ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

আম ব্যবসায়ীর আত্মহত্যা, ভাবতে হবে নতুন করে 

আজমাল হোসেন মামুন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:০২, ৫ জুলাই ২০২১   আপডেট: ১৪:১০, ৫ জুলাই ২০২১
আম ব্যবসায়ীর আত্মহত্যা, ভাবতে হবে নতুন করে 

করোনাসৃষ্ট মহামারির কারণে আমের বাজার এবার মন্দা। এতে আমচাষিরা আর্থিকভাবে ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন। বিষয়টি জাতীয় দৈনিকগুলোতে খবরের শিরোনাম হয়েছে। বিশেষ করে আমের মৌসুমের শুরু থেকেই উত্তরবঙ্গের চাঁপাইনবাবগঞ্জে করোনার প্রভাব বেড়ে যাওয়ায় এই জেলার আমচাষিরা এ বছর আমের দাম পাননি। অথচ আম চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলাবাসীর প্রধান অর্থকরী কৃষিপণ্য।

জেলায় ৩৩ হাজার ৩৫ হেক্টর জমিতে আম চাষ হয়। চলতি বছর প্রায় তিন লাখ টন আম উৎপাদন হয়েছে। যা দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ। এ থেকেই বোঝা যায়, আম চাঁপাইনবাবগঞ্জের অর্থনীতিতে কতটা ভূমিকা পালন করে। অর্থাৎ আম এ অঞ্চলের মানুষের জীবন-জীবিকার অন্যতম মাধ্যম। চাঁপাইনবাবগঞ্জের ৬০ ভাগ মানুষ প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে আম চাষ ও আম ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। কেউ আম বাগানের যোগানদার, কেউ পরিচর্যায় নিয়োজিত কর্মী, কেউ গাছ থেকে আম পাড়েন, কেউ-বা আমের ঝুঁড়ি বা টুকরি ও কার্টন তৈরি করেন ইত্যাদি।

শুধু তাই নয়, কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে আম পাঠানো জনপ্রিয় হওয়ায় অনেক মানুষের কর্মসংস্থান হয় আমের মৌসুমে। গত ৫ বছর অনলাইনে আমের ব্যবসা করেও তরুণদের মধ্যে অনেকেই স্বাবলম্বী হয়েছেন। এদের সংখ্যা পাঁচ শতাধিক এবং এরা তরুণ উদ্যোক্তা। অনেক শিক্ষার্থী পড়াশোনার পাশাপাশি আমের ব্যবসায় জড়িত। প্রায় লক্ষাধিক মানুষের কর্মসংস্থান হয় আম থেকে। সবচেয়ে বড় বিষয় প্রতিদিন প্রায় ২৫ থেকে ৩০ কোটি টাকার আম বিক্রি হয় এশিয়ার সর্ববৃহৎ আমের বাজার কানসাটে। বিষয়গুলো এ কারণেই উল্লেখ করা হলো যে, আমের বাজারে মন্দার প্রভাব এই অঞ্চলের সব মানুষের ওপর পড়েছে। 

বলে রাখা ভালো, প্রকৃতি ও আবহাওয়ার কারণে আম চাষ এই অঞ্চলে অনেক বেড়েছে। এই জেলাবাসীর নিকট আমের ‘অন ইয়ার’ এবং ‘অফ ইয়ার’ নামে দুটি শব্দ ব্যাপকভাবে চালু রয়েছে। যে বছর আমের ফলন ভালো হয় তাকে ‘অন ইয়ার’ বলে এবং যে বছর ফলন ভালো হয় না তাকে ‘অফ ইয়ার’ বলা হয়। যদিও কৃষিবিজ্ঞানীরা এ ধারণা বিজ্ঞানসম্মত নয় বলে মনে করেন। সবটাই নির্ভর করে প্রকৃতির উপর। তারপরও  চলতি বছর ছিল আমের ‘অন ইয়ার’। 

