ঢাকা     রোববার   ২১ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  পৌষ ৬ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

ঐন্দ্রিলার রেজাল্টে কাঁদছেন অরিত্রীর বাবা-মা

মামুন খান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:৩৫, ৩ ডিসেম্বর ২০২২  
ঐন্দ্রিলার রেজাল্টে কাঁদছেন অরিত্রীর বাবা-মা

অরিত্রী অধিকারী (ফাইল ফটো)

শিক্ষকের কড়া শাসন, মা-বাবার অপমান আর কিশোরী মেয়ের অভিমানের শেষ একটি পরিবারের স্বপ্ন। অরিত্রীর মা-বাবার ইচ্ছে ছিল দেশের সেরা স্কুলের শিক্ষার্থী হিসেবে সে এসএসসি পরীক্ষায় নিজের ও পরিবারের মুখ উজ্জল করবে। কিন্তু তা আর হলো না। সে এখন পরপারে। অরিত্রীর বোন ঐন্দ্রিলার ভালো রেজাল্টে কাঁদছেন মা-বাবা।  বলছেন, ‘বেঁচে থাকলে অরিত্রীও এমন ভালো রেজাল্ট করতো।’

চার বছর আগে ২০১৮ সালের এই দিনে (৩ ডিসেম্বর) শিক্ষকদের দ্বারা বাবা-মার অপমান সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেন অরিত্রী অধিকারী। অরিত্রীর আত্মহত্যার ঘটনায় তার বাবা দিলীপ অধিকারী রাজধানীর পল্টন থানায় মামলা দায়ের করেন। মামলাটি তদন্ত করে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ নাজনীন ফেরদৌস ও শাখাপ্রধান জিনাত আক্তারকে অভিযুক্ত করে চার্জশিট দাখিল করে ডিবি পুলিশ। ২০১৯ সালের ১০ জুলাই আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জগঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন ঢাকার তৃতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা (তৎকালীন) জজ রবিউল আলম। সর্বশেষ গত ২৭ নভেম্বর মামলার তারিখ ধার্য ছিল। ওইদিন মামলার সর্বশেষ সাক্ষী তদন্ত কর্মকর্তা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) পরিদর্শক কামরুল হাসান তালুকদারকে জেরা শেষ করেন আসামিপক্ষের আইনজীবী। এরপর বিচারক শেখ ছামিদুল ইসলাম আগামী ২৫ জানুয়ারি আসামিদের আত্মপক্ষ শুনানির তারিখ ধার্য করেন। 

আরো পড়ুন:

মামলা সম্পর্কে অরিত্রীর বাবা দিলীপ অধিকারী বলেন, ‘চার বছর হলো মেয়েটা আমাদের ছেড়ে চলে গেছে। মা-বাবার অপমান সহ্য করতে না পেরে মেয়েটা আত্মহত্যা করে। আর তার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছিল তা সত্য নয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়, পুলিশ তদন্তে উঠে এসেছে। দেড় বছর করোনার কারণে বিচার আটকে ছিল। মামলাটি শেষের পর্যায়ে চলে এসেছে। এখন দেখা যাক আদালত কি করেন। আদালতের দিকে তাকিয়ে আছি।’

তিনি বলেন, সেদিন যদি তারা (শিক্ষকরা) আমাদের আলাদা ডেকে নিয়ে কথাগুলো বলতেন তাহলে আর মেয়েকে হারাতে হতো না। মেয়েকে তো আর ফিরে পাবো না। তবে তার সাথে যারা খারাপ ব্যবহার করেছে, অন্যায় আচরণ করেছে, মিথ্যা অপবাদ দিয়েছে যার জন্য ওকে পৃথিবী ছেড়ে অকালে চলে যেতে হয়েছে তাদের যেন দৃষ্টান্তমূলক সাজা হয় সেজন্য লড়ে যাবো। অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়ে যাচ্ছি। শেষ পর্যন্ত লড়ে যাবো। 

আক্ষেপের সাথে আসামিপক্ষের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজলের বিষয়ে দিলীপ অধিকারী বলেন, মোশাররফ হোসেন কাজলকে সবাই চেনেন। তিনি আসামিপক্ষে মামলাটি দেখছেন। আদালতে তার ব্যবহার, বডি ল্যাংগুয়েজ যা দুঃখজনক। অরিত্রীর মাকে জেরার সময় তিনি যে ব্যবহার করেছেন, সন্তানহারা মায়ের সাথে এমন বিহ্যাব কেউ করে? সবকিছু জেনেশুনেই মেয়ের জন্য লড়ে যাচ্ছি।

উদয়ন স্কুল থেকে অরিত্রীর ছোট বোন ঐন্দ্রিলা অধিকারী জিপিএ-৫ পেয়েছে। বাবা-মায়ের স্বপ্ন ছিল, অরিত্রীও এমন রেজাল্ট করবে।

