ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

মোটর সাইকেলের উপর নিষেধাজ্ঞাই কি সমাধান? 

নিজামুল হক বিপুল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:১০, ৬ জুলাই ২০২২   আপডেট: ১২:৪৬, ৭ জুলাই ২০২২
মোটর সাইকেলের উপর নিষেধাজ্ঞাই কি সমাধান? 

ঈদ সামনে রেখে ঈদের আগে-পরে সাত দিন জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কে মোটরসাইকেল চলাচল নিষিদ্ধ করেছে সরকার। এ সময় আন্তঃজেলায় অর্থাৎ এক জেলা থেকে অন্য জেলায় মোটরসাইকেল যাতায়াত করতে পারবে না, এমনকি রাইড শেয়ারিংও করা যাবে না। তার আগে দেশের মর্যাদার প্রতীক পদ্মা সেতুতেও মোটরসাইকেল চলাচলের উপর সাময়িক সময়ের জন্য নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। যা এখনও বলবৎ আছে।

কিন্তু হঠাৎ করেই কেন সরকার মোটরসাইকেল চলাচলের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলো? এ নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে রীতিমত তর্ক যুদ্ধ চলছে। যাত্রীকল্যাণ সমিতি বলছে, ঈদের আগে মহাসড়কে মোটরসাইকেলে রাইড শেয়ারিং বন্ধের সিদ্ধান্তকে পুঁজি করে ব্যক্তিগত বাইক নিয়ে চলাচলকারীদের যাত্রাপথে হয়রানী করা হলে সড়ক দুর্ঘটনার ঝুঁকি আরো বেড়ে যাবে।

একই সঙ্গে যাত্রীকল্যাণ সমিতি মোটর সাইকেলের নিবন্ধন জরুরি ভিত্তিতে বন্ধ করারও দাবি জানিয়েছে। তারা বলছে, দেশে রাইড শেয়ারিং চালু করা হলেও বাস্তবভিত্তিক নীতিমালা ও মনিটরিং-এর অভাবে এসব রাইড শেয়ারকারী যানবাহন যানজট আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। এমতাবস্থায় দেশের সড়কের তুলনায় মোটর সাইকেলের সংখ্যা বেশি হওয়ায় এই বাহনটির নিবন্ধন বন্ধ করা জরুরি হয়ে পড়েছে।

সাম্প্রতিক সময়ে দেশে সড়ক-মহাসড়কে দুর্ঘটনা বেড়েছে অস্বাভাবিকভাবে। এসব দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে মোটরসাইকেল আরোহীরা। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, জুন মাসে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৫২৪ জন। এর মধ্যে ১৯৭টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ২০৪ জন। যা মোট নিহতের ৩৮ দশমিক ৯৩ শতাংশ। এই তথ্য বলে দিচ্ছে দেশে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা কতটা বেড়েছে। আর এই মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার প্রধান কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে- বেপরোয়া গতি, অসুস্থ প্রতিযোগিতা, নিয়ম না মেনে ইচ্ছামত রাস্তার মাঝ বরাবর মোটর সাইকেল চালানো, অদক্ষ ও আনাড়ি চালকের হাতে স্টিয়ারিং, হঠাৎ করে মোটরসাইকেলে রাইড শেয়ারিং বেড়ে যাওয়া অন্যতম। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকাতে যেসব মোটরসাইকেল চালক রাইড শেয়ারিং করেন তাদের বেশিরভাগই হঠাৎ করেই ঢাকা এসেছেন দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে। শুধু পাঠাও, উবার, ওভাই-এর মতো অ্যাপসের মাধ্যমে মোটর বাইক চালিয়ে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার জন্য। শুধু রাজধানীতে নয়, সুযোগ পেলে তারা দূরপাল্লায়ও শেয়ারিং করেন।

ঈদ কিংবা অন্য কোনো উৎসবে তিন-চার দিনের লম্বা সরকারি ছুটি থাকলে রাজধানী কিংবা বড় শহরগুলোতে যাত্রী সেবায় নিয়োজিত মোটর সাইকেলগুলো শহর ছেড়ে বিভিন্ন গন্তব্যে ছুটে যায় যাত্রী নিয়ে। সর্বশেষ গত রমজানের ঈদে দেখা গেছে, রাজধানী থেকে লক্ষাধিক মোটরসাইকেল দেশের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা শহরে ছুটে গেছে। যার একটা স্পষ্ট চিত্র ফুটে উঠেছিল যমুনা সেতু, মাওয়া-শিমুলিয়া ফেরি এবং পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া ফেরিঘাটে। আর দূরপাল্লার গন্তব্যে যাওয়ার সময় বেশির ভাগ মোটরসাইকেল যাত্রী নিয়ে গিয়েছে। অনেকে এই দ্বি-চক্র যানে করে পরিবার নিয়েও ব্যাগ অ্যান্ড ব্যাগেজ ছুটে গেছেন গ্রামের পথে। ফলে দেখা গেছে, গত ঈদে ঘটে যাওয়া সড়ক দুর্ঘটনার শিকার একটা বড় অংশ হচ্ছে মোটরসাইকেল আরোহীরা। এতে অকালে বহু প্রাণহানীর ঘটনা ঘটেছে।

