ঢাকা     রোববার   ০৫ মে ২০২৪ ||  বৈশাখ ২২ ১৪৩১

চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির গঠনতন্ত্রে পরিবর্তন প্রয়োজন 

চিন্ময় মুৎসুদ্দী || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:৫০, ৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২  
চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির গঠনতন্ত্রে পরিবর্তন প্রয়োজন 

চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির নির্বাচন পরবর্তী অবস্থা ক্রমাগত নতুন মোড় নিচ্ছে। চিত্রনায়ক জায়েদ খানের প্রার্থিতা বাতিল করে চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির নির্বাচনে আপিল বোর্ডের দেওয়া সিদ্ধান্ত স্থগিত করেছেন হাইকোর্ট। এর আগে আপিল বোর্ডের প্রার্থিতা বাতিলের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে আবেদন করেন জায়েদ খান।

গত ৫ ফেব্রুয়ারি জায়েদ খানের প্রার্থিতা বাতিল করে নিপুণকে শিল্পী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ঘোষণা করে আপিল বোর্ড। আপিল বোর্ডের চেয়ারম্যান সোহানুর রহমান সোহান এই সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। এরপরই নিপুণ সাধারণ সম্পাদক পদে শপথ নেন। কিন্তু আজ হাইকোর্টের দেওয়া রায়ে জায়েদ খানের এই পদে কাজ করার আর কোনো বাধা রইলো না। 

শিল্পী সমিতির নির্বাচন শেষে বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করার দশ দিনের মধ্যে এই ঘটনা চলচ্চিত্র মহলে নতুন আলোড়ন তুলেছে। এর আগে ২৮ জানুয়ারি ভোরে নির্বাচনের ফল ঘোষণা করেন নির্বাচন কমিশনের চেয়ারম্যান পীরজাদা শহীদুল হারুন। সেই ফলে সভাপতি নির্বাচিত হন ইলিয়াস কাঞ্চন, অন্য প্যানেল থেকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন জায়েদ খান। এরপরই শুরু হয় পাল্টাপাল্টি অভিযোগের পালা। ইলিয়াস কাঞ্চনের প্যানেল থেকে সাধারণ সম্পাদক পদপ্রার্থী নিপুণ আক্তার নির্বাচনের আচরণ বিধি লঙ্ঘন করা হয়েছে জানিয়ে বিশেষ করে নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক জায়েদ-এর বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন আপিল বোর্ডে। তার একটি অভিযোগ হলো- জায়েদ খান টাকা দিয়ে ভোটার কিনেছেন। নিপুণের এই অভিযোগ অবশ্য অস্বীকার করেছেন জায়েদ খান। অন্য অভিযোগটিও গুরুতর। নিপুণের দাবি, ২৮ জানুয়ারি সকালে ভোটের মাঠে তাঁর পরিষদের দুই নারী প্রার্থীর সামনে প্রধান নির্বাচন কমিশনার পীরজাদা শহীদুল হারুন তাঁর কাছে চুমুর আবদার করেন।

আমাদের সামাজিক অনুশাসনে এ ধরনের আচরণ অশালীন এবং নারীর শ্লীলতাহানির চেষ্টা বলে গণ্য করা যায়। নির্বাচন কমিশনার হিসেবে শহীদুল হারুন কোনো প্রার্থীর সঙ্গে ‘মশকরা’ও করতে পারেন না। এটা নির্বাচনি আচরণ বিধির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।

অন্যদিকে চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্ট ১৮ সংগঠন শিল্পী সমিতির নির্বাচনে এফডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক নুজহাত ইয়াসমীন এবং প্রধান নির্বাচন কমিশনার পীরজাদা শহীদুল হারুনের বিরুদ্ধে পক্ষপাতের অভিযোগ করেন। তাদেরই কারণে নির্বাচনের দিন প্রযোজক, পরিচালকসহ চলচ্চিত্রের ১৭ সংগঠনের কেউ এফডিসির ভেতরে ঢুকতে পারেননি। বিষয়টি অপমানজনক দাবি করে এফডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদত্যাগ ও শিল্পী সমিতির প্রধান নির্বাচন কমিশনার পীরজাদা হারুনকে আজীবন অবাঞ্ছিত ঘোষণাসহ কয়েকটি দাবি জানিয়ে এসব সংগঠনের উদ্যোগে এফডিসিতে বিক্ষোভ হয়েছে। সব মিলিয়ে একটি অস্বাভাবিক ও অস্বস্তিকর পরিবেশ বিরাজ করছে অভিনয়শিল্পীদের মাঝে। 

চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতি গঠিত হয়েছিল প্রধানত চলচ্চিত্রাভিনয়ে যুক্ত সকলের পেশাগত সমস্যা নিরসনের লক্ষ্যে। কিন্তু শুরু থেকেই সমিতি সেদিকে বিশেষ নজর দিতে পারেনি। বলা যায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে সমিতির ভূমিকা ছিল বিচারালয়ের মতো। আর নির্বাচিতদের অনেকেই বিচারকের মতো সদস্যদের শাস্তি ঘোষণা করতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ বোধ করেছেন।

পুরনো দিনে ফিরে গেলে দেখা যায় বিভিন্ন সদস্যকে জরিমানা করা হয়েছে, বয়কট করা হয়েছে। কারো কোনো পেশাগত সংকট নিরসনে তেমন ভূমিকা রাখতে পারেনি সমিতির নির্বাচিতরা। তখনও নানাভাবে অভিযোগ, পাল্টা অভিযোগ শোনা গেছে। তবে পেশাজীবনের কোনো বিষয় নিয়ে নয়, এবারের সংকট মনে হচ্ছে একেবারেই ব্যক্তিকেন্দ্রিক। 

এসব ঘটনায় সিনিয়র অভিনয়শিল্পীরা মর্মাহত। এ বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে চিত্রনায়ক ও প্রযোজক আলমগীর গণমাধ্যমে বলেছেন, ‘শিল্পীদের কার ছবির সংখ্যা কত বেশি, কে কত বেশি কাজ পাব, সেদিকে নজর না দিয়ে আমরা অন্যদিকে বেশি নজর দিচ্ছি।’

সমিতির দুবারের সভাপতি শাকিব খানও প্রায় একই সুরে বলেছেন, ‘সমিতি দিয়ে চলচ্চিত্র শিল্প টিকে থাকবে না। শিল্পীকে বাঁচতে হলে কিংবা চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রিকে টিকিয়ে রাখতে হলে ছবির কাজ নিয়ে ভাবতে হবে। মানসম্মত কাজ দিয়ে দর্শকের মন জয় করতে হবে।’ নির্মাতা কাজী হায়াৎ উষ্মা প্রকাশ করে অনেক আগেই বলেছেন, ‘চলচ্চিত্রে সমিতি কী জন্য, বিশেষ করে শিল্পী সমিতির কাজ কী, শিল্পী হিসেবে আমি আজও সেটা বুঝিনি। কেউ মরলে খাটিয়া ধরতে হবে, কেউ অসুস্থ হলে হাসপাতালে যেতে হবে, এ জন্য তো অনেকেই আছেন। পরীমনি আটক হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যদি সমিতি তার সদস্যপদ কেড়ে নেয়, সেই সমিতি শিল্পীদের জন্য কতটা কার্যকর, সেটাই আমার প্রশ্ন।’

জ্যেষ্ঠ অভিনয়শিল্পী ও পরিচালক সুচন্দা মনে করেন এখন সিনেমার কাজ কমে গেছে বলেই শিল্পীরা সমিতি নিয়ে মেতে  থাকেন। এখানে কেন দলাদলি, দ্বন্দ্ব, সংঘাত, কাদা ছোঁড়াছুড়ির ঘটনা ঘটবে? দেশের গুরুত্বপূর্ণ এই মাধ্যমের প্রতি মানুষের আস্থা ও শ্রদ্ধা ফিরিয়ে আনার সময় এখনো আছে বলে তিনি মনে করেন। তবে সবচেয়ে সহজ অথচ নির্মম প্রশ্নটি করেছেন সিনিয়র অভিনেত্রী ববিতা। তার মতে, ‘চলচ্চিত্রের উন্নয়নে যে এফডিসি, সেখানে নেই চলচ্চিত্রের কাজ। এফডিসিতে এত সমিতি, তাতে লাভ কী? চলচ্চিত্রই যদি না থাকে, এত সমিতি দিয়ে কী হবে?’

