সেলফি সেলফি
রফিক || রাইজিংবিডি.কম
রফিক মুয়াজ্জিন : সেলফি বর্তমান সময়ে একটি বহুল চর্চিত বিষয়। ক্যামেরা বা ক্যামেরাওয়ালা ফোন ব্যবহার করেন কিন্তু সেলফি তোলেন না এমন মানুষের সংখ্যা কম। বিশেষ করে কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণীদের মধ্যে সেলফি তোলার প্রবণতা বেশি। এমনকি এটা অনেকের ক্ষেত্রে আসক্তি বা ব্যাধির পর্যায়ে চলে গেছে।
পুরো বিশ্বই ভুগছে সেলফি জ্বরে। নানা ঢঙে, হরেক ভঙ্গিমায়, বিভিন্ন স্থানে এবং অনেক কিছুর সঙ্গে সেলফি তুলে ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, টুইটারে দেওয়ার হিড়িক পড়ে গেছে। কে কতো ইউনিকভাবে সেলফি তুলে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে পোস্ট করতে পারেন তা নিয়ে যেন প্রতিযোগিতা চলছে।
সেলফি কী?
অক্সফোর্ড অ্যাডভান্সড লার্নার্স ডিকশনারিতে ‘সেলফি’র অর্থ বলা হয়েছে- সেলফি হলো একটি আলোকচিত্র, যা নিজের তোলা নিজের প্রতিকৃতি, যা সাধারণত স্মার্টফোন বা ওয়েবক্যামে ধারণকৃত এবং যেকোনো সামাজিক মাধ্যমে আপলোড (তুলে দেওয়া) করা হয়ে থাকে (আ ফটোগ্রাফ দ্যাট ওয়ান হ্যাজ ট্যাকেন অব ওয়ানসেলফ, টিপিক্যালি ওয়ান ট্যাকেন উইথ আ স্মার্টফোন অর ওয়েবক্যাম অ্যান্ড শেয়ারড ভায়া সোশাল মিডিয়া)।
উইকিপিডিয়াতে সেলফির বাংলা করা হয়েছে ‘নিজস্বী’। সেলফি শব্দটি এসেছে ইংরেজি সেলফিশ থেকে। সেলফি অর্থ আত্ম-প্রতিকৃতি।
সেলফির সংজ্ঞা প্রসঙ্গে উইকিপিডিয়াতে বলা হয়েছে- নিজস্বী বা সেলফি (সেল্ফি) হলো আত্ম-প্রতিকৃতি বা দলীয় আলোকচিত্র, যা সাধারণত হাতে-ধরা ডিজিটাল ক্যামেরা বা ক্যামেরা ফোন ব্যবহার করে নেওয়া হয়। সেলফি প্রায়ই ফেসবুক, গুগল+, ইনস্টাগ্রাম, স্ন্যাপচ্যাট, টাম্বলার এবং টুইটার ইত্যাদি সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে শেয়ার করা হয়ে থাকে।
নারী-পুরুষ উভয় লিঙ্গের মানুষের মাঝেই জনপ্রিয়তা লাভ করেছে সেলফি। অনেক সমাজবিজ্ঞানীর মতে সেলফির উত্থান ঘটে মূলত ‘পর্ন সংস্কৃতির’ মাধ্যমে। নিজেদের দেহ আকর্ষণীয়ভাবে প্রদর্শনের মধ্যমে অন্যকে আকৃষ্ট করার জন্যই নারী-পুরুষরা সেলফি তুলত। নিজেকে সুন্দর করে উপস্থাপন করাই ছিল তখন সেলফির মূল উদ্দেশ্য। যত বেশি আকর্ষণীয় হবে সেই সেলফি তত বেশি উন্নত। তবে আকর্ষণীয় নয় এমন সেলফি ব্যাপকতা পায় ২০১০ সালের পরে।
সেলফির ইতিহাস
রবার্ট কর্নিলিয়াস, একজন মার্কিন অগ্রণী চিত্রগ্রাহক।তিনি ১৮৩৯ সালে নিজের একটি আত্ম-প্রতিকৃতি ক্যামেরায় ধারণ করেন। এটা ছিল প্রথম কোনো একজন ব্যক্তির আত্ম-প্রতিকৃতি।
ফেসবুকের আগে মাইস্পেস বেশ জনপ্রিয় ছিল। সেলফি প্রথম জনপ্রিয়তা পায় সেখানেই। তারপর ফেসবুক জনপ্রিয় হওয়ার পর অনেক দিন পর্যন্ত সেলফি নিম্ন রুচির পরিচায়ক ছিল। কারণ তখন বেশিরভাগ সেলফি বাথরুমের আয়নার সামনে তোলা হতো।
তবে শুরু থেকেই ইমেজ শেয়ারিং সাইট ফ্লিকারে জনপ্রিয় ছিল সেলফি। শুরুর দিকে তরুণদের মধ্যে সেলফি অধিক জনপ্রিয়তা পেলেও বর্তমানে এটি সব বয়সি মানুষের কাছেই গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে।
