ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

বেহুলা ও বঙ্গবন্ধু

কামরুল আহসান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:২৪, ২৫ আগস্ট ২০২১  
বেহুলা ও বঙ্গবন্ধু

শেখ মুজিবুর রহমান কীভাবে বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠলেন, একটি জাতির স্থপতি হয়ে উঠলেন এটা অনেকের কাছেই বিস্ময়কর একটি ঘটনা। তিনি তো পাড়াগাঁয়ের এক সাধারণ কিশোর। গ্রামের অন্যান্য দামাল ছেলেদের মতোই তাঁর ছেলেবেলা কেটেছে নদীর পানিতে ঝাঁপিয়ে, ঘুঘু পাখির ডিম খুঁজে, ফুটবল খেলে। এর মধ্যে কী এমন হয়ে গেল যে তিনি বিশ্বের এক অবিসংবাদিত নেতা হয়ে উঠলেন।

বিশিষ্ট লেখক হায়াৎ মামুদ লিখেছেন: ‘ব্যক্তি হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমানের সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠা, আমার বিবেচনায়, অত্যন্ত ব্যতিক্রমী, দলছুট এক ঘটনা। খুবই লক্ষণীয় বিষয়, প্রাক-সাতচল্লিশ অবিভক্ত বাংলার রাজনীতিতে সত্যিকার অর্থে কোনো ‘সাধারণ’ অভাজন ব্যক্তির অস্তিত্ব ছিল না। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু, শরৎচন্দ্র বসু, কিরণশঙ্কর রায়, সোহরাওয়ার্দী, শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, আবুল হাশিম প্রমুখ সকলেই ‘অভিজন’, এলিট শ্রেণির মানুষ। এমনকি শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুর হক যে তাদেরই স্বগোত্র- তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা, পেশা, অতুলনীয় বাগ্মিতা বিচার করলে না মেনে উপায় নেই। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীও ‘অসাধারণ’ তাঁর উৎসের কারণে; একই সঙ্গে ধর্মবেত্তা ও ধর্মীয় নেতা হওয়ার ফলে এক ধরনের বিশিষ্টতা স্বতঃসিদ্ধ ও স্বপ্রতিষ্ঠ হয়ে ওঠে তাঁর ক্ষেত্রে। এদের প্রত্যেকের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর সামাজিক অবস্থানগত পার্থক্য উপলব্ধি না করলে এই বয়ঃকনিষ্ঠ উত্তরসূরির অনন্যতা শনাক্ত করা সম্ভব নয়।’[১]

এর মধ্যে একটা বিশেষ ঘটনা ঘটেছিল ১৯৩৮ সালে। তখন তিনি ১৮ বছরের তরুণ। চার বছর অসুস্থ ছিলেন বলে পড়াশোনায় ছেদ পড়েছিল। একটু বড় বয়সেই তিনি গোপালগঞ্জ মহকুমার মিশনারি হাই স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন। তখন শেরে বাংলা ফজলুল হক আর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এসেছিলেন গোপালগঞ্জে। শেরে বাংলা তখন বাংলার প্রধানমন্ত্রী আর সোহরাওয়ার্দী শ্রমমন্ত্রী। তাদের সংবর্ধনা জানাতে বিরাট জনসভার আয়োজন করা হয়েছিল। অন্যান্য ছাত্রদের তুলনায় দেখতে বড় হওয়ার কারণে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী করার ভার পড়ল শেখ মুজিবের উপর। সোহরাওয়ার্দী মিশন স্কুল পরিদর্শনে এসেছিলেন। বঙ্গবন্ধু তখন তাঁকে বললেন, বৃষ্টি হলে তাদের স্কুলের ছাদ দিয়ে পানি পড়ে, স্কুলটি মেরামত করার ওয়াদা দিয়ে যেতে হবে তাঁকে।