সাম্প্রতিক সময়ে দেশের সড়ক ও মহাসড়কে আশঙ্কাজনকহারে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি সরকারের নীতিনির্ধারকদের, বিশেষ করে সড়ক ও মহাসড়ক নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাকে ভাবিয়ে তুলেছে। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পরদিন ২৬ জুন দেশের দীর্ঘতম সেতুটি যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয়। সেতু অতিক্রম করার জন্য সেতুর দুই প্রান্তে আগের রাত থেকেই যানবাহনের দীর্ঘ লাইন পরে যায়। যেখানে মোটর সাইকেলের আধিক্য ছিল বেশি। ২৬ জুন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত পদ্মা সেতু দিয়ে যেসব যানবাহন পারাপার হয়েছে তার ৭৫ শতাংশ ছিল মোটর সাইকেল। এসব মোটরসাইকেল শুধু পারাপারই হয়নি, কেউ কেউ সেতুর উপর রেসিং করেছে। এতে সেতুর উপর দুর্ঘটনা ঘটেছে ২৬ জুন রাতে। ভয়ঙ্কর সেই দুর্ঘটনায় দুই মোটরসাইকেল আরোহীর মৃত্যু ঘটেছে। বিষয়টি সেতু কর্তৃপক্ষকে ভাবিয়ে তোলে এবং ওই রাতেই পদ্মা সেতু দিয়ে মোটর সাইকেল পারাপার অনির্দিষ্টকালের জন্য নিষিদ্ধ ঘোষণা করে সার্কুলার জারি করে কর্তৃপক্ষ।

এই নিষেধাজ্ঞার মধ্যেই ৩ জুলাই সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগে এক সভা শেষে সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এ বি এম আমিন উল্লাহ নুরী জানিয়ে দেন, আগামী ঈদ উল আযহার সময় ৭ থেকে ১৩ জুলাই পর্যন্ত এক জেলা থেকে অন্য জেলায় মোটর সাইকেল চলাচল নিষিদ্ধ থাকবে। তবে জরুরি প্রয়োজনে পুলিশের অনুমতি সাপেক্ষে মোটরসাইকেল চলতে পারবে। 

সরকারের সচিবের এই ঘোষণার পর মোটরসাইকেল আরোহীদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়েছে। তারা সরকারের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছেন। কিন্তু সরকারের নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে কথা বলে যতটুকু জানা গেছে, তার সারমর্ম হচ্ছে সড়ক দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পেতে সরকার মোটরসাইকেল চলাচলের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। বিশেষ করে ঈদের সময় জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কগুলোতে যানবাহনের প্রচণ্ড চাপ থাকে এবং দূরপাল্লার দ্রুতগতির যানবাহন চলাচল করে। এই সময় মোটরসাইকেল একটা বড় সমস্যা হয়ে দেখা দেয়। বিশেষ করে মোটর সাইকেলগুলো বড় গাড়ির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলে এবং রাস্তার মাঝ বরাবর ও বেপরোয়া গতিতে চলে। যা দুর্ঘটনার একটা প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এই বিষয়টি বিবেচনায় নিয়েই সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ ঈদের সময় মোটর সাইকেলের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে।

ঈদের আগে পরে সাতদিন মোটরসাইকেল চলাচলের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি হলেও, সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (ঢাকা-মাওয়া-ভাঙা) এক্সপ্রেসওয়েতে মোটরসাইকেল চলাচলে স্থায়ী নিষেধাজ্ঞা জারির প্রস্তাব করেছে। সম্প্রতি এই প্রস্তাবটি সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগে পাঠিয়েছে তারা। এতে বলা হয়েছে, এই এক্সপ্রেসওয়েতে মোটর সাইকেল চলাচল খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। 

শেষ করতে চাই মোটরসাইকেল সংক্রান্ত একটা পরিসংখ্যান দিয়ে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) এর তথ্য অনুযায়ি, জুন ২০২২ পর্যন্ত সারাদেশে রেজিস্ট্রিকৃত মোটর সাইকেলের সংখ্যা হচ্ছে ৩৭ লাখ ৫৩ হাজার ১৩৮টি। আর রাজধানী ঢাকায় এই সংখ্যা নয় লাখ ৬১ হাজার ২১২টি। এর মধ্যে গত প্রায় পাঁচ বছরে ঢাকায় মোটরসাইকেল বেড়েছে প্রায় পাঁচ লাখ। 

লেখক: সাংবাদিক 
 

/তারা/ 

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