অন ইয়ারেও আম ব্যবসায়ীরা হতাশ। আমের ন্যায্য মূল্য নেই বলে অনেকেই পুঁজি হারিয়ে পথে বসেছেন। পরিচিত এক আম ব্যবসায়ী আক্ষেপ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেইসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন ‘কিয়ামত পর্যন্ত আর আমের ব্যবসা করবো না।’ গত ১৬ জুন চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার নয়ালাভাঙ্গা ইউপির মিয়াপাড়া গ্রামে আম ব্যবসায়ী মো. লালচাঁদ (৪৭) আম ব্যবসায় লোকসানের শিকার হয়ে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন এবং ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন (সূত্র: দৈনিক সমকাল)।

এ সময় খিরসাপাত আমের মণ যেখানে প্রায় ৫০০০ টাকা হওয়ার কথা সেখানে অর্ধেক দামে বিক্রি হচ্ছে। সব প্রজাতির আমের ক্ষেত্রেই দাম অর্ধেকেরও কম। ফলে ব্যাপক লোকসানের আশঙ্কা করছেন আম ব্যবসায়ীরা। চাঁপাইনবাবগঞ্জে আম কেনা হয় কয়েক পদ্ধতিতে। এক শ্রেণির ব্যবসায়ী আম বাগান কিনে নেন কয়েক বছরের জন্য। কেউ আমের মুকুল দেখে বাগান কেনেন। কেউ পরিপক্ক আম দেখে বাগান কেনেন। কেউ সরাসরি বাজার থেকে আম কেনেন। বেশিরভাগ আম বিক্রি হয় আড়তের মাধ্যমে বেপারির কাছে। কিন্তু এ বছর কোভিড-১৯ এর জন্য পর্যাপ্ত ব্যাপারি আসতে পারেনি। করোনার পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষের নাজুক অর্থনীতি, লকডাউনের কারণে দুর্বল বিপণন ব্যবস্থা, অধিক ফলন এবং করোনা আরো খারাপ পরিস্থিতি তৈরি করায় কঠোর বিধিনিষেধের ভীতির জন্য বাজারে আমের জোগান বাড়লেও ক্রেতা না থাকায় আমের ন্যায্য মূল্য পাচ্ছেন না ব্যবসায়ীরা।

লকডাউনে মানুষ যেখানে ঘরে অবস্থান করতে বাধ্য হচ্ছে, সেখানে কে আম কিনবে? কানসাট থেকে আমের চালান হচ্ছে কিন্তু মোকামে বিক্রি হচ্ছে না। তাছাড়া আম বেশিদিন রাখাও সম্ভব নয়। পাকা আম দ্রুত পঁচে যায়। সব কিছু বিবেচনায় সরকারিভাবে আমের গাড়িকে লকডাউনের আওতামুক্ত রাখা হয়। গত ২৭ মে দুপুরে গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সে ‘ম্যাংগো স্পেশাল ট্রেন’ উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ফলে চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে মাত্র ৫০ পয়সা কেজিতে আম রাজধানীতে পাঠানোর সুযোগ পেয়েছেন আম চাষি এবং ব্যবসায়ীরা। অথচ কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে প্রতি কেজি আম পরিবহনে খরচ পড়ে প্রায় ১৫ টাকা। আম পরিবহনে প্রশাসন সর্বাত্মক সহযোগিতাও করেছে। এটি আম ব্যবসায়ীদের জন্য ভালো দিক। কিন্তু সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন আম সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা। প্রক্রিয়াজাত করণের ওপর নজর দেওয়ার সময় এসেছে। এটি সরকারিভাবে করা হলে আর পাকা আম পঁচে যাওয়ার আশঙ্কা থাকবে না।    

এর পাশাপাশি জেলার আম চাষিদের প্রণোদনা প্রয়োজন। সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকগুলোকে স্বল্প সুদে তাদের ঋণ দিতে হবে। করোনাকালে এই ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে এর বিকল্প নেই। 

ঢাকা/তারা

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