ঢাকা     মঙ্গলবার   ১৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৩ ১৪৩১

আমাদের ‘সোনালি’ ‘রুপালি’ ‘পুবালি’ ভুলগুলো

জাফর সোহেল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:২৭, ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
 আমাদের ‘সোনালি’ ‘রুপালি’ ‘পুবালি’ ভুলগুলো

জাফর সোহেল : ফেব্রুয়ারির আজ শেষ দিন। ফাল্গুনের হাত ধরে হাওয়ায় হাওয়ায় তার চলে যাওয়ার কথা থাকলেও ফেব্রুয়ারি এবার বিদায় নিচ্ছে অনেকটা মাঘের শীতে কাঁপতে কাঁপতে! তিনদিন ধরে বাংলাদেশ আছে বৃষ্টির ভেতর। অনাকাঙ্ক্ষিত বৃষ্টি বাঙালির ‘প্রাণের মেলা’ বইমেলাকেও পিড়া দিচ্ছে। পিড়ীত হচ্ছেন লেখক, পাঠক, প্রকাশক সকলেই। প্রকৃতির এই দুর্মতির ঘাটতি কাটাতে লেখক, প্রকাশক ঠিক করেছেন বাংলা একাডেমিকে চেপে ধরবেন- এবারের ফেব্রুয়ারিকে অন্তত ৩০ দিনে নিয়ে যাওয়ার জন্য! ‘এক মাস বইমেলা’ যখন আমরা বলি তখন ত্রিশদিনের মেলা হতে সমস্যা কোথায়? না হয় তা মার্চ মাসই হলো, কী আসে যায়! বাঙালির এই অনিন্দ্যসুন্দর প্রাণের মেলা এভাবে ঝিমোতে ঝিমোতে বিদায় নেবে- একি মেনে নেয়া যায়? আশা করছি চাপ নয়, আবদার হিসেবে কর্তৃপক্ষ একটু উদার হবেন।

যাই হোক, যে জন্য ভাষার মাস ফেব্রুয়ারির এই একেবারে শেষ দিনে এসে এমন শিরোনাম দিয়ে গুটিকয়েক বাক্য রচনায় মনোনিবেশ করলাম তা নিতান্তই ব্যক্তিগত ঔৎসুক্যে। কেউ কেউ এই উৎসাহী কিংবা অতি-উৎসাহী ভাব দেখে যারপরনাই অসন্তুষ্ট হতে পারেন বৈকি। আর যারা এই বাক্যবাণে কিছুটা আঘাতপ্রাপ্ত হবেন তারা রুষ্টও হতে পারেন। তবু লিখছি। শিরোনামের রহস্য পরে ভেদ করছি। আগে বলি, বিষয়টা কী? বিষয় হলো, ভাষা নিয়ে, ভাষার শুদ্ধ চর্চা নিয়ে আমাদের সরকারি-বেসরকারি নানাবিধ কর্তৃপক্ষের পাপসম অবহেলা। আমরা যারা বাংলা ভাষাকে পৃথিবীর অন্যতম সেরা ভাষা হিসেবে দেখার স্বপ্ন দেখি, যারা বাংলা ভাষা নিয়ে গর্ব করি সবাই আমরা আমাদের প্রিয় এই ভাষাটিকে নানাভাবে অবহেলা করি। সরকারি প্রতিষ্ঠান যেমন, নামকরা অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও ভাষার শুদ্ধ প্রয়োগ নিয়ে উদাসীন। সংবিধানের একটা বাধ্যবাধকতা আছে সর্বত্র বাংলা ভাষার শুদ্ধ ব্যবহার নিশ্চিত করার ব্যাপারে। এর বাইরে উচ্চ আদালতেরও আছে বেশ কিছু নির্দেশনা। এরপরও বাড়ি থেকে বের হলেই বানান ভুলের যে উৎকট প্রদর্শনী দেখি তাতে মন খারাপ হয়ে যায়। ভাবি, এই আমাদের ভাষাপ্রেম, এই আমাদের মহান শহীদদের আত্মত্যাগের প্রতিদান?

