ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

সাইমন ড্রিং: বাংলাদেশের বন্ধুর চেয়েও বেশি কিছু

অলোক আচার্য || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:২৩, ২৩ জুলাই ২০২১   আপডেট: ১৩:২৬, ২৩ জুলাই ২০২১
সাইমন ড্রিং: বাংলাদেশের বন্ধুর চেয়েও বেশি কিছু

সাইমন ড্রিং

সাইমন ড্রিং। সাংবাদিক পরিচয়ের চেয়েও এ দেশের মানুষের কাছে তার বড় পরিচয়- তিনি বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু। আমাদের গর্বের ইতিহাসের সঙ্গে তার নাম জড়িয়ে আছে।

১৯৭১ সালে পাকিস্তানিদের সঙ্গে যুদ্ধে আমাদের জয় লাভ। যে যুদ্ধের সূচনা হয়েছিল ২৫ মার্চ রাতে। এই যুদ্ধের সঙ্গে, এই ভয়ঙ্কর বিধ্বস্ত রাতের ইতিহাসের সঙ্গে তিনি জড়িয়ে আছেন। বিশ্ববাসী আজ জানে, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি বাহিনী নির্মম নির্যাতন চালায় নিরীহ ঘুমন্ত বাঙালির ওপর। সেই নির্মম নির্যাতনের খবর বিশ্ববাসীকে প্রথম জানানোর উদ্যোগ নেন সাইমন ড্রিং। তিনি সেদিন এই কাজ করতে গিয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়েছিলেন। তিনি এ ঘটনা প্রতিবেদন আকারে প্রেরণ করেন ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায়। ‘ট্যাঙ্কস ক্রাশ রিভল্ট ইন পাকিস্তান’ শিরোনামে প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়। এবং এ কাজের জন্য ২০১২ সালে ‘ইন্টারন্যাশনাল রিপোর্টার অব দ্য ইয়ার’ অর্জন করেন তিনি।

ওই প্রতিবেদনে সাইমন ড্রিং উল্লেখ করেন, আল্লাহর নামে এবং অখণ্ড পাকিস্তান রক্ষার অজুহাতে ঢাকা আজ ধ্বংসপ্রাপ্ত, সন্ত্রস্ত এক নগর’। তাকে পাকিস্তান সরকার সেসময় জোরপূর্বক দেশ থেকে বের করে দেয়। ৩০ মার্চ সাইমনকে লন্ডন চলে যেতে হয়। তারপর কলকাতা ফিরে আসেন নভেম্বরে। সেখান থেকেই মুক্তিযুদ্ধের খবর সংগ্রহ করে পাঠাতেন লন্ডনের টেলিগ্রাফ পত্রিকায়। ১৬ ডিসেম্বর মিত্রবাহিনীর সঙ্গে ট্যাংকে চড়ে ময়মনসিংহ হয়ে তিনি পুনরায় প্রবেশ করেন স্বাধীন বাংলাদেশে। যে কারণে মুক্তিযুদ্ধের শুরু এবং শেষ অর্থাৎ বাঙালির বিজয়ের দিনের সাক্ষীও তিনি। তিনিই ছিলেন বাংলাদেশে চালানো পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হত্যাযজ্ঞের প্রথম বিদেশি প্রত্যক্ষদর্শী।

একাত্তরে যুদ্ধে নির্মমতার খবর সংগ্রহ করে বিশ্ববাসীকে জানানোর যে দায়িত্ব তিনি কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন সেটা শুধু তার পেশাগত দায়িত্ব পালনই ছিল না, এ দেশের মাটি, মানুষকে তিনি ভালোবেসেছিলেন। স্বাধীন দেশে এর নজিরও তিনি স্থাপন করেছেন। তার সেসময়ের উদ্যোগ বাঙালির পক্ষে বিশ্বে জনমত গঠন করতে এবং পাকিস্তানি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ গড়ে তুলতে ভূমিকা রেখেছে। এ জন্য পাকিস্তানিদের রোষানলেও তিনি পড়েছেন।কিন্তু কর্তব্যে ত্রুটি রাখেননি বরং অবিচল থেকেছেন। সাংবাদিকতায় ছিল তার এমনই নিষ্ঠা। যে কারণে মৃত্যুকেও পরোয়া করেননি তিনি।