সোহরাওয়ার্দী এই তরুণতুর্কির কথায় চমৎকৃত হলেন। সোহরাওয়ার্দীকে লঞ্চঘাট পর্যন্ত পৌঁছে দিতে গেলেন শেখ মুজিব। যেতে যেতে সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে তার আরো কিছু কথা হলো। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন: ‘‘তিনি ভাঙা ভাঙা বাংলায় আমাকে কিছু জিজ্ঞাসা করছিলেন, আর আমি উত্তর দিচ্ছিলাম। আমার দিকে চেয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, আমার নাম এবং বাড়ি কোথায়। একজন সরকারি কর্মচারী আমার বংশের কথা বলে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন। তিনি আমাকে ডেকে নিলেন খুব কাছে, আদর করলেন এবং বললেন, ‘তোমাদের এখানে মুসলিম লীগ করা হয় নাই?’ বললাম, ‘কোনো প্রতিষ্ঠান নাই। মুসলিম লীগও নাই।’ তিনি আর কিছুই বললেন না, শুধু নোটবুক বের করে আমার নাম ও ঠিকানা লিখে নিলেন। কিছুদিন পরে আমি একটা চিঠি পেলাম, তাতে তিনি আমাকে ধন্যবাদ দিয়েছেন এবং লিখেছেন কলকাতা গেলে যেন তাঁর সঙ্গে দেখা করি। আমিও তাঁর চিঠির উত্তর দিলাম। এইভাবে মাঝে মাঝে চিঠিও দিতাম।” [২]

ঘটনা ওটুকুই। ১৯৩৯ সালে কলকাতা বেড়াতে গিয়ে সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে দেখা করেন শেখ মুজিব। তারপর কলকাতা পড়তে গিয়ে ছাত্র রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। এর মধ্যে ১৯৪৩ সালে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ শুরু হয়। তিনি মানবতার সেবায় ঝাঁপিয়ে পড়েন। এ পর্যন্ত সবই স্বাভাবিক ঘটনা। তখনকার অনেক সচেতন শিক্ষিত তরুণই ছাত্ররাজনীতি ও মানবতার সেবায় আত্মনিয়োগ করেছিলেন। চোখে পড়ার মতো বিরল কোনো ঘটনা শেখ মুজিব তখনো ঘটাননি। শেরে বাংলা ও সোহরাওয়ার্দীর সাথে পাকিস্তান আন্দোলনের কর্মী ছিলেন। দেশভাগের পর পূর্ব পাকিস্তান চলে আসেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হন। ১৯৪৮ সালের পরপরই ভাষা-আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন, ১৯৪৯ সালের এপ্রিল মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের অধিকার আদায়ের দাবিতে একাত্ম ঘোষণা করায় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত হন। যদিও মুচলেকা দিয়ে পুনঃবহালের সুযোগ ছিল, তাঁর সঙ্গে অনেকে তাই করেছেন। কিন্তু তিনি মুচলেকা না দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ করলেন। মুচলেকা দিলে দোষ স্বীকারা করা হয়, এই ছিল তার যুক্তি। 

এ ঘটনাটা একটু বিশেষ চোখে দেখা যায়। সেই সময়ে একজন ছাত্র এবং উঠতি ছাত্রনেতার পক্ষে এককথায় বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে দেয়াটা সহজ কথা না। পুরো জীবন পড়ে আছে সামনে, এবং তিনি জানেন না ভবিষ্যতে কী আছে? এর মধ্যে তার একটি সন্তানের জন্ম হয়েছে। সে সময় পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে সার্বক্ষণিক রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ার সিদ্ধান্তটি সহজ নয়, যখন সামনে বিপুল অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ!

এর কদিন পরেই রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ১৯ এপ্রিল তিনি জেলে যান। তারপর কিছুদিন বিরতীর পর  তাঁকে বারবার জেলে যেতে হয় ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত। তোফায়েল আহমেদ জানিয়েছেন ১৯৫৪ সালে নির্বাচনে জয়লাভের পরও তাঁকে জেলে যেতে হয়েছিল। ’৫৪-এর নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট বিজয়ী হওয়ায় তিনি মন্ত্রী হয়েছিলেন। যুক্তফ্রন্ট অচিরেই ভেঙে যায়। ১৯৫৬ সালে তিনি কোয়ালিশন সরকারের বাণিজ্যমন্ত্রী হন। এসব ঘটনাকে খুব বিরাট কিছু হিসেবে দেখার সুযোগ নেই। এরকম মন্ত্রী তো অনেকেই হচ্ছেন। তাঁর রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে বিস্ময়কর ঘটনা ’৬৬’র ছয় দফা। ছয় দফা স্পষ্টতই স্বাধীনতার ঘোষণা। যদিও বলা হয় স্বায়ত্তশাসন, আসলে তো পাকিস্তান যে আর টিকবে না তখনই বোঝা যাচ্ছিল। যেমন ১৯৪০ সালে এ কে ফজলুল হকের লাহোর প্রস্তাবের মধ্যেই নিহিত ছিল দেশভাগের পরিকল্পনা।

