ঢাকা     শনিবার   ২০ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  পৌষ ৫ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

নারী জাগরণের পথ গড়েছেন তিনি

হাসান মাহামুদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৪:০২, ১১ জুন ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
নারী জাগরণের পথ গড়েছেন তিনি

বিপ্লবী লীলা নাগ রায়

হাসান মাহামুদ: সেই ১৯৯১ সাল থেকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে যারা দায়িত্ব পালন করেছেন, তারা সবাই নারী। বাংলাদেশে নারী জাগরণের সম্ভবত এর থেকে তরতাজা কোনো উপমা নেই। অথচ এক সময় ছিল, যখন মেয়েরা ঘর থেকেই বের হতেন না, ঘরের চার দেয়াল ছিল তাদের জন্য বরাদ্দ। সূর্যের আলো মুখে পড়াও ছিল মেয়েদের জন্য পাপ।

সেই রুদ্ধদ্বার পরিস্থিতির উত্তরণ হঠাৎ করে হয়নি। এমনি এমনিও হয়নি। এর জন্য যুগে যুগে কঠোর শ্রম আর অসংখ্য প্রতিকূলতা মোকাবেলা করে অবদান রেখে গেছেন মহীয়সীরা। অগ্নিকন্যারা।

তেমনি একজন বিপ্লবী লীলা নাগ। লীলাবতী নাগ, লীলা নাগ বা লীলা রায়- তিন নামেই ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের এই অগ্নিকন্যা পরিচিত। বিশ শতকের প্রথমার্ধে শুধু ঢাকা শহরেই নয়, পুরো বাংলায় অসামান্য বিপ্লবী, রাজনীতিবিদ, সংগঠক হিসাবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন তিনি।

লীলা নাগ সর্ম্পকে বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই জানেন না। তাকে নিয়ে, তার অর্জন নিয়ে, যতটা আলোচনা হওয়ার প্রয়োজনীয়তা ছিল তাও হয়নি। তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ইংরেজি বিভাগের প্রথম ছাত্রী।  তার হাত ধরেই ঢাবিতে নারী শিক্ষার সূচনা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম এমএ ডিগ্রিধারীও তিনি। বাংলা ভাষায় মহিলা সম্পাদিত প্রথম পত্রিকা মাসিক ‘জয়শ্রী’র সম্পাদক ছিলেন তিনি। উপমহাদেশের স্বাধীনতা ও নারী জাগরণের পথিকৃত, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের বিপ্লবী নারী। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর সহকারী হিসেবেও তিনি কাজ করেছেন।  এমনকি  ভারতবর্ষে বিনা বিচারে আটক হওয়া প্রথম নারী রাজবন্দীও লীলা নাগ।

লীলা নাগ একজন জনহিতৈষী এবং রাজনৈতিক আন্দোলনে সক্রিয় নারী ছিলেন। ১৯০০ খ্রীষ্টাব্দের ২১ অক্টোবর ব্রিটিশ ভারতের আসামের গোয়ালপাড়ায় তিনি জন্মগ্রহণ করেন। ১৯১৬ সালে লীলা নাগের পিতা গিরীশচন্দ্র নাগ চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পর স্থায়ীভাবে সপরিবারে বাংলাদেশে চলে আসেন।

বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী লীলা নাগ ১৯২১ সালে মেয়েদের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করে বি.এ পাস করেন এবং পদ্মাবতী স্বর্ণপদকে ভূষিত হন। ওই বছরই তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আবেদন করেন। সে সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নারী শিক্ষা অর্থাৎ সহশিক্ষা চালু ছিল না। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্কালীন ভাইস চ্যান্সেলর ড. রবার্ট হার্টস লীলা নাগের মেধার প্রতি শ্রদ্ধা রেখে তাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্রী হিসেবে ইংরেজি বিষয়ে মাস্টার্স শ্রেণিতে ভর্তির সুযোগ দেন।

বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে মাহাত্মা গান্ধির পাশে লীলা নাগ


ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী থাকাবস্থায় লীলা নাগ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র ও ঋষি রামানন্দের সান্নিধ্য লাভ করেন।

শিক্ষাজীবন শেষ করে লীলা নারীশিক্ষার প্রসার ও স্বদেশের স্বাধিকার আদায়ের আন্দোলনে ব্রতী হন। নারীদের অশিক্ষার অন্ধকার থেকে মুক্ত করার জন্যে ১২ জন সংগ্রামী সাথী নিয়ে তিনি গড়ে তোলেন ‘দীপালি সংঘ’। এই সংঘের মাধ্যমে তিনি দীপালি স্কুল ও আরো ১২টি অবৈতনিক প্রাইমারি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। নারীশিক্ষা মন্দির ও শিক্ষাভবন নামেও দু’টি স্কুল তিনি প্রতিষ্ঠা করেন।

ঢাকায় তার প্রতিষ্ঠিত স্কুল দীপালি-১ পরবর্তীতে নাম বদলে হয় কামরুন্নেসা গার্লস হাই স্কুল, আর নারীশিক্ষা মন্দির নাম হয় শেরে বাংলা বালিকা মহাবিদ্যালয়। ঢাকার আরমানিটোলা বালিকা বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতাও তিনি। বিয়ের পর লীলা কলকাতায় চলে যান এবং সেখানেও বেশ কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। এছাড়াও তিনি দীপালি ছাত্রী সংঘ ও মহিলা আত্মরক্ষা কেন্দ্রও গড়ে তোলেন। বিপ্লবী পুলিন দাসের নেতৃত্বে মেয়েরা এখানে অস্ত্র চালনা ও লাঠিখেলা শিখতেন।

লীলা নাগদের জন্মই হয় একটি যুগের পরিবর্তন করতে, জং-ধরা একটি সমাজ ব্যবস্থায় বিপ্লব নিয়ে আসতে। নিজেদের সারাটা জীবনের সাধনার দ্বারা এরা উত্তরসূরীদের জন্য রেখে যান উত্তমতর সমাজ ব্যবস্থা আর স্বাধীনতার স্বাদ। তাদের কীর্তিই তাদের করে রাখে অমর। আমাদের উচিত এসব অগ্নিজন্মাদের আরো বেশি পাঠ করা। যাতে আমরা আরো উজ্জীবিত হতে পারি।

১৯৬৪ সালে পূর্ববাংলা বাঁচাও কমিটির আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার কারণে পুলিশ লীলা নাগকে গ্রেপ্তার করে। ১৯৬৬ সালে ছাড়া পাবার পর তিনি শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েন। ১৯৬৮ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি সকালে তিনি সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়লে তাকে কলকাতার পি.পি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ২৩ দিন পর সংজ্ঞা ফিরে এলেও বন্ধ হয়ে যায় তার বাকশক্তি। শরীরের ডান অংশ সম্পূর্ণরুপে অচল হয়ে যায়। এভাবেই আড়াই বছর চলার পর ১৯৭০ সালের আজকের দিনে (১১ জুন) উপমহাদেশের নারী সমাজের জাগরণের প্রথম অগ্রদূত, অগ্নিকন্যা লীলা নাগ মৃত্যুবরণ করেন। এই মহিয়সীর প্রতি রইলো বিপ্লবী শুভেচ্ছা।

লেখক: সাংবাদিক।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/১১ জুন ২০১৭/হাসান/টিপু

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়