহাকাব্য ‘ইলিয়াড’ ও ‘অডিসি’।
হোমার অন্ধ ছিলেন, তবে জন্মান্ধ নন। সেকালে রাজাবাদশারা কবিদের জোরপূর্বক আটকে রাখতেন। সামন্তবাদী রাজারা চারণ কবিদের গান শুনতে ভালবাসতেন। তারা চাইতেন, চারণ কবিরা শুধু তাদের জন্য পদ রচনা করবে ও গাইবে। মুক্তভাবে কাউকে গাইতে দিতেন না তারা। অনেককে জোর করে আটকে রেখে অন্ধ করে দিতেন। ধারণা করা হয়, হোমার বোধহয় এভাবেই অন্ধ হয়েছেন। তবে বিষয়টি এখনো রহস্যই রয়ে গেছে।
হোমারের রচনাগুলো প্রথমে খুবই অগোছালোভাবে ছিল। গবেষকরা বলেন, খ্রিস্টপূর্ব ২৫০ অব্দে সামোথাসের অ্যারিস্টার্কাস নামক এক ব্যক্তি ইলিয়াড ও অডিসি সম্পর্কিত রচনাগুলো সংকলন করেন। রচনাগুলোকে দুটি মহাকাব্যে ভাগ করে প্রত্যেকটি মহাকাব্যকে চব্বিশটি পর্বে ভাগ করেন। ট্রয় যুদ্ধ নিয়ে রচিত কাহিনীর নামকরণ করেন ইলিয়াড আর নিজ দেশে বা রাজ্যে ফিরে আসার কাহিনীরক নামকরণ করেন অডিসি।
পাঠকদের এখানে একটি ব্যাপার জেনে রাখা ভাল, ইলিয়াড ও অডিসি একই ব্যক্তির লেখা এটা ৩৫০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত মানুষ জানতেই পারেনি। এর আগের সময়ের মানুষ ধারণা করতো, একই সময়ে দুজন বিখ্যাত ব্যক্তির লেখা ইলিয়াড ও অডিসি। তবে দুটোর ভেতরে গঠনগত মিল থেকেই কেউ কেউ যে একই ব্যক্তির রচনা ভাবতো না, সেটি কিন্তু নিশ্চিত করে বলা যাবে না। ইলিয়াড ও অডিসি আলাদা দুটি মহাকাব্য হলেও কাহিনী কিন্তু খুবই কাছাকাছি। বিষয়টি হলো, রানী হেলেনের অপহরণ ও ট্রয়ের যুদ্ধ।
হোমারের লেখনি শক্তি এতই প্রখর যে সহস্রাব্দ পরেও এর রসসূধা সকলকে মোহিত করে। এটা বলা অন্যায় হবে না যে, গ্রিক সাহিত্যের মূল উৎসই হোমারের রচনাসমূহ। পরবর্তীকালের লেখকদের মধ্যে হোমারের প্রভাব ছিল লক্ষ্যণীয়। বিশ্বসাহিত্যের এতো টানটান উত্তেজেনা আর কারোই লেখায় তেমন ফুটে ওঠেনি। সে কারণেই হোমার যুগ যুগ ধরে টিকে থাকবে। আমরা অবাক হয়ে লক্ষ্য করি, হোমার দেব-দেবীর ভেতরও মানবীয় চরিত্রের বিকাশ ঘটিয়েছেন চমৎকারভাবে। তিনিই প্রথম অলিম্পাস পর্বতের দেব-দেবীর সঙ্গে মিলন ঘটান মর্তমানবদের। তাদের মিলনের মাধ্যমে জন্মদান করান মহাবীর একিলিসের। যুদ্ধের ওপর ভিত্তি করে মহাকাব্য দুটির জন্ম হলেও এখানে আমরা দেখতে পাই প্রেম ও মিলনের জয়জয়কার। এরিস্টটলের মতে, ‘হোমারের ইলিয়াড শুধু মহাকাব্য নয়, বিশ্বের প্রথম সার্থক ট্রাজেডি।’
জন মিল্টন : ‘প্যারাডাইজ লস্ট’ মহাকাব্যের নাম শোনেননি এ রকম পাঠক পাওয়া দুষ্কর। বাইবেলের কাহিনী উপজীব্য করে লেখা হয় মহাকাব্যটি। ১৬৬৭ খ্রিস্টাব্দে এটা আলোর মুখ দেখে। মহাকাব্যটি আলোর মুখ দেখলেও যিনি এর স্রাষ্টা তিনি কিন্তু এটা দেখতে পাননি। দেখবেনই বা কেমন করে! তিনি তখন দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেছেন। হ্যাঁ, মহাকবি জন মিল্টনের কথা-ই বলা হচ্ছে। ১৬০৮ খ্রিস্টাব্দের ৯ ডিসেম্বর লন্ডনে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। নানা বৈচিত্রে ভরা ছিল মিল্টনের জীবন। কাব্য তো বটেই গদ্যসাহিত্যেও তিনি ছিলেন অতুলনীয়।