এ বিষয়ে দিলীপ অধিকারী বলেন, অরিত্রী ছিল চৌকষ। সবদিক দিয়ে সে ছিল মেধাবী। আমাদের আশা ছিল, সেও এমন রেজাল্ট করবে। কিন্তু তা তো হলো না। ঐন্দ্রিলা উদয়ন স্কুল থেকে জিপিএ-৫ পেয়েছে। আমরা এটা বুঝেছি, স্কুল কোনো ফ্যাক্ট না। শাসন না করেও ভালো করা যায়। ঐন্দ্রিলার ওপর দিয়ে অনেক ধকল গেছে। বোন মারা গেছে। একা পড়াশোনা করে নিজেকে সে তৈরি করেছে।

রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী সাবিনা আক্তার (দিপা) বলেন, ‘এটি একটি আলোচিত মামলা। বাবা-মাকে শিক্ষকরা অপমান করছিল। সেই অপমান সইতে না পেরে অরিত্রীকে পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হয়েছে। অরিত্রীর বাবা-মা মেয়েকে হারিয়েছে। মামলাটা সেনসিটিভ। আমরা রাষ্ট্রপক্ষ থেকে আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণে চেষ্টা চালিয়েছি। আমরা চাই, এ রায়ের মধ্য দিয়ে মামলাটা নজির স্থাপন হোক। এভাবে কোনো শিক্ষক শিক্ষার্থীকে অপমান করবে না, বকা দিবে না। আর কোনো অরিত্রীকে আত্মহত্যা করতে হবে না। আর মামলার বিচার যেন দ্রুত শেষ হয় এবং ভুক্তভোগীরা যেন ন্যায়বিচার পায় এজন্য আমরা চেষ্টা করে যাবো।’

অরিত্রীর আত্মহত্যায় ঘটনায় রাজধানীর পল্টন থানায় তার বাবা দিলীপ অধিকারী বাদী হয়ে ২০১৮ সালের ৪ ডিসেম্বর রাতে দণ্ডবিধির ৩০৫ ধারায় মামলাটি দায়ের করেন। তিনি অভিযোগ করেন, ৩ ডিসেম্বর পরীক্ষা চলাকালে অরিত্রীর কাছে মোবাইল ফোন পান শিক্ষক। মোবাইল ফোনে নকল করেছে, এমন অভিযোগে অরিত্রীকে পরদিন তার মা-বাবাকে নিয়ে স্কুলে যেতে বলা হয়। দিলীপ অধিকারী স্ত্রী ও মেয়েকে নিয়ে ওইদিন স্কুলে গেলে ভাইস প্রিন্সিপাল তাদের অপমান করে কক্ষ থেকে বের হয়ে যেতে বলেন। মেয়ের টিসি নিয়ে যেতে বলেন। পরে প্রিন্সিপালের কক্ষে গেলে তিনিও একই রকম আচরণ করেন। এ সময় অরিত্রী দ্রুত প্রিন্সিপালের কক্ষ থেকে বের হয়ে যায়। পরে শান্তিনগরে বাসায় গিয়ে তিনি দেখেন, অরিত্রী তার কক্ষে সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ওড়নায় ফাঁস দেওয়া অবস্থায় ঝুলছে। তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসকরা অরিত্রীকে মৃত ঘোষণা করেন।

মামলায় ৩ জনকে আসামি করা হয়। মামলা দায়েরের পর ৫ ডিসেম্বর শ্রেণি শিক্ষক হাসনা হেনাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরের দিন আদালত জামিন নামঞ্জুর করে তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। পরে ৯ ডিসেম্বর জামিন পান হাসনা হেনা। ১৪ জানুয়ারি নাজনীন ফেরদৌস ও জিনাত আক্তার আত্মসমর্পণ করে জামিন নেন।

২০১৯ সালের ২০ মার্চ নাজনীন ফেরদৌস ও জিনাত আক্তারকে অভিযুক্ত করে চার্জশিট দাখিল করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) পরিদর্শক কামরুল হাসান তালুকদার। আর শ্রেণিশিক্ষক হাসনা হেনাকে অভিযুক্ত করার মতো সাক্ষ্য-প্রমাণ না পাওয়ায় তার অব্যাহতির আবেদন করেন তদন্ত কর্মকর্তা।

নির্দয় ব্যবহার ও অশিক্ষকসুলভ আচরণে আত্মহত্যায় প্ররোচিত হয় বলে চার্জশিটে উল্লেখ করেন তদন্ত কর্মকর্তা।

এদিকে, দুই আসামির বিরুদ্ধে যে ধারায় চার্জ গঠন করা হয়েছে উক্ত ধারায় অভিযোগ প্রমাণিত হলে আসামিদের সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ডও হতে পারে। এছাড়া যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা ১০ বছর কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। কারাদণ্ডের পাশাপাশি অর্থদণ্ডের বিধান রয়েছে।

/মামুন/সাইফ/

সম্পর্কিত বিষয়:

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়