ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

পরীমনি: মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ

স্বরলিপি || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৫:৩৫, ২৮ অক্টোবর ২০২১   আপডেট: ০০:১০, ২৯ অক্টোবর ২০২১
পরীমনি: মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ

পরীমনি

পরীমনি পুরুষতান্ত্রিক সমাজে একজন ‘নারীর’ জীবন যাপন করেন। অর্থাৎ সামাজিক বিচারে তাকে ‘গৌণ’ হিসেবে বিবেচনা করা হবে। কোনোমতে তাকে ‘মূখ্য’ বিবেচনা করা হবে না। ‘সামাজ’ তাকে কেন্দ্র হিসেবে বিবেচনা করতে মনস্তাত্বিক এবং ঐতিহ্যগতভাবে প্রস্তুত নয়।

পরীমনি একাধারে রমণী এবং তিনি ‘নায়িকা’। রমণী শব্দটির উৎপত্তি ‘রমণ’ থেকে, যার অর্থ সম্ভোগ, আমোদ- প্রমোদ, রতিক্রিয়া। অর্থাৎ রমণী শব্দটির মানে দাঁড়ায়, রমণ করার বস্তু। (সমাজ তাকে যে অর্থে বিদ্রূপ করছে)।
নায়িকা অর্থে তিনি নায়কের স্ত্রী লিঙ্গ। ভগবতীর অষ্টশক্তি দিয়েও নায়িকা শব্দটি মূল্যায়ন করা হয়। যেমন উগ্রচণ্ডা, প্রচণ্ডা, চণ্ডোগ্রা, চণ্ডনায়িকা, অতিচণ্ডা, চামুণ্ডা, চণ্ডা ও চণ্ডাবতী। সে অর্থে একজন নায়িকার ভয়ঙ্করী রূপ থাকার কথা।

পরীমনি শিল্পী। যিনি শিল্পকে নিজের মধ্যে ধারণ করবেন, বহন করবেন এবং শিল্পভোক্তার কাছে পৌঁছে দেবেন। শিল্পীজীবন ব্যক্তিজীবনকে গুম করে দেয়। শিল্পী জীবনে ভান অন্যায্য। পরীমনি যা- সে তা গোপন করে না। কিন্তু সমাজে ভান অপরিহার্য। পরীমনি চূড়ান্ত পর্যায়ের একজন বোকাও বটে! সেজন্য তার গায়ে আপনাদের ছিটিয়ে দেওয়া থু থু লেগে আছে। কিন্তু সে থু থু মুছতে নারাজ।

ব্যক্তি পরীমনি আসলে কে? সে হয়তো নিজেও নিজেকে মাঝেমধ্যে খুঁজে পায় না। পরীমনিকে যখন এতিমখানার শিশুদের সঙ্গে সময় কাটাতে দেখা যায়, তার মুখ, মুখের ছবি আর আচরণের মায়া- সব মিলিয়ে কবি ওমর আলীর কবিতার ঠিকঠাক সংমিশ্রণ যেন!
‘এ দেশে শ্যামল রঙ রমণীর সুনাম শুনেছি
আইভি লতার মতো সে নাকি সরল, হাসি মাখা
সে নাকি স্নানের পরে ভিজে চুল শুকায় রোদ্দুরে
রূপ তার এ দেশের মাটি দিয়ে যেন পটে আঁকা।’

অন্য পরীমনিকে যখন আমরা লাল আলোয় আবিষ্কার করি তাকে অল্প আলোয় অনেকে গুলিয়ে ফেলে। পরীমনিকে খুবলে খায় অসংখ্য চোখ, নিজেদের নাম নিয়ে হাজির হয়ে যায় পরীমনির ফ্যান পেজে।

চোখের খাদ্য হিসেবে পরীমনিকে অনেকে গ্রহণ করেন। গ্রহণ করা শেষে জনসম্মুখে তার দিকে শুধু আক্ষরিক অর্থে থু থু ছিটিয়ে চলে আসেন। এতে পরীমনি নিশ্চয় ব্যথিত হন। নিজেকে হারিয়ে ফেলে তারপর আবার নিজেকে ফিরে পেতে চান। হ্যাঁ, ফিরে পেতে চান বলে তাকে খুঁজে পাওয়া যায় এতিমখানায়। এতিম শিশুদের হাতের খাবার অনায়াশে খেয়ে নেন তিনি।