রাজ্জাক, আলমগীর, ইলিয়াস কাঞ্চন, মাহমুদ কলি, রুবেল, মান্না, শাকিব খানসহ অনেকেই শিল্পী সমিতির নেতৃত্বে ছিলেন। দর্শক সে ব্যাপারে তেমন আগ্রহী নন। তারা চান তাদের প্রিয় মানুষেরা সুন্দর চলচ্চিত্রের মাধ্যমে তাদের সামনে আসুক। অবশ্য সমিতিবদ্ধ হয়ে সবার জন্য কিছু করার মানসিকতা প্রশংসনীয়। কিন্তু বিশ্বব্যাপী চলচ্চিত্রাঙ্গণে এটা তেমন সফল হয়নি। অনেক দেশে এ ধরনের সংগঠন ‘বার্গেইনিং এজেন্ট’ হিসেবেই কাজ করে অনেকটা ট্রেড ইউনিয়নের আদলে। কোনো দেশে অভিনয়-শিল্পীদের সংগঠন ট্রেড ইউনিয়ন হিসেবেই নিবন্ধিত আছে। আমাদের চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতি সেদিকে কোনো নজর দেয়নি এ পর্যন্ত। 

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই সমিতি প্রয়াত শিল্পীদের স্মরণে অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে, একাধিক স্টেজ শো করেছে। স্টেজ শোগুলো থেকে ‘গেইট মানি’ হিসেবে প্রাপ্ত অর্থ এবং পারফরমারদের জন্য ব্যয় করা অর্থের কোনো হিসাব নেই বলে অভিযোগ করেছেন অনেক সদস্য। সাধারণ সভায় এ নিয়ে কোনো আলোচনা হয়েছে কিনা তা স্পষ্ট নয় কোনো পক্ষের কথাবার্তায়। 

আমাদের সিনিয়র শিল্পীদের কেউ কেউ নানাভাবে সংকটে পড়েন। সমিতি তাদের জন্য তেমন কিছু করেন না। এক সময়ের ‘নায়িকা’ কবিতা শেষ জীবনে বস্তিতে অন্যের আশ্রয়ে দিনযাপন করেন এবং সেখানেই মারা যান। আরেক ‘নায়িকা’ জবা তার শেষ জীবনে নিদারুণ অর্থ কষ্টে ছিলেন। দুজনই ব্যক্তিজীবনে ধনবান ব্যক্তির স্ত্রী ছিলেন। কেউ তাদের সাহায্যে হাত বাড়াননি।  

আসলে চলচ্চিত্র শিল্পের সামগ্রিক অবস্থা এখন সন্তোষজনক নয়। এফডিসি-সংশ্লিষ্ট চলচ্চিত্র নির্মাণের সংখ্যা কমেছে। বিনিয়াগকারীরা আগ্রহী হচ্ছেন না লগ্নি করতে। ইলিয়াস কাঞ্চন তাই করপোরেট প্রতিষ্ঠানের কাছে অনেকটা আহ্বানের মতো করে বলেছেন ১৭ বা ১৮ কোটি টাকা বিবিয়োগ করপোরেটদের কাছে খুব বেশি নয়। এই শিল্পের সাথে যুক্ত অনেকেই এখন কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। অভিনয় শিল্পীদের অনেকেরই নিয়মিত কাজ নেই। এরকম অবস্থায় চলচ্চিত্র শিল্প সমিতির নির্বাচন নিয়ে যে অপ্রীতিকর অবস্থা ও অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি হয়েছে এফডিসিতে তাতে ‘করপোরেট মালিকরা’ সিনেমায় লগ্নি করতে আরো পিছিয়ে যাবেন। জেনেশুনে তারা ঝামেলার মধ্যে জড়াতে চাইবেন না।

চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির নির্বাচন ও নির্বাচনোত্তর কার্যক্রম আমাদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে জাতীয় রাজনীতির একটা অশুভ ছায়ায় যেন দেশের বিভিন্ন সংগঠন প্রভাবিত হচ্ছে। বিশেষ করে দীর্ঘদিন পদ আঁকড়ে থাকার একটা প্রবণতা রয়েছে সবার। আমাদের বড়-ছোট প্রায় সব রাজনৈতিক দলে প্রধান ব্যক্তি বছরের পর বছর দলের প্রধান থাকেন। প্রকৃত অর্থে সেখানে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয় না। বিভিন্ন সমিতিতেও একই অবস্থা দেখা যায়। একই পদে বারবার ফিরে আসতে চান অনেকে। চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির গঠনতন্ত্রের কিছু ধারায় পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। বিশেষ করে একই পদে পরপর দুবারের বেশি প্রার্থী হওয়া যাবে না এমন বিধান থাকা প্রয়োজন। তৃতীয়বার কেউ একই পদে প্রার্থী হতে চাইলে একটি টার্ম বাদ দিয়ে প্রার্থী হওয়ার বিধান থাকলে সুযোগ সন্ধানীদের কিছুটা হলেও নিবৃত করা যাবে। 
 

/তারা/ 

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়