ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

হাত বদলে প্রশ্নপত্র লাখ থেকে কোটি টাকায় বিক্রি

মামুন খান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:১৮, ২৮ নভেম্বর ২০২২   আপডেট: ১০:৩৭, ২৮ নভেম্বর ২০২২
হাত বদলে প্রশ্নপত্র লাখ থেকে কোটি টাকায় বিক্রি

গ্রেপ্তার হওয়া আসামিরা। ফাইল ছবি

সর্বোচ্চ পর্যায়ে যাচাই-বাছাই ও সতর্কতা অবলম্বন করেই আহসানউল্লাহ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে রাষ্ট্রায়ত্ত পাঁচ ব্যাংকের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র মুদ্রণের দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু সেখান থেকে কিছু অসাধু কর্মচারীর লোভের কারণে ফাঁস হয়ে যায় প্রশ্ন। আর এতে কপাল পোড়ে লক্ষাধিক শিক্ষার্থীর। প্রশ্নফাঁসের অভিযোগ ওঠায় সরকারি পাঁচ ব্যাংকের নিয়োগ পরীক্ষা বাতিল করে বাংলাদেশ ব্যাংক।

এদিকে অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে প্রতারকরা আটকপড়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জালে। আর সেই জালিয়াতি চক্রের কাছ থেকেই বেরিয়ে আসে ভয়াবহ তথ্য। প্রেস থেকে কর্মচারীর মাধ্যমে যে প্রশ্নপত্র লাখ টাকায় বের হয়, সেটি মাত্র কয়েকজনের হাত বদলেই দুই কোটি টাকার অধিক মূল্যে বিক্রি হয়।

রাষ্ট্রায়ত্ত পাঁচ ব্যাংকের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসের অভিযোগে রাজধানীর বাড্ডা থানায় মামলায় গত ১০ নভেম্বর পৃথক দুটি চার্জশিট দাখিল করে ডিবি পুলিশ। পাবলিক পরীক্ষা আইনে ১৫ জনকে এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় ১২ জনকে অভিযুক্ত করে চার্জশিট দাখিল করেন তদন্ত কর্মকর্তা তেজগাঁও জোনাল টিমের সাব-ইন্সপেক্টর শামীম আহমেদ। আদালতে দেওয়া আসামিদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি পর্যালোচনায় চার্জশিটে অর্থের বিষয়টি তুলে ধরেন তদন্ত কর্মকর্তা।

চার্জশিটভুক্ত আসামিরা হলেন-আহ্ছানউল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইসিটি টেকনিশিয়ান মুক্তারুজ্জামান রয়েল, অফিস সহায়ক (পিয়ন) দেলোয়ার হোসেন, কর্মী রবিউল আউয়াল, জনতা ব্যাংকের গুলশান শাখার কর্মকর্তা শামসুল হক শ্যামল, রূপালী ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার জানে-আলম মিলন, পূবালী ব্যাংকের ইমামগঞ্জ শাখার প্রিন্সিপাল অফিসার মো. মোস্তাফিজুর রহমান, ঢাকা কলেজের সাবেক শিক্ষার্থী আব্দুল্লাহ আল জাবের ওরফে জাহিদ, পারভেজ মিয়া, মিজানুর রহমান মিজান, মোবিন উদ্দিন, সোহেল রানা, পরীক্ষার্থী রাইসুল ইসলাম স্বপন, রাশেদ আহমেদ বাবলু, জাহাঙ্গীর আলম জাহিদ ও রবিউল ইসলাম রবি।

মোস্তাফিজুর রহমান, পারভেজ ও সোহেল বাদে অপর ১২ আসামির বিরুদ্ধে একই অভিযোগে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে চার্জশিট দাখিল করা হয়েছে।