আজ যুদ্ধাক্রান্ত বিভিন্ন দেশে সাংবাদিকরা দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে হত্যা, নির্যাতন এবং গুমের মতো চূড়ান্ত পরিণতি বরণ করছেন। সাংবাদিকতা মানেই সাহসী পদক্ষেপ। আর ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে যে কোনো পরিণতি স্বীকার করেই সাংবাদিকতা করতে হয়। সায়মন ড্রিং এ কথা মেনে নিয়েছিলেন।  তিনি পৃথিবীর বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে সাংবাদিকতা করেছেন বিশ্বখ্যাত সব গণমাধ্যমের হয়ে।

প্রকৃত বন্ধুর বৈশিষ্ট্য হলো বন্ধুর দুঃসময়ে সাহায্য করতে এগিয়ে আসা। এই ভূমিকাতেও তাকে আমরা দেখেছি। সাইমন ড্রিং কেবল বাংলাদেশের বন্ধু ছিলেন না, তিনি ছিলেন পৃথিবীর বিপদগ্রস্ত মানুষের অকৃত্রিম বন্ধু। দক্ষিণ আফ্রিকার দুর্ভিক্ষপীড়িত অঞ্চলের জনগণকে সহায়তার জন্য তিনি একটি দাতব্য তহবিলের ধারণা তুলে ধরেন। এই তহবিল সৃষ্টি ইতিহাসের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা; যেখানে ১২০টি দেশের ২০ মিলিয়ন মানুষ একটি অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে। ১৯৮৬ সালে তিনি দুটি দাতব্য তহবিল গড়েন। এই তহবিলে পূর্বের চেয়েও বেশি দেশের বেশি মানুষ অংশগ্রহণ করে। মানুষের জন্য সায়মন ড্রিং এভাবেই প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছেন। সাংবাদিকতার দায় শোধ করেই কর্তব্য শেষ করেননি। তিনি করতে চেয়েছেন আরো বেশি কিছু। আর এখানেই তিনি হয়ে উঠেছেন অনন্য।

যদিও এ দেশ থেকে সাইমন ড্রিং-এর শেষবারের চলে যাওয়াটা সম্মানজনক হয়নি। এর দায় তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের। এবং সেই লজ্জা পুরো জাতির। সাইমন ড্রিং স্বাধীন বাংলাদেশে পুনরায় আসেন ২০০০ সালে। এ দেশের প্রথম বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল একুশে টিভি গড়ে তোলেন তিনি। দেশে এ সময়ের অনেক বিখ্যাত টিভি সাংবাদিক তার হাতে গড়া। কিন্তু ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর একুশে টিভি বন্ধ করে দেয়। ২০০২ সালের অক্টোবরে সরকার সাইমন ড্রিংয়ের ভিসা ও ওয়ার্ক পারমিট বাতিল করে তাকে অবিলম্বে বাংলাদেশ ত্যাগের নির্দেশ দেয়। এরপর তিনি ভগ্নহৃদয়ে চলে যান।

সাইমন ড্রিং ইংল্যান্ডে ১৯৪৫ সালের ১১ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। তার বয়স যখন মাত্র ১৬ বছর তখন তিনি ঘর ছাড়েন। কর্মজীবন শুরু হয় ১৮ বছর বয়সে পত্রিকায়। সেই থেকে আমৃত্যু তিনি একাধিক পত্রিকার হয়ে বিশ্বের বহু দেশে দায়িত্ব পালন করেছেন। দেখেছেন ২২টি যুদ্ধ, অভ্যুত্থান ও বিপ্লব। সংবাদ সংগ্রহে তিনি দু’বার আহতও হন। প্রথমবার ভিয়েতনামে এবং দ্বিতীয়বার তুর্কিদের আগ্রাসনে। এরপরও তিনি থেমে থাকেননি। ১৯৬৩ সালে তিনি থাইল্যান্ডের ব্যাংকক ওয়ার্ল্ড সংবাদপত্রে সম্পাদনা সহকারী হিসেবে কাজে যোগ দেন। এরপর নিউইয়র্ক টাইমস ও রয়টার্সের মতো খ্যাতনামা গণমাধ্যমে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭০ এবং ১৯৮০-এর দশকে তিনি ডেইলি টেলিগ্রাফ এবং বিবিসি টেলিভিশন নিউজের বৈদেশিক সংবাদদাতা হিসেবে কাজ করেছেন। সাইমন ড্রিং গত ২০ জুলাই ৭৬ বছর বয়সে রোমানিয়ায় মৃত্যুবরণ করেন। তিনি এ সময় তার স্ত্রী ফিয়োনার কর্মস্থলে ছিলেন। 

লেখক: সাংবাদিক
 

ঢাকা/তারা

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়