২০১২ সালের শেষের দিকে টাইম ম্যাগাজিনের দৃষ্টিতে ‘সেলফি’ শব্দটি বছরের সেরা ১০ আলোচিত শব্দের অন্যতম শব্দ হিসেবে বিবেচিত হয়। ২০১৩ সালের জরিপ অনুযায়ী, অস্ট্রেলিয়ান নারীদের দুই-তৃতীয়াংশই (যাদের বয়স ১৮ থেকে ৩৫ বছর) ফেসবুকে শেয়ারের উদ্দেশ্যে সেলফি তুলেছেন। স্মার্টফোন এবং ক্যামেরা প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান স্যামসাংয়ের জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- ১৮ থেকে ২৪ বছর বয়সি মানুষের তোলা ছবির ৩০ শতাংশই সেলফি। ২০১৩ সালে অক্সফোর্ড ইংলিশ ডিকশনারির অনলাইন ভার্সনে ‘সেলফি’ শব্দটি সংযোজিত হয়। স্মার্টফোনের কল্যাণে গত কয়েক বছরে সারা বিশ্বে সেলফি তুমুল জনপ্রিয় হয়ে উঠে।
১৯০০ সালে পোর্টেবল কোডাক ব্রাউনি বক্স ক্যামেরা বাজারে আসার পর আত্ম-প্রতিকৃতি তোলা বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করে।সহজে বহনযোগ্য এই ক্যামেরার সাহায্যে আয়নার মাধ্যমে সেলফি তোলার প্রচলন শুরু হয় তখন থকেই।
সেলফি শব্দটির প্রাথমিক ব্যবহার ২০০২ সালের আগে পাওয়া গেলেও, ২০০২ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর অস্ট্রেলিয়ার এবিসি অনলাইনে প্রথম ব্যবহৃত হয়।
সেলফি-ম্যানিয়া
আপনার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট আছে অথচ সেলফি পোস্ট করেন না, তাহলে আপনি ‘খেত’। না, এটা আমার কথা নয়, আজকাল অনেক তরুণ-তরুণীর ধারণা এরকমই। তাই যেখানে যান, যা-ই করেন সঙ্গে একটা সেলফি তুলে পোস্ট করুন ফেসবুকে।
সেলফি-ম্যানিয়া এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, কেউ কেউ তো হাসপাতালের বেডে মৃত্যুযন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে সেলফি তুলে ফেসবুকে পোস্ট করে লিখেন- ফিলিং পেইনড। সড়ক দুর্ঘটনায় কোনোরকমে বেঁচে গিয়ে ভাঙা গাড়ির সঙ্গে সেলফি তুলে লিখেন- ফিলিং ব্লেজড। পড়তে, লিখতে, হাঁটতে, খেলতে, রান্না করতে, কাজ করতে গিয়ে সেলফি তোলা তো একটা নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে আজকাল।
অনেকে প্রতিদিন সেলফি আপলোড করে ফেসবুকের সামনে বসে থাকেন কয়জন লাইক এবং কমেন্ট করে তা গুণতে।কে কী কমেন্ট করল তা দেখতে, আর রিপ্লাই দিতে কেটে যায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা। কাছের মানুষদের কেউ কমেন্ট না করলে তো তার ওপর অভিমান, এমনকি ঝগড়াও হয়।
অফিসে কাজ ফেলে সেলফি তুলে পোস্ট করতে আর লাইক-কমেন্ট গুণতেও দেখেছি অনেককে।
সেলফির উপকারিতা
সেলফি তুলে প্রতিদিন নিজের চেহারা দেখে স্বাস্থ্য সচেতন থাকা যায়। তবে যারা সেলফি তোলেন তারা এই উপকারি দিকটার কথা ভাবেন কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দহ আছে। সাজগোজ করার পর তা ঠিক আছে কিনা তা সেলফি তুলে পরখ করে নেওয়া যায়। যেসব বন্ধু বা প্রিয় মানুষের সঙ্গে দেখা হয় না তাদের সেলফি দেখে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানো সম্ভব।
সেলফির অপকারিতা
