ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

ফুটবলের সন্তান কিংবা ফুটবলই যার সন্তান

নাজমুল হক তপন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৭:১০, ২৩ নভেম্বর ২০২০   আপডেট: ১৭:৪৩, ২৩ নভেম্বর ২০২০
ফুটবলের সন্তান কিংবা ফুটবলই যার সন্তান

বাদল রায়

‘উদ্ধারের আশা ত্যাগ করি
তারে প্রাণপণে বক্ষে চাপি ধরি।
এক বিনাশের তলে তলাইয়া মরি
অকাতরে অংশ লই তার দুর্গতির
অর্থফল ভোগ করি তার দুর্মতির,
সেই তো সান্ত্বনা মোর।’

কবিগুরুর ‘গান্ধারীর আবেদন’ কবিতায় কথাগুলো ধৃতরাষ্ট্রের। ধ্বংসের খেলায় মেতে উঠেছে ধৃতরাষ্ট্রপুত্র দুর্যোধন। চারদিকে ঘোর আঁধার। ডুবছে সবকিছু। এমন পরিস্থিতিতে স্বামীর কাছে পুত্র দুর্যোধনকে পরিত্যাগ করার আকুল আর্তি জানান ধৃতরাষ্ট্র পত্নী গান্ধারী। উত্তরে ডুবন্ত পুত্রকে দূরে না ঠেলে, প্রাণপণে তাকে আকড়ে ধরে, বিনাশের অতলে তলিয়ে মরার কথা বলেন ধৃতরাষ্ট্র। সন্তানের প্রতি ধৃতরাষ্ট্রের যে অনুভব বাংলাদেশ ফুটবলের প্রতি বোধকরি সেই একই নিবেদন বাদল রায়ের। দেশের ফুটবল যত ডুবেছে ততই তাকে শক্ত করে বুকে চেপে ধরেছেন বাদল রায়। ফুটবলের দুঃস্বপ্নের সঙ্গে হয়েছিলেন একাত্ম। চাওয়ার সীমানা ফুটবলের মধ্যে সুনির্দিষ্ট করে রেখেছিলেন আজীবন।

বাদল রায়কে স্কুল-কলেজে পড়ার সময় আমরা বলতাম ‘ছোট বাদল’। ছোট বাদল কতটা বড় মাপের ফুটবলার ছিলেন সেটা বিশ্লেষণ করার মতো বিশেষজ্ঞ আমি নই। তবে প্রাণ-মন সঁপে ফুটবলকে ভালোবাসার যে পরীক্ষা সেই জায়গাটিতে ছোট বাদলের চেয়ে বড় আর কে হতে পারে?

এক কথায় বাংলাদেশ ফুটবলকে বলা যায়, ঝলমলে আলো থেকে ঘোর আঁধারে পথ খুঁজে ফেরা পথিক। ফুটবল ক্রমেই ডুবেছে। মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে সবাই। দর্শকবিহীন গ্যালারি অট্টহাসি হাসছে! নিরুত্তাপ আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচ। ফুটবলের মরা গাঙ শুকাচ্ছে দিনকে দিন। পরিবারের সবচেয়ে মেধাবী সন্তানটির বখে যাওযার দশা হালের ফুটবলের! গ্যালিলিওয়ের ‘পড়ন্ত বস্তুর’ সূত্রকেও হার মানানো বাংলদেশ ফুটবল যেন দুঃস্বপ্নের সমার্থক। মানুষ দুঃস্বপ্নকে এড়াতে চায়, ভুলতে চায় প্রাণপণে। বাংলাদেশ ফুটবলের ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম হয়নি। ‘বখে যাওয়া’ সন্তান থেকে যতটা দূরে থাকা যায়, নিরাপদ থাকা যায়, এটাই যে যুগধর্ম। লাভ-ক্ষতির হিসাব কষা মানসিকতায় গড়ে ওঠা যুগধর্মকে অস্বীকার করার স্পর্ধাও তো কাউকে না কাউকে দেখাতেই হয়! এই বিরল ব্যতিক্রমের একজন বাদল রায়।

বাংলাদেশ ফুটবলের দুই প্রজন্মের সেতুবন্ধন বাদল রায়। ফুটবলের সঙ্গে গাঁটছড়া সাড়ে চার দশক। খেলোযাড়ি জীবন শেষ করে সংগঠক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন আমৃত্যু। বাফুফে’র (বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন) তিন তিনবারের নির্বাচিত সহসভাপতি। অসুস্থ শরীর নিয়েও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন সর্বশেষ বাফুফে নির্বাচনে। বিশেষ পরিস্থিতির এই নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় মাঠ ছাড়েননি। ঠিক খেলোয়াড়ি জীবনের মতোই!