দেশের নামকরা বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ভিকারুননিসা নুন স্কুল। এই প্রতিষ্ঠানটির দেয়ালে লেখা আছে মনীষীদের অনেকগুলো বাণী। বাণীগুলো পড়ে দেখবেন- প্রতিটি বাক্যে অন্তত ২/৩টি করে শব্দের বানান ভুল আছে। কোথাও হ্রস্ব-ই কারের জায়গায় দীর্ঘ-ই কার, কোথাও দন্তন্য’র জায়গায় মূর্ধণ্য, কোথাও স-এর জায়গায় শ, আবার কোথাও প-এর জায়গায় ফ! এই স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানের শিশু শিক্ষার্থীরা এখান থেকে কী শিখছে? পথচলতি মানুষ যারা আগ্রহ নিয়ে সেসব বাণী পড়ছেন, তারাই বা কী শিখছেন? অনেকে সংশয়ে পড়ছেন! যে বানান তিনি নিজে শিখে এসেছেন আজীবন তা ঠিক আছে তো? ভিকারুননিসা স্কুলের লোকেরা কি ভুল লিখবে? আবার দেখুন ভিকারুননিসা ‘নুন’-এর জায়গায় বড় বড় অক্ষরে লেখা রয়েছে ‘নূন’। অর্থাৎ নুন শব্দে হ্রস্ব ই-কারের পরিবর্তে লেখা আছে দীর্ঘ উ-কার! প্রাথমিকভাবে মনে হতে পারে এটা মামুলি ভুল, কী আসে যায় এভাবে লিখলে? কিন্তু না, বিষয়টি মামুলি ব্যাপার নয়। এই ‘নূন’ বানান থেকে হাজার হাজার শিক্ষার্থী শিখছে ইংরেজি ‘noon’ শব্দ বাংলায় দীর্ঘ উ-কার দিয়ে লেখা যায়! যে কোনো বিদেশি শব্দে যে হ্রস্ব-ই কার বা উ-কার হবে তা তারা ভুলে যাবে। অন্য অনেক শব্দেও শিক্ষার্থীরা এভাবে ভুল বানান লিখবে। আর দেশ সেরা এমন একটি প্রতিষ্ঠানের নাম এই এতদিনেও কেন ভুল নিয়মে থাকবে? যেখানে রাষ্ট্র নিজেই বাংলা ভাষাকে শুদ্ধভাবে চর্চা করতে বিভিন্নভাবে উৎসাহিত করছে এবং তাগাদাও দিচ্ছে। সেখানে এই প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিরা কেন তাতে কর্ণপাত করছেন না? কেবল ভিকারুননিসা নয়, রাজধানীর অনেক নামকরা প্রতিষ্ঠানে গেলেই মিলবে এমন ভাষগত দৈন্য। কেউ বাংলা নামকেই ইংরেজিতে লিখছেন, কেউ প্রতিষ্ঠানের ইংরেজি নাম দেয়াকে ফ্যাশন হিসেবে নিয়েছেন- যেন এসব প্রতিষ্ঠানে কেবল বিদেশি শিক্ষার্থীরাই পড়তে আসবে! শিক্ষিতজনেরাই এমন ভুল চর্চা করছেন! কেউ দেখার নেই, কিছু বলার নেই!

ফেইসবুকে দু’দিন আগে পোস্ট পেলাম একটা পত্রিকার পক্ষে শিশু শিক্ষার্থীরাই বের করে এনেছে ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠ্য বইগুলোতে অন্তত দুই শতাধিক শব্দের বানান ভুল আছে! বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়, কিন্তু বাস্তবতা হলো- এমনই হচ্ছে। বছরের প্রথম দিন বই দেয়া যতটা ভালো উদ্যোগ, ততটাই খারাপ হলো ভুল বানানের বই শিশুদের হাতে তুলে দেয়া। মায়ের ভাষা প্রতিষ্ঠার জন্য আমাদের অগ্রজরা প্রাণ দিয়ে গেছেন এজন্যে নয় যে, আমাদের শিশুরা ভুল শিখবে, ভুল জানবে। এ দেশে কি এমন মানুষও নেই, যারা অন্তত শিশুদের শুদ্ধ ভাষায় জ্ঞান চর্চার সুযোগ করে দেবে? লোকের তো অভাব দেখি না! ভাষা চর্চার জন্য, সাহিত্য চর্চার জন্য কত লোকেই তো কত পুরস্কার পাচ্ছেন। এসব নিয়ে তাদের মাথা ব্যথা দেখি না।