এই যে শেখ মুজিব লাহোরে গিয়ে ছয় দফা দিলেন, এটাই তাঁর রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে বড় টার্নিং পয়েন্ট। যা তাঁকে অনিবার্যভাবে অন্যদের চেয়ে আলাদা করে তুলল। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী তাঁর ‘দুই বাঙালীর লাহোর যাত্রা’ গ্রন্থে লিখেছেন: ‘শেখ যদি নিবৃত্ত হতেন, যদি ছয় দফা না দিতেন তাহলে তিনি অত বড় নেতা হতেন না; আর পাঁচজনের একজন হয়ে থাকতেন। পাঁচজনকে ছাড়িয়ে অতিরিক্ত একজন হবার সম্ভাবনা থাকতো না।’ [৩]

খুবই সত্য কথা । ছয় দফার পরই তাঁর বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করা হয়। পুরো জাতি বিক্ষোভে ফেটে পড়ে, যে-বিক্ষোভ রূপ নেয় ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে। শেখ মুজিব আরেকটা বুদ্ধিমানের মতো কাজ করেন, ১৯৭০ সালের পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে যোগ দেন, যা মওলানা ভাসানী বর্জন করেছিলেন। আওয়ামী লীগ বিপুল ভোটে জয়লাভ করে, এবং শেখ মুজিব গগণস্পর্শী এক নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন। তারপর স্বাধীনতা-অর্জন ছিল পালক তোলার মতো একটি ব্যাপার। যদিও তার জন্য প্রচুর রক্ত দিতে হয়েছে। কিন্তু, শেখ মুজিব ছাড়া হাজার বছর ধরে পরাধীন এ জাতিকে মুক্তির স্বপ্ন কে দেখিয়েছিল? তাও ১৯৭১ সালের আগ পর্যন্ত এ ছিল এক অকল্পনীয় ব্যাপার। এমন কি মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীনও অনেকে বিশ্বাস করতে পারেননি যে- সত্যি সত্যি দেশ স্বাধীন হয়ে যাবে! 

এই যে একটা সমগ্র জাতিকে এমন অপরূপ স্বপ্নে জাগিয়ে তোলা, এই প্রেরণা বঙ্গবন্ধু কোত্থেকে পেয়েছিলেন? কোত্থেকে তিনি পেলেন এতো সাহস, স্বপ্ন ও প্রেরণা যে একটি জাতিকে তিনি চিরকালের পরাধীনতা থেকে মুক্ত করলেন!

বঙ্গবন্ধুর এ-মানসলোক বোঝার জন্য আমরা আশ্রয় নিতে পারি বেহুলা-লখিন্দর মিথের। চাঁদ সওদাগরের পুত্র লখিন্দরকে সাপে কাটে। এমন বিষাক্ত সাপ যে সর্পদেবী মনসা ছাড়া আর কেউ তাকে ভালো করতে পারবে না। মৃত স্বামীকে নিয়ে বেহুলা যাত্রা করল ইন্দ্রপুরীতে। দেবতাদের মন তুষ্ট করে স্বামীর জীবন ফিরিয়ে আনবে। সবাই তাকে নিষেধ করে, এ বড় দুর্গম পথ, ভয়ানক বিপদসংকুল পথ, অসম্ভব এক যাত্রা, এ পথে যেও না, নিবৃত হও। কিন্তু, বেহুলা কারো কথায় কর্ণপাত করল না। জীবন-মরণের এক যুদ্ধে নিয়োজিত হয়ে যাত্রা করে দেবপুরীতে। গাঙুরের জলে ভেলা ভাসিয়ে দেয়। কবি জীবনানন্দ দাশ তাঁর ‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি’ কবিতায় বলছেন:
‘দেখেছিলো; বেহুলাও একদিন গাঙুড়ের জলে ভেলা নিয়ে-
কৃষ্ণা দ্বাদশীর জ্যোৎস্না যখন মরিয়া গেছে নদীর চড়ায়-
সোনালি ধানের পাশে অসংখ্য অশ্বত্থ বট দেখেছিল, হায়,
শ্যামার নরম গান শুনেছিলো- একদিন অমরায় গিয়ে
ছিন্ন খঞ্জনার মতো যখন সে নেচেছিল ইন্দ্রের সভায়
বাংলার নদী মাঠ ভাঁটফুল ঘুঙুরের মতো তার কেঁদেছিলো পায়।’

