ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

ডা. বুলবুলের অস্বাভাবিক মৃত্যু এবং কয়েকটি প্রশ্ন

নিজামুল হক বিপুল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৮:২১, ২৯ মার্চ ২০২২  
ডা. বুলবুলের অস্বাভাবিক মৃত্যু এবং কয়েকটি প্রশ্ন

রাজধানী ঢাকা কতটা নিরাপত্তাহীন হয়ে উঠেছে এই ঘটনা তার সাক্ষ্য দিচ্ছে। মাত্র চার দিনের ব্যবধানে ঢাকায় তিনটি নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে।

যার একটির শিকার হয়েছেন দন্ত চিকিৎসক আহমেদ মাহী বুলবুল। এই মৃত্যু একেবারেই অপ্রত্যাশিত, অনাকাঙ্ক্ষিত ও অনভিপ্রেত। এই মৃত্যু কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। ‘স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি’- চাওয়া এবং পাওয়া রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকের অধিকার। কিন্তু তিনটি হত্যাকাণ্ড চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে এই শহরে সন্ত্রাসীরা এখনও সক্রিয়।

বুলবুল ছিলেন এই ব্যস্ত শহরের বহু মানুষের আপনজন। আত্মার আত্মীয়। এদের বেশিরভাগের সঙ্গেই তার রক্তের কোনো সম্পর্ক ছিল না। পেশাগত কাজে মানুষকে সেবা দিতে গিয়ে মানুষের সঙ্গে তার নিবিড় সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তার হাসিমাখা মুখে কথা বলা সবাইকে মুগ্ধ করত। রবিবার কাক ডাকা ভোরে নিজের বাসার কাছাকাছি দুর্বৃত্তদের ছুরিকাঘাতে প্রাণ হারান অল্পবয়সী এই চিকিৎসক। দুর্বৃত্তরা তাকে খুন করে বীরদর্পে পালিয়ে যায়। রাজধানীর শেওড়াপাড়ায় ঘটে যাওয়া ওই হত্যাকাণ্ড সাধারণ মানুষের নিরাপত্তার বিষয়টিকে ভাবিয়ে তুলেছে।

একজন মানবদরদি চিকিৎসকও যে শহরে নিরাপদ না, নিরাপদে ভোরের শান্ত সড়ক ধরে হাঁটতে পারেন না, প্রয়োজনীয় কাজে বাসা থেকে বের হয়ে আবার বাসায় প্রিয় স্ত্রী ও শিশু সন্তানের কাছে ফিরতে পারেন না, সেই শহরে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা কোথায়? এটি এখন কোটি টাকার প্রশ্ন?

যদিও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রাথমিকভাবে বলছে, ছিনতাইকারীদের হাতে প্রাণ গেছে চিকিৎসক বুলবুলের। পরিবার বলছে, বুলবুলকে হত্যা করা হয়েছে। এখানে কথা হচ্ছে বুলবুল ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে মারা যান কিংবা পরিকল্পিত খুনের শিকার হন না কেন- দুটোই অপরাধ। দুটোই প্রত্যক্ষ খুন। ছিনতাইকারীর শিকার বলে এমন ঘটনাকে হালকাভাবে নেওয়ার সুযোগ নেই। বুলবুল সত্যিই যদি ছিনতাইকারীর শিকার হন তাহলে বুঝতে হবে এই শহরে ছিনতাইকারীরা এখনও বহাল তবিয়তে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাদের দৌড়াত্ম্য আগের মতোই আছে। তাহলে তো এর মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ছিনতাইকারীদের নির্মূল করতে পারছে না বা তারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ধরা ছোঁয়ার বাইরে। অথবা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতায় ঘাটতি আছে।

শুধু পরিবার নয়, বুলবুলের বন্ধুবান্ধবরাও মনে করছেন এটি টার্গেট কিলিং। কিন্তু কি কারণে তিনি হত্যার শিকার হলেন সেটা পরিষ্কার নয়। এই ধারণার পেছনে কিছু কারণও রয়েছে। আমরা আশা করবো, বুলবুলের পরিবারের দাবি আমলে নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তৎপর হয়ে এই মৃত্যু রহস্য উদঘাটন করবে। এতে অন্তত তার পরিবার এবং বন্ধুবান্ধব হত্যাকাণ্ডের কারণ সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতিও সাধারণ মানুষের আস্থা তৈরি হবে।  