একটা কথা বলে রাখা ভালো যে, ছোট বাদল আমার খুবই অপ্রিয় (!) ছিলেন। বিশেষ করে আমার স্কুল-কলেজে পড়ার সময়টাতে। বিষয়টা একটু খোলাসা করা যাক। আমরা ১৯৮০-র দশকে ফিরে যাই। পুরো দেশ তখন আবাহনী-মোহামেডান দুই শিবিরে বিভক্ত। প্রাইমারি স্কুলের গণ্ডি পেরুনোর আগেই আমি আবাহনীর ঘোর সমর্থক। আবাহনীর পরাজয় মেনে নেওয়া আমার জন্য তখন মৃত্যুর সমতুল্য। আবাহনী হেরে গেলে ঘুম-নাওয়া-খাওয়া সব মাথায় উঠত। শুধু আমি কেন, প্রিয় দলের জন্য এমন ভালোবাসার উন্মাদনা তখন দেশজুড়ে। ছোট বাদল মোহামেডানে খেলেন। ফলে তাকে অপছন্দ (!)  করার জন্য আর খুব বেশি কারণের দরকার পড়ে না। 

আর একটা কারণ ছিল ভয়। কেননা মোহামেডানে আছেন বাদল রায়ের মতো অ্যাটাকিং মিড ফিল্ডার। যে কোনো পরিস্থিতিতে ম্যাচ বের করে আনতে পারেন। গোল করতে সিদ্ধহস্ত। আবার প্রয়োজনের সময় গোল করে আবাহনীর বাড়া ভাতে ছাই ঢেলে দিতেও সিদ্ধহস্ত। ১৯৮২ সালে আবাহনীকে সর্বস্বান্ত করে ছেড়েছিল মোহামেডান। সেবার ১৭টা ট্রফি ঘুরে তুলেছিল সাদা-কালো জার্সিধারীরা। রেকর্ডে লেখা থাকবে ওই মৌসুমে লীগে ২৭ গোল করে রেকর্ড গড়েছিলেন মোহামেডান স্ট্রাইকার সালাম মুর্শেদী। এই রেকর্ডেও আরেকটা বিষয় অনেকের স্মৃতিতেই উজ্জ্বল। সালামের রেকর্ডটি সম্ভব হয়েছিল কার বুদ্ধিদীপ্ত কুশলী নৈপুণ্যে এটা খুব ভালোভাবেই জানেন প্রত্যক্ষদর্শীরা। সালাম মুর্শেদীর ২৭ গোলের বেশিরভাগই এসেছিল ছোট বাদলের অ্যাসিস্ট থেকে। সেইসঙ্গে গোল করেছিলেন অনেকগুলো গুরুত্বপুর্ণ ম্যাচে। সম্ভবত ওই মৌসুমে ১৩ গোল করেছিলেন বাদল রায়। ১২ বছর বয়সী আবাহনী অন্তঃপ্রাণ একজন সমর্থকের পক্ষে ছোট বাদলকে পছন্দ করার আদৌ কি কোনো কারণ আছে?