জীবনানন্দ দাশ কল্পনা করছেন বেহুলা তো বাংলার এক অবলা, সহজ-সরল নারী, সে কোত্থেকে এতো সাহস পেল মৃত স্বামীকে নিয়ে গাঙুরের জলে ভেলা ভাসিয়ে দেবার? জীবন-মরণ যুদ্ধ করে সে যে ইন্দ্রপুরীতে গেল এবং নেচে-গেয়ে তুষ্ট করল দেবতাদের এতো প্রেরণা সে কোত্থেকে পেল!

কবি কল্পনা করছেন বাংলার মাঠ-ঘাটই তো তাঁকে সাহস যুগিয়েছে। মৃত স্বামীকে ভেলায় করে নিয়ে যেতে যেতে সে শ্যামার নরম গান শুনেছে, সোনালী ধানের পাশে অসংখ্য অশ্বত্থ বট দেখেছে, নদীর চড়ায় কৃষ্ণা দ্বাদশীর জ্যোৎস্না মরে যেতে দেখেছে, যখন সে ইন্দ্রেয় সভায় নেচেছে বাংলার সমস্ত প্রকৃতি তার পায়ে ঘুঙুর হয়ে বেজেছে।

শেখ মুজিব সেই ১৯৪১ সাল থেকে সারা বাংলা ঘুরে বেড়ান। এক ভাষণে বলেছেন: ‘আমি গ্রামে গ্রামে ঘুরেছি, নৌকায় ঘুরেছি, সাইকেলে ঘুরেছি, পায়ে হেঁটে বেড়িয়েছি, আমি বাংলাদেশের প্রত্যেকটি সমস্যার সঙ্গে জড়িত আছি, আমি সব খবর রাখি।’[৪]
১৯৪১ সালে বঙ্গবন্ধু মেট্রিক পরীক্ষা দেন। তখন থেকেই ভীষণভাবে রাজনীতি শুরু করেছেন। সভা করেন, বক্তৃতা করেন, খেলার দিকে আর নজর নাই। শুধু মুসলিম লীগ। আর ছাত্রলীগ। পাকিস্তান আনতেই হবে। নতুবা মুসলমানদের বাঁচার উপায় নাই। [৫]
তারপর থেকে ঘুরে বেড়িয়েছেন সারা বাংলায়। এই যে তিনি ঘুরে বেড়াচ্ছেন, কী দেখছেন? দেখছেন বাংলার অপরূপ প্রকৃতি। এর আগে তাঁর ছেলেবেলাটি তো গ্রামেই কেটেছে। কীরকম ছিল তাঁর ছেলেবেলা? ‘আমার আব্বার শৈশব কেটেছিল টুঙ্গিপাড়ার নদীর পানিতে ঝাঁপ দিয়ে, মেঠো পথের ধুলোবালি মেখে। বর্ষার কাদাপানিতে ভিজে। বাবুই পাখি বাসা কেমন করে গড়ে তোলে, মাছরাঙা কিভাবে ডুব দিয়ে মাছ ধরে, কোথায় দোয়েল পাখির বাসা, দোয়েল পাখির সুমধুর সুর আমার আব্বাকে দারুণভাবে আকৃষ্ট করত।’ [৬]

