ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

গর্বের শহিদ মিনার: একক আন্দোলনের সবচেয়ে বেশি স্মারক স্মৃতিস্তম্ভ 

এস এম জাহিদ হাসান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:৫১, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২২   আপডেট: ১৫:৫৩, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২২
গর্বের শহিদ মিনার: একক আন্দোলনের সবচেয়ে বেশি স্মারক স্মৃতিস্তম্ভ 

সাত দশক পেরিয়ে একটি আন্দোলন। এমন আন্দোলন বিশ্বে বিরল। মায়ের ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার সেই আন্দোলনে অবলীলায় রাজপথে রক্ত ঢেলে দিয়েছিল এ দেশের দামাল ছেলেরা। তাঁদের সেদিনের আত্মত্যাগ একটি অসাম্প্রদায়িক, বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার সর্বব্যাপী আন্দোলনে রূপ নেয়। রোপিত হয় স্বাধীনতার বীজ। সেদিনের পথ পেরিয়েই আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম এবং স্বাধীনতা।

আমাদের মায়ের ভাষা মর্যাদা নিয়ে আজও টিকে আছে। দল মত ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে কোনো বিতর্ক ছাড়াই ৭০ বছর ধরে ২১ শে ফেব্রুয়ারি উদযাপিত হচ্ছে। দেশের কত জায়গায় কত যে শহিদ মিনার রয়েছে তার সঠিক সংখ্যা আমার জানা নেই। তবে এ কথা অনুমান করে নেওয়া যায় এমন একটি ঘটনার, একক আন্দোলনের এতো বিপুলসংখ্যক স্মারক স্মৃতিস্তম্ভ বিশ্বে আর নেই। ফলে এটি ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস অব গিনেজ বুকে আলাদা করে উঠতে পারে।

ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকালে আমরা দেখি, ১৯৫২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির বৈঠকে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত না হলেও ২১ ফেব্রুয়ারি নির্ধারিত কর্মসূচি অনুযায়ী সকাল থেকেই বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে ছাত্রছাত্রীরা জমায়েত হতে শুরু করে। গাজীউল হকের সভাপতিত্বে সকাল ১১ টার দিকে আমতলায় ছাত্রসভা শুরু হয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ ছাত্রের মত অনুসারে ১৪৪ ধারা ভঙের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ছাত্ররা ১০ জনের একটি দলে বিভক্ত হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর থেকে বের হতে থাকলে পুলিশ হামলা করে। পুলিশের গুলিতে আবুল বরকত, রফিকউদ্দীন, আব্দুল জব্বার নিহত হন। সন্ধ্যার আগেই শোকের কালো ছায়া নেমে আসে শহরে।

পরদিন অর্থাৎ ২২ ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনের মিছিলে পুলিশ পুনরায় গুলি চালালে সফিকুর রহমান, রিক্সাচালক আবদুল আউয়াল, কিশোর অহিউল্লাহসহ অজ্ঞাতসংখ্যাক লোক নিহত হন।

এরপর ২৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মেডিকেল কলেজ প্রাঙ্গণে ভাষা শহীদদের স্মরণে ছাত্রনেতা গোলাম মওলা ও তাঁর সহযোগীদের উদ্যোগে শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়। যদিও ভাষা আন্দোলনের শহিদদের স্মৃতি রক্ষার্থে বায়ান্নর ২১ ফেব্রুয়ারি রাতেই রাজশাহী কলেজের মুসলিম হলের পাশে দেশের প্রথম শহিদ মিনার নির্মিত হয়েছিল। এর দুদিন পর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হোস্টেলের ছাত্ররা ১২ নম্বর ব্যারাকের মাঝামাঝি জায়গায় শহিদদের রক্তভেজা মাটিতে এই মিনার নির্মাণ করেন। সাড়ে দশ ফুট উঁচু মিনারটির নাম রাখা হয় শহিদ স্মৃতিস্তম্ভ। নকশা করেন মেডিকেল কলেজের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র বদরুল আলম এবং সাঈদ হায়দার।

১৯৫২ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি গভীর রাতে দ্রুত নির্মাণের পর শহিদ শফিউর রহমানের পিতা মিনারটি উদ্বোধন করেন। পরবর্তীকালে ২৬ ফেব্রুয়ারি ‘দৈনিক আজাদ’ পত্রিকার সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দিন আনুষ্ঠানিকভাবে শহিদ মিনারটি উদ্বোধন করেন। কিন্তু ওইদিন বিকেলেই পুলিশ এসে মিনারটি ভেঙে দেয়। 
১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের জয় লাভের পর প্রথম সরকারিভাবে ২১ ফেব্রুয়ারিকে শহিদ দিবস ঘোষণা করা হয় এবং নতুন করে শহিদ মিনার নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। স্থায়ী শহিদ মিনার গড়ার উদ্দেশ্যে ঢাকা মেডিকেল হোস্টেলের সামনে ১৯৫৬ সালে ২১ ফেব্রুয়ারি সকালে শহিদ বরকতের মা হাসিনা বেগম, মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী এবং তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী আবু হোসেন সরকার যৌথভাবে শহিদ মিনারের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন। শিল্পী হামিদুর রাহমানের তত্ত্বাবধানে ১৯৫৭ সালের নভেম্বরে শহিদ মিনারের নির্মাণ কাজ শুরু হয়। কিন্তু ১৯৫৮ সালের মার্চ মাসে কাজ বন্ধ হয়ে যায়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৩ সালে পুনরায় শহিদ মিনারটি বর্তমান নকশা অনুযায়ী তৈরি করা হয়। ভাষা শহিদ বরকতের মা হাসিনা বেগম কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার উদ্বোধন করেন।

ভাষা আন্দোলনের এই প্রতীক আজ দেশের অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সরকারি অনেক প্রতিষ্ঠান প্রাঙ্গণে, জেলা শহরে, এমনকি পাড়া-মহল্লাতেও স্বমহিমায় দাঁড়িয়ে আছে। প্রতিনিয়ত স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে ভাষাশহিদদের আত্মত্যাগের কথা। বিশেষ করে একুশে ফেব্রুয়ারি এলে অনেক জায়গায় অস্থায়ী শহিদ মিনারও তৈরি করা হয়। এ জন্য যার যতটুকু সাধ্য, সে অনুযায়ী আনুষাঙ্গিক জিনিস ব্যবহার করে। এতে কোনো গ্লানি নেই, আছে ভালোবাসা, শ্রদ্ধা। এবং সেই শ্রদ্ধা প্রকাশে মিনারের বেদিতে রাখা হয় ফুল। ফুলে ফুলে ভরে ওঠে আমাদের ভাই হারানো শোক ও একইসঙ্গে গর্বের এই প্রতীক। 

একুশে ফেব্রুয়ারি আজ আন্তর্জাতিকভাবে পালিত হচ্ছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দিনটি পালিত হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যারা প্রবাসী বাংলাদেশি আছেন তারাও সেখানে শহিদ মিনার নির্মাণ করে শ্রদ্ধাভরে দিনটি স্মরণ করছেন। সে কারণেই আমাদের ভাষা আন্দোলনের প্রতীক হিসেবে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক স্মারক স্মৃতিস্তম্ভ শহিদ মিনার আমাদের আরো গর্বিত করে। ভাষা সৈনিকের রক্তঋণ পরিশোধ হওয়ার নয়। শুধু শুদ্ধ প্রমিত বাংলা চর্চার মাধ্যমেই তাদের আমরা সম্মান জানাতে পারি। 

লেখক: প্রকাশক, রাইজিংবিডি ডটকম
 

/তারা/ 

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়