বাদল রায়কে বুঝতে চাইলে মধ্য সত্তর থেকে আশির দশকের শেষ পর্যন্ত ফুটবল তো বটেই বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক- রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট জানা এবং বোঝা জরুরি। বড়দের মুখে শুনতাম- তোমরা এনায়েতকে দেখোনি। তবে এনায়েত না থাকলেও ছোট বাদল কিন্তু আছে। বাংলাদেশ ফুটবলের সবচেয়ে আলোচিত দুটো  নাম এনায়েত ও সালাউদ্দীন। সাদা-কালো জার্সিতে এনায়েতের পজিশনেই খেলতেন বাদল রায়। এনায়েতকে রিপ্লেস করতে হচ্ছে, এই চ্যালেঞ্জটা বাদল রায়ের জন্য কত বড় ছিল, সেটা অনুধাবন করতে বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। ওই সময় কিছু ব্যতিক্রম বাদে আবাহনী আর আওয়ামী লীগ অনেকটা সমার্থক। ঠিক এরকম একটা সময়ে ১৪ বছর (১৯৭৭ থেকে ১৯৯০) তিনি খেলেছেন মোহামেডানে। অনেকবার আলোচনায় থাকলেও কখনোই আবাহনী শিবিরে যোগ দেননি। রাজনৈতিকভাবে বাদল রায়ের আওয়ামী সংশ্লিষ্টতা নতুন করে কিছু বলার নাই। ১৯৮০ সালে ছাত্রলীগ থেকেই নির্বাচিত হন ডাকসু ক্রীড়া সম্পাদক হিসেবে। খেলোয়াড়ি জীবন শেষ করে সংগঠক হিসেবে যোগ দেন মোহামেডানে। বাংলাদেশে সহনশীল রাজনীতির একটা দৃষ্টান্ত বাদল রায়। দেশের বিভাজিত রাজনীতির গড্ডালিকায় নিজেকে কখনোই ভাসাননি খেলোয়াড় কিংবা সংগঠক বাদল রায়। সুদীর্ঘ সময় মোহামেডানে কাটিয়েও নিজের রাজনৈতিক অবস্থান অটুট রাখা প্রসঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘মোহামেডানের একজন হয়েও আমার ছাত্রলীগ করতে সমস্যা হতো না। ওই সময় মোহামেডান খুব প্রগ্রেসিভ ছিল। আমার রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা নিয়ে কেউ মাথা ঘামাত না। তবে ফুটবল ক্যারিয়ার শেষ হওয়ার পর দেখছি- ক্লাবগুলোতে রাজনৈতিক বিভাজন প্রকট হয়ে উঠেছে।’

বাংলাদেশে খেলোয়াড়ি জীবন শেষ হওয়ার পর টিকে থাকাটা বেশ কঠিন। রিটায়ারমেন্টের পর বেশিরভাগই ব্যবসাকেই পেশা হিসেবে বেছে নেন। বাদল রায়ের জন্য পরিস্থিতি ছিল আরও জটিল। কেননা রাজনীতির সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা। এত কিছুর মধ্যেও, ফুটবলকেই স্থান দিয়েছেন সবার উপরে। এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘যা কিছু পেয়েছি ফুটবলের জন্যই। তাই খেলাটির সঙ্গে লেগে থাকতে চাই। আর এটা করতে গিয়ে ব্যবসার ক্ষতি হচ্ছে। রাজনীতিতেও সেভাবে মনোযোগ দিতে পারছি না।  তারপরও ফুটবলের সঙ্গে আছি, থাকব। চেষ্টা করে দেখি না, ফুটবলের সেই হারানো দিন আবার ফেরানো যায় কিনা?’

বাদল রায় তার ৬৩ (জন্ম ১৯৫৭ সালের ৪ জুলাই) বছরের জীবনের সাড়ে চার দশকেরও বেশি সময় কাটিয়েছেন ফুটবলের সঙ্গে। ফুটবলের সোনালি অতীত ফেরানোর চ্যালেঞ্জ নিয়েছিলেন। সেই চ্যালেঞ্জে বাদল রায় কতটা জয়ী হয়েছেন সেই প্রশ্ন অবান্তর। কেননা স্বপ্নছোঁয়াকে যারা জীবনের পরম ধ্যান-জ্ঞান হিসেবে নেন, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির বাটখারা দিয়ে তাদের পরিমাপ করা যায় না। বাংলাদেশ ফুটবলের ঝঞ্জা-বিক্ষুব্ধ সময়ে সবটুকু জীবনীশক্তি বাজী রেখে লড়াই করে গেছেন বাদল রায়। ছোট বাদলের জীবনটাও অনেক ছোট। যদিও ফুটবলকে ঘিরে সবসময়ই দেখেছেন বড় স্বপ্ন। বাংলাদেশ ফুটবল এখন অতীতের ছায়ামাত্র। তবে স্বপ্নটুকু তো হারিযে যেতে দেননি বাদল রায়! এখন এটাই বাংলাদেশ ফুটবলের সবচেয়ে বড় পুঁজি।

লেখক: ক্রীড়া সাংবাদিক

ঢাকা/তারা

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়