জনতা ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার এমদাদুল হক খোকন বিরুদ্ধে অপরাধ প্রমাণিত না হওয়ায় তাকে অব্যাহতির সুপারিশ করেন তদন্ত কর্মকর্ত। সম্রাট, রব্বানী, রুবেল, আপন, উজ্জল, রাকিব, কাফি, নাদিম, রাজিব, লিটু, সবুজ, আলমাস আলী, মাইনুল, আতিক, মুকুল, জাকির, হেলাল ও মিঠুসহ অজ্ঞাতনামা ২৫/৩০ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হলেও তদন্তকালে উপযুক্ত ও প্রয়োজনীয় তথ্যের অভাবে আসামিদের পূর্ণাঙ্গ নাম ঠিকানা উদঘাটনসহ গ্রেপ্তার করা সম্ভব না হওয়ায় তাদের মামলা থেকে অব্যাহতির সুপারিশ করা হয়।

শ্যামল, মুক্তারুজ্জামান, দেলোয়ার, রবিউল ও পারভেজ মিয়া আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি পর্যালোচনায় চার্জশিটে তদন্ত কর্মকর্তা শামীম আহমেদ বলেন, শ্যামল তার জবানবন্দিতে জানান, দেলোয়ার, পারভেজ এবং মোক্তার তার পূর্বপরিচিত।  তাদের মাধ্যমে জানতে পারেন ৫টি ব্যাংকের অফিসার ক্যাশ পদের প্রশ্ন তৈরি করার কাজ টেন্ডারের মাধ্যমে আহসান উল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় পেয়েছে। তারা পরীক্ষার প্রশ্ন এবং উত্তর পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার আগের রাতে ফাঁস করবে। সে জানে আলমকে পরীক্ষার্থী সংগ্রহ করতে বলে। জানে আলম পরীক্ষার আগের রাতে চার জন পরীক্ষার্থী নিয়ে তার কাছে আসে। পরীক্ষাদের নিয়ে সে মোক্তারের বাসায় যায়। সেখানে দেলোয়ার, পারভেজ ও মোক্তার গত বছরের ৬ নভেম্বর সকাল ৭টা থেকে ৯ টা পর্যন্ত পরীক্ষার্থীদের ফাঁস করা প্রশ্ন এবং উত্তর মুখস্ত করায়। প্রশ্ন-উত্তরের সাথে পরীক্ষার প্রশ্ন ও উত্তর হুবহু মিল আসে। এর আগে ৪ নভেম্বর মিলন শ্যামলকে এক লাখ টাকা দেয়। সেখান থেকে মোক্তারকে ৫০ হাজার টাকা দেয় সে।

মুক্তারুজ্জামান জবানবন্দিতে জানান, সে আহসান উল্লাহ ইউনির্ভাসিটিতে টেকনিশিয়ান হিসেবে চাকরি করতো। দেলোয়ার ও পারভেজ তার সাথে কাজ করতে। তারা জানায়, ৫টি ব্যাংকের অফিসার ক্যাশ পদের প্রশ্ন এবং উত্তর ফাঁস করতে পারবে। তাই সে শ্যামলকে পরীক্ষার্থী সংগ্রহ করতে বলে। সে পরীক্ষার্থীদের নিয়ে মোক্তারের বাসায় এনে পরীক্ষার্থীদের ফাঁস করা প্রশ্ন এবং উত্তর মুখস্ত করায়। প্রশ্ন-উত্তরের সাথে পরীক্ষার প্রশ্ন ও উত্তর হুবহু মিল ছিল।