সমাজের চিত্র বলতে গেলে বলতে হবে- যারা হাত দিয়ে ছুঁতে পারেন না পরীমনিকে, তারা চোখ দিয়ে ছুঁয়ে দেখেন। আসলে খুবলে দেন। পরীমনির শরীরে অদৃশ্য ক্ষত তৈরি হয়। একজন রক্তাক্ত পরীমনি আর লাল আলো মিলে মিশে একাকার হয়ে যায়।

পুনরাবৃত্তি হয় সময়ের। ঘটনার পরম্পরা হিসেবে হলিউড অভিনেত্রী মনরোর অস্থির ব্যক্তিগত জীবন নিয়েও আলোচনা করা যেতে পারে। তিনি আসক্তি, হতাশা এবং উদ্বেগের সঙ্গে জীবন যাপন করেছিলেন। বিবাহের গুঞ্জনের জন্য আলোচিত ছিলেন। এবং পরপর দুবার বিবাহ বিচ্ছেদের কারণে সমালোচিতও হয়েছিলেন।

১৯৬২ সালের ৪ আগস্ট, লস অ্যাঞ্জেলেসে তার বাড়িতে বার্বিটুয়েট্রেট অতিরিক্ত সেবনের কারণে মাত্র ৩৬ বছর বয়সে মারা যান মনরো। প্রাথমিকভাবে তার মৃত্যুর সম্ভাব্য কারণ আত্মহত্যা হিসেবে রায় দেওয়া হয়েছিল, যদিও মনরোর মৃত্যুপরবর্তী দশকগুলিতে অনেকবার খবরে এসেছে- মনরো আত্মহত্যা করেননি, তাকে হত্যা করা হয়েছে।
মনে পড়ে যেতে পারে বিজয়লক্ষ্মী ভদলাপতি যিনি ‘সিল্ক’ চরিত্রে অভিনয়ের জন্য আলোচিত হয়ে আছেন তার কথা। দক্ষিণ ভারতীয় ছবির এ অভিনেত্রী নিজের গণ্ডি ছাড়িয়ে ১৯৮০-এর দশকে সর্বাধিক কাঙ্ক্ষিত আবেদনময়ী অভিনেত্রী হয়ে ওঠেন। এক অস্থির জীবন যাপন করেছিলেন এ নায়িকা। এক সময় তার মৃতদেহ আবিষ্কার হয়েছিল চেন্নাইয়ের অ্যাপার্টমেন্ট থেকে।

বিজয়লক্ষ্মী ভদলাপতি চরিত্রটি চলচ্চিত্রে ফুটিয়ে তুলেছিলেন ভারতীয় অভিনেত্রী ‘বিদ্যা বালান’।  সিনেমার শেষে দর্শকের সামনে যে প্রশ্নটি আব্রাহামের বর্ণনার মধ্য দিয়ে উঠে এসেছিল তা হলো: সিল্ক যে জীবন চালিত করে এসেছেন তা ঠিক ছিল নাকি ভুল?
উত্তর দেবেন দর্শক।

আমরা অনেক হত্যার খবর জেনে না-জেনে ‘আত্মহত্যার’ খবর হিসেবে গ্রহণ করি। অনেক সামাজিক অসঙ্গতি, সামাজিক চাপের বিষয় আমাদের কাছে পৌঁছাতে পৌঁছাতে শুধু ‘ব্যক্তির অস্থিরতা’ হিসেবে পৌঁছায়।

পরীমনি যদি শিল্পী হয়, সে আপনার শিল্পের ধারক এবং বাহক। সে হিসেবে সমালোচনা করবেন এটা স্বাভাবিক। আপনাদের সমালোচনার ধরন দেখে মনে হয়, কিছু নির্লজ্জ মানুষ নিজেরা নিজেদের পোশাক পরতে ভুলে গেছে।

পরীমনি অধিক মানসম্মত চলচ্চিত্রে অভিনয়ের সুযোগ পেয়েছেন ক্যারিয়ারের বেশ কয়েক বছর পার করে। তার হাতে এখন অনেক ভালো ভালো কাজ। তিনি সুস্থির হয়ে কাজ করবেন এমনটাই প্রত্যাশা।  

মনরো কিংবা সিল্ক-এর জীবন পরিণতির পুনরাবৃত্তি না ঘটুক।

লেখক: কবি

ঢাকা/তারা

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়