রাষ্ট্রের সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমিও চাই দন্ত চিকিৎসক বুলবুলের খুনীদের অবিলম্বে শনাক্ত করে বিচারের মুখোমুখি করা হোক। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হোক। আরেকটা বিষয় বলতেই হয়। বুলবুল দুর্বৃত্তদের দ্বারা আক্রান্ত হওয়ায় তাৎক্ষণিকভাবে তাকে মিরপুরের আল হেলাল হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিল। অভিযোগ উঠেছে, সেই হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা পাননি বুলবুল। প্রাথমিক চিকিৎসা পেলে হয়তো তিনি আমাদের মধ্যে বেঁচে থাকতেন।

আল হেলাল কর্তৃপক্ষ যখন বুঝতে পেরেছে যে বুলবুলের ঘটনাটি পুলিশ কেস তখন তারা তাকে প্রাথমিক চিকিৎসা না দিয়ে, ভর্তি না করে দ্রুত সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়। একজন চিকিৎসক হয়েও তিনি একটি হাসপাতালে চিকিৎসা পেলেন না। ভাবতেই মনটা বিষণ্ন হয়ে ওঠে। একজন চিকিৎসক যখন মৃত্যু পথযাত্রী তখন তিনি প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা পেলেন না হাসপাতালে! সেখানে একজন সাধারণ মানুষের অবস্থা কি হতে পারে বুঝে নেওয়া খুব কঠিন কিছু না।

এছাড়া পুলিশি ঠেলাঠেলিও ছিল। ঘটনাটি ঘটেছে শেওড়াপাড়ায়। এটি মিরপুর মডেল থানার অর্ন্তগত। তাকে উদ্ধার করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে আল হেলাল হাসপাতালে। সেটি কাফরুল থানায়। কাফরুল থানা পুলিশ বলেছে ঘটনাস্থল মিরপুর মডেল থানার। সুতরাং তাকে কাফরুল থানা এলাকায় রাখা যাবে না। তাই যত দ্রুত সম্ভব এখান থেকে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে পাঠানোই উত্তম।

এখানেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এ ধরনের আচরণ প্রশ্নের জন্ম দেয়। একজন মানুষ চিকিৎসার অভাবে মারা যাচ্ছে সেটা বিবেচনায় না নিয়ে সে কোন থানা এলাকায় আক্রান্ত হয়েছে তা নিয়ে বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল তারা। এটি আমাদের মানসিক বৈকল্য ও দৈনদশার কথা মনে করিয়ে দেয়। আরেকটি ব্যাপার উল্লেখ করতে চাই, যে স্থলে ঘটনাটি ঘটেছে সেখানকার সিসি টিভি ফুটেজ পাওয়া খুব কঠিন কিছু নয়। মৃতের ফোন কল লিস্ট ধরেও তদন্ত এগিয়ে যেতে পারে। তিনি চিকিৎসক হলেও ঠিকাদারি কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ফলে তিনি এতো সকালে কার সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছিলেন তাদেরও জিজ্ঞাসাবাদ করা যেতে পারে। মোদ্দাকথা, আমাদের প্রত্যাশা থাকবে, ‘ছিনতাইকারী কর্তৃক হত্যাকাণ্ড’ এই ভাবনার বাইরে বেরিয়ে এসে নানাদিক থেকেই যেন এই হত্যার বিশ্লেষণ করা হয়। এবং সে অনুযায়ী হয় বিচার। 

চিকিৎসক বুলবুল ও তার পরিবার সম্পর্কে দু’একটি কথা না বললেই নয়। বুলবুল ব্যক্তিগত জীবনে খুবই বন্ধুবৎসল ছিলেন। তার বন্ধুবান্ধবের সংখ্যা অগণিত। তার সুখের সংসার। সংসারে স্ত্রী আর আওন নামে সাড়ে সাত বছরের এক কন্যা ও সামী নামে ১৯ মাস বয়সী একটি ছেলে রয়েছে। পুরো পরিবার বুলবুলের আয়ের উপর নির্ভরশীল। বুলবুল দেশের প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধিতে ভূমিকা রেখেছেন। নিয়মিত আয়কর পরিশোধ করতেন। অথচ তার পরিবার এখন একটা চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে গেল। বুলবুলের এই অস্বাভাবিক চলে যাওয়ায় পরিবারটির সামনের দিনগুলো শুধুই অন্ধকার। সুতরাং তার ছেলেমেয়ের কথা চিন্তা করে এই চিকিৎসকের পরিবারকে রাষ্ট্রীয়ভাবে সহযোগিতা করা উচিত বলে মনে করি। রাষ্ট্রের কাছে বুলবুলের পরিবারের পক্ষ থেকে এই চাওয়াটা খুব বেশি কিছু নয়। 

লেখক: সাংবাদিক
 

/তারা/ 

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়