দেলোয়ার জানান, ২০২১ সালে আহসান উল্লাহ ইউনির্ভাসিটির কাজী শফিকুল ইসলাম স্যারের অফিসের পিয়নের কাজ পান তিনি। এই বিশ্ববিদ্যালয় ব্যাংকসহ বিভিন্ন চাকরির পরীক্ষার প্রশ্ন ছাপা ও পরীক্ষার টেন্ডার পায়। প্রশ্ন ছাপার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়েল ছাপাখানায় সেও যেত। মুক্তারুজ্জামান ও পারভেজ তাকে বিভিন্ন প্রলোভন দেওয়ায় সে প্রেসের রবিউলের সাথে তাদের পরিচয় করিয়ে দেয়। সে কাউকে প্রশ্নপত্র এনে দেয়নি ও কোনো টাকা পায়নি। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অল্প টাকায় পরীক্ষার টেন্ডারগুলো আনতেন বুয়েট শিক্ষক নিখিল রঞ্জন ধর এবং তিনিই সব নিয়ন্ত্রণ করতেন। শিক্ষক নিখিল রঞ্জন ধর নিজেই তার ব্যাগে প্রশ্ন ঢুকিয়ে নিতে এবং সেও স্যারের ব্যাগে প্রশ্ন ঢুকিয়ে দিতো।

তদন্তে জানা যায়, গত বছর ৬ নভেম্বর ৫টি ব্যাংকের ১৫১১ পদে অফিসার ক্যাশ শূন্য পদের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ছাপানোর সময় দেলোয়ার প্রশ্ন নিখিল রঞ্জন ধরকে দেননি বলে জানান।

রবিউল আউয়াল তার জবানবন্দিতে জানান, সে আহছানিয়া প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন্সে বাইন্ডার পদে কর্মরত। দেলোয়ার ফোন করে তাকে তুরাগের কামারপাড়া যেতে বলে। সে সেখানে গেলে দেলোয়ার তাকে মুক্তার ও পারভেজকে ছোট ভাই বলে পরিচয় করে দেয়। সেদিন তারা তাকে প্রশ্ন ছাপানো হলে একটি প্রশ্ন দিতে অনুরোধ করে। বিনিময়ে তাকে এক লাখ টাকা দেওয়ার প্রস্তাব দেয়। ২ নভেম্বর প্রশ্ন ছাপানো হলে সে একটি প্রশ্ন লুকিয়ে রাখে। ৪ নভেম্বর বিকেলে নবীনগর স্মৃতিসৌধের পাশে মুক্তারের হাতে সে ব্যাংকের প্রশ্নটি দেয়। মুক্তার প্রশ্নটি নিয়ে আরও অনেককে দেয়। পরীক্ষায় সময় তাকে টাকা দিবে বলে মুক্তার জানায়।  

পারভেজ তার জবানবন্দিতে বলেন, সে ও মুক্তার একই ভার্সিটিতে চাকরি করে। সে ল্যাব সহকারী পদে ও মুক্তার আইসিটিতে চাকরি করে। ৪ নভেম্বর মুক্তার তাকে তার সাথে সাভার ঘুরতে যাওয়ার প্রস্তাব দিলে সে রাজি হয় এবং মুক্তারের সাথে যায়। তখন পর্যন্ত মুক্তার তাকে কিছু বলেনি। সেখানে রবিউল আসে মুক্তারের সাথে দেখা করতে। মুক্তার রবিউলের কাছ থেকে একটি প্রশ্নপত্র নেয়। সে মুক্তারকে প্রশ্নের বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলে জানায়, তার ছোট ভাইয়ের জন্য নিয়েছে। তারপর তারা ঘুরাঘুরি করে মুক্তারের বাসায় চলে যায়। রাতে শ্যামল নামে একটি ছেলে আরও ৪/৫ জন ছেলেকে নিয়ে এসে প্রশ্নপত্র সমাধান করে এবং মোবাইলে ছবি তুলে ভিন্ন জায়গায় পাঠায়। এসব দেখে তার সন্দেহ হয় এবং সে বুঝতে পারে মুক্তার অবৈধ কাজ করছে। তখন সে মুক্তারকে এসব করতে নিষেধ করে। কিন্তু মুক্তার তা শোনে না। পরে সে রাগ করে ওই বাসা থেকে চলে আসে।