বাংলাসাহিত্যে মাইকেল মধুসূদনের মহাকাব্য মেঘনাদবধ কাব্য এই প্যারাডাইজ লস্ট-এর অনুপ্রেরণায় লেখা। মিল্টনের জীবন নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে। জানা যায়, ছাত্রজীবন থেকেই নিয়মিত লিখতেন তিনি। ল্যাটিন, গ্রিক, হিব্রু ভাষার সাহিত্যও তার নখদর্পণে ছিল। কলেজে পড়ার সময় তাঁর প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়। সালটা ছিল ১৬২৬। এরপর ভ্রমণের নেশা পেয়ে বসে। তিনি ১৬৩৮ সালে ইউরোপ ভ্রমণে বের হন। সেই সময়ে তিনি ইতালিতেও কয়েকমাস কাটিয়ে ১৬৩৯ সালের জুলাইয়ে ইংল্যান্ড এসে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। মিল্টন ১৬৪৩ সালে ম্যারি পাওয়েলের সঙ্গে গাঁটছাড়া বাঁধেন। তবে তাঁর সঙ্গে মিল্টনের খুব বেশি বনিবনা হতো না। যার কারণে কবি তাঁর মনোযোগ দেশের দিকে ফেরান। দেশে তখন গৃহযুদ্ধ চলছে। পার্লামেন্টের সমর্থনে তিনি গদ্য রচনা করছেন প্রতিনিয়ত। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা বিষয়েও তাঁর লেখা বের হতে লাগল। এ বিষয়ে তিনি অ্যারোপাগিটিকা (Areopagitica, ১৬৬৪) নামে একটি গ্রন্থও লিখলেন। বইটি ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করল। গৃহযুদ্ধের পর ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম চার্লসকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। এই মৃত্যুদ-কে কেন্দ্র করে জন মিল্টন লেখেন আরেক বিখ্যাত রাজনৈতিক পুস্তিকা ‘দ্য টেনিউ অব কিংস অ্যান্ড ম্যাজিস্ট্রেটস’ (The Tenure of Kings and Magistrates,১৬৪৯)।
রাজার করুণ পরিণতি ও জনগণের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারের প্রসঙ্গ ছিল বইটির প্রধান উপজীব্য। এর পুরস্কার হিসেবে তিনি পান ক্রমওয়েল কাউন্সিল অব স্টেটের পক্ষ থেকে বিদেশি ভাষা বিষয়ক সচিব পদ। একই সঙ্গে তিনি ‘মারকিউরিয়াস পলিসাস’ (Mercurius Polilicus) পত্রিকার প্রধান সম্পাদক হিসেবে যোগদান করেন। মূলত এতো কাজের চাপে ধীরে ধীরে তার দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ হয়ে আসতে থাকে। অবশেষে ১৬৫২ সালে পুরোপুরি অন্ধ হয়ে যান তিনি।
রুদকি : ফার্সি সাহিত্যের জনক বলা হয় এই জন্মান্ধ কবিকে। নবম শতাব্দির (৮০০-৯০০) শেষের দিকে সমরখন্দের রুদাক জেলায় জন্মগ্রহণ করেন তিনি। ফার্সি সাহিত্যে একটি প্রবাদ আছে যে, সাতজন কবির কবিতা রেখে বাকিগুলো ফেলে দিলেও ফার্সি সাহিত্যের তেমন ক্ষতি হবে না। সেই সাতজনের মধ্যে রুদকি অন্যতম প্রধান। অপর ছয়জন হলেন, ফেরদৌসী, হাফিজ, নিজামী, মাওলানা রুমি, শেখ সাদী এবং কবি জামী। কবি হোমারের মতো রুদকিও স্বভাব কবি ছিলেন। দিনের পর দিন মজলিসে কিংবা রাস্তায় দাঁড়িয়ে অনর্গল কবিতা বলতে পারতেন। তার স্মরণশক্তি এতো প্রখর ছিল যে, একবার যা বলতেন পরে হুবহু সেটা বলে দিতেন। তিনি যখন কবিতা আওড়াতেন তাঁর ভক্তরা লিখিত রূপ দিতো। কবিতা, দীর্ঘ কবিতা ও গজল মিলে তিনি প্রায় তেরো লাখ কবিতা লিখেছেন। এটা খুব অবাক করার তথ্যই বটে!
রুদকির বেশিরভাগ কবিতা সহজ-সরল ভাষায় রচিত ও নানা উপদেশে ঠাসা। উদাহরণ হিসেবে এই কবিতাটি লক্ষ্য করুন-
জীবন আমাকে দিয়েছে ঢের শিক্ষা
শিক্ষার কাছে জীবন নেয় যে দীক্ষা
অপরের সুখে হয়ো না তুমি দুখি
তোমার সুখেও হবে না কেউ সুখি।
জানা যায় রুদকি শুধু ভালো কবি নন, ভালো গায়কও ছিলেন। বেহালায় সুর তুলে নিজের লেখা গজল এমন সুন্দর করে গাইতেন যে, সবাই তন্ময় হয়ে শুনতো। রুদকি আরবি ভাষায়ও প-িত ছিলেন। তিনিই প্রথম বিখ্যাত শিশুতোষ গল্পগ্রন্থ ‘কালিমা ওয়া দিমনা’ ও ‘আলিফ লায়লা’ ফার্সিতে অনুবাদ করেন। একজন অন্ধ হয়ে এতো কিছু করা কীভাবে সম্ভব এই প্রশ্নের উত্তরে রুদকি বলেছিলেন, ‘জীবনযুদ্ধে জয়লাভের জন্য যেসব হাতিয়ারের প্রয়োজন, অন্ধত্ব হচ্ছে সেসবের একটি। অন্য সব হাতিয়ার ধারালো থাকলে একটির অভাব আসলে কোনো অভাব নয়।’
রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৬ অক্টোবর ২০১৫/তারা
রাইজিংবিডি.কম