সু চি’র সঙ্গে সেনাবাহিনীর সম্পর্কে যে কারণে ফাটল
মো. রায়হান কবির || রাইজিংবিডি.কম
![সু চি’র সঙ্গে সেনাবাহিনীর সম্পর্কে যে কারণে ফাটল সু চি’র সঙ্গে সেনাবাহিনীর সম্পর্কে যে কারণে ফাটল](https://cdn.risingbd.com/media/imgAll/2020August/risingbd-2102020638.jpg)
গণতন্ত্রের পাখি আবারও সেনাদের খাঁচায় বন্দি
সেনা তোষণেও শেষ রক্ষা হলো না। ১৯৯১ সালে শান্তিতে নোবেলজয়ী অং সান সু চি ২০১৭ সালে মিয়ানমারের পশ্চিমে রাখাইন প্রদেশে রোহিঙ্গা মুসলিমদের উচ্ছেদ এবং গণহত্যার জন্য আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপক সমালোচিত হন। কেননা সেসময় রাষ্ট্র ক্ষমতায় সু চি ছিলেন। গণতন্ত্রের নেত্রীর রোহিঙ্গা ইস্যুতে নিশ্চুপ ভূমিকায় বিশ্ব বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে যায়। দাবি ওঠে সু চি’র নোবেল ফিরিয়ে নেওয়ার।
সে সময়ে রোহিঙ্গা গণহত্যা এবং উচ্ছেদ প্রসঙ্গে সু চিকে সামরিক জান্তাদের সঙ্গে সুর মেলাতে দেখা গিয়েছিল। ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্যই তিনি এমন করছেন বলে তখন অনেকেই মনে করতেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত শেষ রক্ষা হলো না! পুনরায় নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতা গ্রহণের দিনই তাকে কারাবন্দি হতে হলো।
কিন্তু কেন? গত বছরের ৮ নভেম্বর সাধারণ নির্বাচনে সু চি’র দল এনএলডি ৮০ শতাংশেরও বেশি ভোটে জয়ী হয়। রোহিঙ্গা মুসলিমদের গণহত্যা ও উচ্ছেদের অভিযোগে অভিযুক্ত সু চি’র দল তারপরও জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে সক্ষম হয়। কেননা বিরোধী পক্ষ ছিল সেনা মদদপুষ্ট- ইউএসডিপি। ২০০৮ সালের সংবিধান সংশোধনে মিয়ানমারের সংসদে ২৫ শতাংশ আসন সেনা সদস্যদের জন্য বরাদ্দ। শুধু তাই নয়, গুরুত্বপূর্ণ কিছু মন্ত্রণালয়ও (স্বরাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা এবং সীমান্ত) তাদের হাতে। ফলে ক্ষমতায় এমনিতেই সেনাদের ভাগ থাকার পরও আবারও একটি সেনা মদদপুষ্ট দল ক্ষমতায় দেখতে চায়নি মিয়ানমারের জনগণ। তাই তারা সু চি’র দলকেই বেছে নেয়।
এদিকে ২০১৫ সালের নির্বাচনের পর ক্ষমতায় এসে মেয়াদের শেষ দিকে সু চি সংবিধানে কিছুটা পরিবর্তন আনেন। বলাবাহুল্য বিষয়টি সামরিক বাহিনী ভালো চোখে দেখেনি। তারা এখন ভাবছে সু চি’র দল এবার ৮০ শতাংশেরও বেশি ভোটে জয়ী হয়েছে, ফলে তারা আরো বেশি সংবিধান সংশোধনের চেষ্টা করবে। যদিও সেটা পুরোপুরি অসম্ভবই বলা চলে। কারণ সংসদের ২৫ শতাংশ সেনাদের জন্য সংরক্ষিত। কিন্তু তারপরও ক্ষমতা নিজেদের হাত থেকে বেহাত হওয়ার আশঙ্কায় সু চি এবং এনএলডি’র শীর্ষস্থানীয় নেতাদের আটক করা হয়েছে। অভিযোগ আনা হয়েছে ভোট কারচুপির। এক বছরের জন্য জারিকৃত জরুরি অবস্থার ঘোষণায় বলা হয়- বিগত নির্বাচনে এক কোটিরও বেশি ভোট জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু এ বিষয়ে কোনো প্রমাণ উপস্থাপন করা হয়নি। এশিয়া অঞ্চলের হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ডেপুটি ডিরেক্টর ফিল রবার্টসন বলেন, ‘অবশ্যই অং সান সু চি একটি দুর্দান্ত জয় (নির্বাচনে) পেয়েছেন’। তিনি আরও বলেন, ‘নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ আনা হয়েছে। এটা কিছুটা “ট্রাম্পিয়ান”-কেননা এসব অভিযোগের পক্ষে কোনো প্রমাণ নেই’।
মিয়ানমারের জনগণও বিশ্বাস করে নির্বাচনে কারচুপি হয়নি। ইয়াঙ্গুনের একজন প্রযুক্তি বিষয়ের শিক্ষার্থী বিবিসিকে জানান, ‘মিয়ানমারের সেনা তাদের মদদপুষ্ট দল ইউএসডিপি’র পরাজয় ভাবতেই পারেনি। এমনকি যাদের পরিবার থেকে সেনাবাহিনীতে কর্মরত আছেন তারাও ইউএসডিপিকে ভোট দেয়নি’।
অন্যদিকে মিয়ানমারের সাবেক একজন সাংবাদিক বিবিসি’র সঙ্গে আলাপচারিতায় জানান, আন্তর্জাতিক মিডিয়া অং সান সু চি’কে ‘মিয়ানমারের মা’ হিসেবে ডেকে থাকে। অন্যদিকে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী নিজেদের ‘জাতির পিতা’ মনে করে।
তাছাড়া মিয়ানমার পাঁচ দশক সেনা শাসনের পর যখন গণতন্ত্রের পথে হাঁটতে শুরু করে তখন বেশ কিছু বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়। ফলে এখন আর তাদের সেদিকে ফিরে না তাকালেও চলবে। অন্যদিকে সেনাদের সঙ্গে চীনের সমর্থন সর্বদাই থাকে। সুতরাং চীন ছাড়া বাকি বিশ্বের সমর্থন পাওয়া না-পাওয়াটা মিয়ানমারের সামরিক জান্তারা খুব একটা আমলে নেয় না। ফলে আমেরিকার সর্বশেষ নির্বাচনে যেভাবে ট্রাম্প পরাজয়ের পর কোনো প্রমাণ ছাড়াই নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ আনেন, মিয়ানমারও সে পথেই হাঁটছে।
পার্থক্য হলো ট্রাম্প গণতন্ত্রের কাছে পরাজয় মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে। কেননা আমেরিকার গণতন্ত্র বিশ্বের কাছে অনুকরণীয় এবং তাদের রয়েছে গণতন্ত্রের দীর্ঘ ইতিহাস। আর মিয়ানমারের গণতন্ত্রের ইতিহাসই খুব নড়বড়ে এবং যৎসামান্য। যে কারণে মিয়ানমারে ‘ট্রাম্প তত্ত্ব’ সফলভাবে প্রয়োগ করা সম্ভব হয়েছে। সু চি হয়তো সেনা ছত্রছায়া থেকে বের হওয়ার চেষ্টায় ছিলেন, যেটা সামরিক বাহিনী বুঝতে পেরেছিল। সু চি’র সেই চেষ্টা থামিয়ে দিতেই তাকে ক্ষমতা থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়া হলো।
লেখক: প্রাবন্ধিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক
ঢাকা/তারা
আরো পড়ুন