সেলফির উপকারিতার চেয়ে বরং অপকারিতা বেশি চোখে পড়ে। গবেষকরা বলছেন, সেলফি তোলার এই অভ্যাস ভয়ঙ্কর বিপদজনক হতে পারে। মার্কিন গবেষকরা দাবি করেছেন, অতিরিক্ত সেলফি তোলার অভ্যাসের সঙ্গে মানসিক ব্যাধির সম্পর্ক থাকতে পারে। নিজের চেহারার প্রতি আকর্ষণ অনুভব করা মানসিক স্বাস্থ্যকে ঝুঁকির মুখে ফেলে দিতে পারে। সম্প্রতি ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস টাইমসের এক খবরে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশন (এপিএ) সম্প্রতি মানসিক ব্যাধির সঙ্গে সেলফি তোলার সম্পর্কের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগোতে প্রতিষ্ঠানটির বার্ষিক পরিচালনা পর্ষদের সভায় সেলফির সঙ্গে মানসিক ব্যাধির বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়। তারা দাবি করেছেন, নিজের অতিরিক্ত ছবি তোলার প্রবণতা এবং সেই ছবি সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইটে দেওয়ার এই মানসিক সমস্যার নাম ‘সেলফিটিস’।
গবেষকেরা জানিয়েছেন, ব্যাধিটির তিনটি স্তর হতে পারে। প্রথম স্তরটি ‘বর্ডার লাইন সেলফিটিস’। মানসিক সমস্যার এই পর্যায়ে দিনে তিনবার নিজের ছবি তুলে কিন্তু সামাজিক যোগাযোগের সাইটে তা পোস্ট না করা। দ্বিতীয় স্তরটি হচ্ছে ‘অ্যাকিউট সেলফিটিস’। এই পর্যায়ে দিনে অন্তত তিনটি নিজের সেলফি তুলে সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইটে তিনটি সেলফিই পোস্ট করা হয়। শেষ স্তরটি হচ্ছে ‘ক্রনিক সেলফিটিস’। এ পর্যায়ে নিজের সেলফি তোলা রোধ করা যায় না। দিনে অন্তত ছয়বার সেলফি তুলে সামাজিক যোগাযোগের সাইটে পোস্ট করতে দেখা যায়। এ ছাড়া বারবার নিজের ছবি তোলার প্রবণতা থাকে ক্রনিক সেলফিটিস পর্যায়ে।
এই মানসিক সমস্যার আপাতত কোনো সমাধান নেই বলেই জানিয়েছেন গবেষকরা। তবে সাময়িক চিকিৎসা হিসেবে কগনিটিভ বিহেভিয়েরাল থেরাপি (সিবিটি) কাজে লাগতে পারে বলে মনে করছেন তারা। মানসিক রোগের চিকিৎসকরা দাবি করছেন, অতিরিক্ত সেলফি তোলার সঙ্গে নার্সিসিজম ও আসক্তিরও সম্পর্ক থাকতে পারে। গবেষক ডেভিড ভিল জানিয়েছেন, বডি ডিসফরমিক ডিজঅর্ডারে ভুক্তভোগী দুই-তৃতীয়াংশ রোগীর ক্ষেত্রেই সেলফির সম্পর্ক দেখেছেন তিনি।
সেলফি তুলতে গিয়ে প্রাণহানির ঘটনাও বিরল নয়।
সেলফি তোলার নেশা ছিল ১৭ বছর বয়সি জিনিয়া লেগ্নাটেভার। একটি ব্রিজের ওপর সেলফি তুলতে যাওয়ার সময় ব্রিজ থেকে পড়ে যান একটি বৈদ্যুতিক তারের ওপর। তাৎক্ষণিকভাবেই মৃত্যুবরণ করেন তিনি।
মোটরবাইক চালানোর সময় সেলফি তুলতে গিয়ে দুর্ঘটনায় মারা যান রেগাইটন জাডিয়েল।
অস্কার অটেলো আগুইলার নামের এই তরুণ বন্ধুদের সঙ্গে মদ খাওয়ার সময় পিস্তল নিয়ে সেলফি তুলতে গিয়ে নিজের মাথায় গুলি চালান ঘটনাস্থলেই মারা যান।
পর্তুগালের এক দম্পতি কাবো ডা রোকা পাহাড়ের কিনারায় দাঁড়িয়ে সেলফি তোলার সময় প্রায় ২০০ ফুট নিচে পড়ে মারা যান।
জায়েন নামের ২১ বছর বয়সি এক স্প্যানিশ তরুণ চলন্ত ট্রেনের ওপর উঠে সেলফি তোলার সময় বৈদ্যুতিক শকে ঘটনাস্থলেই মারা যান।
কোরটেনি স্টানফোর্ড গাড়ি চালানোর সময় সেলফি তুলতে গিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হয়ে ঘটনাস্থলেই মারা যান।
প্রত্যেক বিষয়েরই ভালো এবং খারাপ দিক আছে। তেমনই সেলফির রয়েছে উপকারি ও ক্ষতিকর দিক। তবে কোনো বিষয় যখন আসক্তি বা ব্যাধির পর্যায়ে চলে যায়, তখন সেটার উপকারি দিকের চেয়ে অপকারি দিকটাই মুখ্য হয়ে ওঠে।
লেখক : সাংবাদিক ও সংস্কৃতিকর্মী।
রাইজিংবিডি/ঢাকা/৭ আগস্ট ২০১৫/রফিক/নওশের
রাইজিংবিডি.কম