সাধারণ মানুষ পথেঘাটে যে পোস্টার, ফেস্টুন, ব্যানার ঝোলান- সেখানে বানান ভুলের বাহার দেখলে চমকে উঠতে হয়। যে প্রতিষ্ঠানগুলোতে এগুলো লেখা হয়, ছাপা হয়- সেখানে কি আমরা একটা অভিধান অন্তত বিনে পয়সায় দিয়ে আসতে পারি না? এটা খুবই সহজ একটি পন্থা হতে পারে যে, ব্যানার লেখকেরা অন্তত সংশয়ে পড়লে যেন একটা শব্দ অভিধান দেখে শুদ্ধভাবে লিখে নিতে পারেন। তারা তো কষ্ট করেই লেখেন, যদি উপায় থাকে তবে কষ্ট করে ভুল বানানটি কেন তারা লিখবেন? এবার আসি শুরুর জায়গায়। কেউ কেউ হয়ত খেয়াল করবেন, শিরোনামে বাংলাদেশের তিনটি স্বনামধন্য সরকারি ব্যাংকের নাম একটু ভিন্ন বানানে লিখেছি! ‘সোনালী’ কে সোনালি, ‘রূপালী’কে রুপালি আর ‘পূবালী’কে পুবালি লিখেছি। কেন? ব্যাংক তিনটির এই পরিচিত নামগুলো কি ভুল? বিনয়ের সঙ্গে বলি, এগুলো ভুল বানানে লেখা। সোনালি এবং রুপালি দুটি রঙের নাম। সোনালি রং, রুপালি রং। সোনা বা স্বর্ণের রং বোঝাতে সোনা শব্দের সঙ্গে আলি প্রত্যয়ে গঠিত হয়েছে সোনালি শব্দটি। অতএব ব্যাংকের নাম অতি অবশ্যই হবে ‘সোনালি ব্যাংক’। অর্থাৎ ‘সোনালি’তে হ্রস্ব-ই কার ব্যবহার হবে। একইভাবে রুপা থেকে এসেছে রুপালি। রুপা+আলি। এই রুপা বা রুপালির সঙ্গে রূপ শব্দের সম্পর্ক নেই। রুপালিও এক প্রকার রং। রুপার মতো দেখতে যে বস্তুর রং তাকে রুপালি বলি। যেমন রুপালি চাঁদ। ঠিক তেমনিভাবে ব্যাংকটির নামও হবে রুপালি ব্যাংক! এভাবে পুব+আলি দিয়ে গঠিত পুবালি শব্দ। যেমন পুবালি বাতাস। এর সঙ্গে পূর্ব শব্দের সম্পর্ক নেই। যে কারণে পূবালী নয়, হবে পুবালি ব্যাংক!

এখন রাষ্ট্রায়ত্ব এই ব্যাংকগুলোর নামের বানান কে ঠিক করবে? নিশ্চয়ই ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। কেন এই বানানগুলো ঠিক করা দরকার? কারণ, বাংলাদেশের এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে এই ব্যাংকগুলোর শাখা নেই। সবখানে এদের সাইনবোর্ড আছে। এবং সব জায়গাতেই এই ভুল বানান মানুষ দেখছে এবং শিখছে! সবচেয়ে বেশি বিপজ্জনক হলো, শিশু শিক্ষার্থীরা এসব সাইনবোর্ডকে মনে করে আদর্শ। কারণ, তারা ভাবে ব্যাংকের নাম তো আর ভুল হবে না। আমরা বড়রাও এভাবেই চিন্তা করি।  ভাষাজ্ঞান মানুষ কেবল বই থেকে শিখবে তা নয়, বইয়ের বাইরের এসব উৎস থেকেও মানুষ অনেক সময় অনেক কিছু শেখে। সুতরাং ভাষার মাসে ভাষা ভাষা করে চিৎকার না করে সারা বছর আমাদের তরুণ প্রজন্ম যাতে সঠিক ভাষা চর্চা করতে পারে তার প্রতি নজর দেয়া জরুরি। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহে ভাষার সঠিক ব্যবহার তদারকি করতে হবে। আপাতত এই হোক প্রার্থনা।

লেখক: সাংবাদিক



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়