বেহুলার মতো বঙ্গবন্ধুরও সহায় বাংলার নদী মাঠ ভাঁটফুল। একবার চিফ হুইপ ফজলুর রহমান সাহেবের নির্দেশে রংপুর এসেছিলেন এক খান বাহাদুরকে নিয়ে যেতে। তখন তিনি কলকাতা থাকতেন, ইসলামিয়া কলেজে পড়তেন। রাত দুপুরে রংপুর পৌঁছান। রাস্তাঘাটও চেনেন না। এক রিকশাওয়ালার সহযোগিতায় দুপুর রাতে খান বাহাদুরের বাড়ি পৌঁছালেন। খান বাহাদুর তার সাথে ভোরের ট্রেনে যেতে রাজি হলেন না, পরদিন যাবেন বললেন। বঙ্গবন্ধু বললেন, তিনি ভোর পাঁচটার ট্রেনেই ফিরে যাবেন। রাতটুকু কোনোরকমে কাটালেন। খান বাহাদুর তাকে কিছু খেতেও বললেন না। ভোরের ট্রেনেই তিনি কলকাতা রওয়ানা হন। ভাত খান পরদিন দুপুরে কলকাতা ফিরে। রাস্তায় চা-বিস্কিট খেয়েছিলেন শুধু। [৭]

এই যে তিনি খেয়ে না সারা বাংলা ঘুরে বেড়াচ্ছেন, এতো প্রেরণা পাচ্ছেন কোথায়? প্রেরণা তাঁর বাংলার মানুষ। ১৯৪৩ সালে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের সময় তিনি মানবতার সেবায় ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। শহীদ সোহরওয়ার্দীর নির্দেশে লঙ্গরখানা খুলেছিলেন। ত্রাণ সংগ্রহের জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তারও আগে, সেই স্কুলে পড়ার সময় স্কুলশিক্ষক আবদুল হামিদের নির্দেশে গরিব ছাত্রদের জন্য মুষ্টি ভিক্ষার চাল সংগ্রহ করতেন। 

বাংলার অপরূপ প্রকৃতি দেখার সাথে সাথে বঙ্গবন্ধু সেই ছোটবেলা থেকে দেখেছেন বাংলার মানুষের অভাব-অনটন-দুঃখ-দুর্দশা। এসবই তাঁকে সাহস যুগিয়েছে, প্রেরণা যুগিয়েছে। বেহুলা যেমন মৃত স্বামীকে ফিরিয়ে এনেছেন ইন্দ্রপুরী থেকে, বঙ্গবন্ধুও তেমন মৃতপ্রায় একটি দেশকে পুনর্জীবন দিয়েছেন তাঁর অপরিসীম সংকল্পে, ভালোবাসায়। দেশ স্বাধীন হবার পরও তিনি সারা বাংলায় ঘুরে বেড়িয়েছেন। অসহায় মানুষদের সাহস দিয়েছেন। তাঁর প্রতিটি বক্তৃতা যেন জীবনানন্দ দাশের রূপসী বাংলার কবিতা। কবির মতোই যেন তিনি বলছেন: বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই আমি পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে যাই না আর…।

টিকা: 
১. শেখ মুজিব বাংলাদেশের আরেক নাম, আতিউর রহমান, ভূমিকা, হায়াৎ মামুদ
২. অসমাপ্ত আত্মজীবনী, শেখ মুজিবুর রহমান, পৃষ্ঠা-১১
৩. দুই বাঙালীর লাহোর যাত্রা, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, পৃষ্ঠা-১৩
৪. বাংলা আমার আমি বাংলার, বঙ্গবন্ধুর উক্তি সংকলন, সম্পাদনা -শেখ হাসিনা ও বেবী মওদুদ
৫. অসমাপ্ত আত্মজীবনী, শেখ মুজিবুর রহমান, পৃষ্ঠা-১৫
৬. শেখ মুজিব আমার পিতা, শেখ হাসিনা, পৃষ্ঠা-২৬
৭. অসমাপ্ত আত্মজীবনী, শেখ মুজিবুর রহমান পৃষ্ঠা-৩৫

ঢাকা/তারা

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