মিজানুর রহমান জবানবন্দিতে জানায়, আগে সে শেয়ার ব্যবসা করতো। জাহাঙ্গীর ও রবিউল তার পরিচিত বড় ভাই। এর আগে সে কয়েকটি সরকারি ব্যাংকের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন তার আত্মীয় রাশেদ আহমেদ বাবুলের মাধ্যমে সংগ্রহ করে জাহাঙ্গীর ও রবিউলকে দিয়েছিল। সেই সূত্র ধরে, তারা তাকে সর্বশেষ এই নিয়োগ পরীক্ষার পূর্বেই প্রশ্ন দিতে পারবে কি না জিজ্ঞাসা করে। সে রাশেদের সাথে আলোচনা করে জানায় প্রশ্ন দিতে পারবে। প্রশ্ন দেওয়ার বিনিময়ে সে রাশেদকে ৩৫ লাখ টাকা দিবে বলে কথা হয়। বাবুলের কাছ থেকে প্রশ্ন নিয়ে সে জাহাঙ্গীরকে এক কোটি ২০ লাখ টাকার বিনিময়ে দিবে বলে কথা হয়। তার সামনে জাহাঙ্গীর এই প্রশ্ন সোহেল নামে এক ব্যক্তিকে দুই কোটি ৮০ লাখ টাকার বিনিময়ে সরবরাহ করবে বলে ফোনে কথা বলে। জাহাঙ্গীর পূর্বের কথা অনুযায়ী তাকে ২০ লাখ টাকা দেয়। সে ওই টাকা থেকে প্রশ্ন দেওয়ার জন্য রাশেদকে সোয়া ৬ লাখ টাকা প্রদান করে। কথা অনুযায়ী পরীক্ষার আগের দিন রাত ৯টার দিকে রাশেদ তাকে হোয়াটস অ্যাপে প্রশ্ন পাঠায়। সে সাথে সাথে প্রশ্ন জাহাঙ্গীরের হোয়াটস অ্যাপে সেন্ড করে। যথা সময়ে পরীক্ষা হয় জাহাঙ্গীর তাকে আরো টাকা দিতে চাইলে সে রিটেন পরীক্ষার নিবে বলে জানায়। পরে বিষয়টি জানাজানি হলে সে রাশেদকে প্রশ্নপত্রের বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলে সে জানায়, তার কলিগ মোবিন তাকে প্রশ্ন সরবরাহ করতো। পরে জানতে পারেন মোবিনের ভগ্নিপতি দেলোয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে অফিস সহকারী পদে চাকরি করে।  

বাড্ডা থানার আদালতের সাধারণ নিবন্ধন শাখার পুলিশের উপ-পরিদর্শক রনপ কুমার জানান, ২৪ নভেম্বর ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত চার্জশিট দুইটি গৃহীত করেন। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলাটি বিচারের জন্য সাইবার ট্রাইব্যুনালে এবং পাবলিক পরীক্ষা আইনের মামলাটি বিচারের জন্য বদলির আদেশ দেওয়া হয়েছে।

উল্লেখ্য, গত বছর ৬ নভেম্বর দুপুর ৩টা থেকে ৪টা পর্যন্ত রাষ্ট্রায়ত্ত পাঁচ ব্যাংকের নিয়োগ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। এক হাজার ৫১১টি পদের বিপরীতে পরীক্ষায় অংশ নেন এক লাখ ১৬ হাজার ৪২৭ জন। বাংলাদেশ ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটির আওতায় পাঁচ ব্যাংকের অফিসার (ক্যাশ) নিয়োগে এ পরীক্ষা নেওয়া হয়। পরীক্ষার পর চাকরি প্রত্যাশীদের অনেকেই প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ তোলেন।

এ ঘটনায় ১০ নভেম্বর তেজগাঁও জোনাল টিমের সাব-ইন্সপেক্টর সুকান্ত বিশ্বাস বাড্ডা থানায় মামলা করেন।

/মামুন/সাইফ/

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়