ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

বরিস জনসনের বিদায় ও পরবর্তী ব্রিটেন

অলোক আচার্য || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৭:২৮, ৯ জুলাই ২০২২   আপডেট: ১৭:৩০, ৯ জুলাই ২০২২
বরিস জনসনের বিদায় ও পরবর্তী ব্রিটেন

করোনা মহামারির সময় বিধি নিষেধ ভেঙে ডাউনিং স্ট্রিটে মদের পার্টি বসিয়ে সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হন প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন। এরপর থেকেই তার সময়টা ভালো যাচ্ছিল না। শেষ পর্যন্ত নিজ দলের মন্ত্রী-এমপিদের সমর্থন হারিয়ে তিনি দলের নেতৃত্ব ছেড়েছেন। প্রধানমন্ত্রীত্ব ছাড়বেন নতুন নেতা নির্বাচিত হলে। গণমাধ্যমে এমনটাই জানা গেছে। 

এরই মধ্যে সামনে আসতে শুরু করেছে যুক্তরাজ্যের ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রীর নাম। অথচ মাত্র কয়েকদিন আগেও তিনি ক্ষমতায় থাকার ব্যাপারে শক্ত অবস্থানে ছিলেন। এমনকি তার লক্ষ্য আগামী দশকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকা- এমন ইচ্ছাও পোষণ করেছিলেন। বরিস জনসনের ক্ষমতায় যাওয়ার পেছনের ইতিহাস বেশ ঘটনাবহুল। মূলত একটি ইস্যু সেসময় তোলপাড় করে পুরো ব্রিটেনে। বিশ্বজুড়েই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। তা হলো বেক্সিট ইস্যু। ব্রেক্সিট ইস্যুতে বিভিন্নভাবে জল ঘোলা হওয়ার পর ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরে দাঁড়ান থেরেসা মে। এর পরপরই আলোচনায় উঠে আসে পরবর্তী প্রধানমন্ত্রীর। ব্রিটেনে তখন এমন একটা সময় বিরাজ করছিল,  যে এই পদে আসবেন তাকে তার ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই বেশ কিছু জটিল চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে। সেই পদের জন্য রক্ষণশীল দলের বরিস জনসন এবং তার প্রতিদ্বন্দ্বীপ্রার্থী জেরেমি হান্টের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়। একজন সাংবাদিক থেকে প্রধানমন্ত্রী হওয়া বরিস জনসন ব্রিটেনের এই পরিস্থিতি বেশ সফলভাবেই সামাল দিয়েছেন। কিন্তু প্রথম বিপাকে পড়েন মূলত দুই বছর আগে লকডাউনের মধ্যে পার্টি দিয়ে। এই তথ্য ফাঁস হওয়ার পর থেকেই পরিস্থিতি ঘোলাটে হয়ে ওঠে। তার পদত্যাগের দাবিতে স্বর বাড়তে থাকে। তার নিজ দলের অনেক নেতা আছেন সেই কাতারে। তার পদত্যাগের দাবিতে ডাউনিং স্ট্রিটে বিক্ষোভও হয়েছে।

এমনকি প্রিন্স ফিলিপের শেষকৃত্যের আগের দিনও মদের পার্টি দিয়েছিলেন তিনি। এরপর তিনি রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের কাছে ক্ষমা চেয়ে চিঠি দেন। মূলত এই ঘটনার পরে তার প্রধানমন্ত্রীত্ব নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। তিনিই যদি লকডাউনের নিয়ম অনুসরণ না করেন তবে তা জনগণের ওপর কীভাবে প্রয়োগ করবেন। এরপর আবার লন্ডনের স্থানীয় নির্বাচনে ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টির শক্ত ঘাঁটিতে ক্ষতির সম্মুখীন হন বরিস জনসন। ইংল্যান্ড, ওয়েলস এবং স্কটল্যান্ডের স্থানীয় নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি আসনে জয়ী হয় লেবার পার্টি। কনজারভেটিভ পার্টির জনপ্রিয়তা কমার পেছনের কারণ হিসেবে মনে করা হয় সেই পার্টিগেট কেলেঙ্কারি। বেক্সিট ইস্যু সামাল দিলেও তার পরবর্তী সমস্যাগুলো ভালোভাবে সামাল দিতে পারেননি বরিস। ব্রিটিশদের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যায় কয়েকগুণ যা গত এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ। বিশেষত মুদ্রাস্ফীতি ব্যাপক বৃদ্ধি পায়। গত ৪০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ অবস্থায় পৌঁছে। 

অথচ ২০১৯ সালে বিপুল জনপ্রিয়তায় ক্ষমতায় আসে কনজারভেটিভ পার্টি। প্রধানমন্ত্রীত্ব গ্রহণ করেন বরিস জনসন। এত অল্প সময়েই কেন বরিস জনসন নির্ভরযোগ্যতা হারালেন তার কারণ খুঁজতে গিয়ে বিবিসি পাঁচটি কারণ পেয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ক্রিস পিনচারের যৌন অসদাচরণ, করোনাকালে পার্টিগেট কেলেঙ্কারি, জীবনমানের খরচ এবং ট্যাক্স বৃদ্ধি, ওয়েন প্যাটারসনকে নিয়ে ক্ষোভ এবং দৃষ্টিভঙ্গি ও আইডিয়ার অভাব। তবে শেষ পর্যন্ত তিনি চেষ্টা চালিয়েছেন কিন্তু নিজের দলের মধ্যে থেকে সমর্থনের মাত্রা কমতে থাকায় শেষ রক্ষা হয়নি।  

এক জরিপ সংস্থার করা জরিপে দেখা যায়, ৬৯ শতাংশই বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে বরিস জনসনের পদত্যাগ করা উচিত। মোট কথা পরিস্থিতি তার অনুকূলে ছিল না। ব্রেক্সিট নিয়ে উত্তাপ শুরু হয় ২০১৬ সালে। যখন ইইউ থেকে বেরিয়ে আসার জন্য যুক্তরাজ্যে চাপ বাড়তে থাকে। এ নিয়ে পক্ষ-বিপক্ষ দুই-ই ছিল। ফলে ওই বছর ২৩ জুন ব্রেক্সিট নিয়ে গণভোটে হেরে যায় ইইউপন্থী তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরন। গণভোটের পরাজয় মেনে নিয়ে তিনি পদত্যাগ করেন। তারপর এই ব্রেক্সিট ইস্যু মূল রেখেই ক্ষমতায় বসেন থেরেসা মে। ব্রেক্সিট ইস্যুতে বিভিন্নভাবে জল ঘোলা হওয়ার পর ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী থেকে সরে দাড়ান থেরেসা মে। এরপর দায়িত্ব নেন বরিস। 

দায়িত্ব নিয়ে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হয়েছে তাকে। কিন্তু পার্টিগেট কেলেঙ্কারির পর থেকেই তার ওপর চাপ বাড়তে থাকে। পরিস্থিতি তার হাতের এতটাই বাইরে চলে যায় যে, সব মিলিয়ে ৫৭ জন মন্ত্রী ও কর্মকর্তা পদত্যাগ করেন। অবশেষে বরিস জনসন তার আগের অবস্থান থেকে সরে এসে পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন। কারণ ততক্ষণে প্রায় সব কিছুই তার বিপক্ষে চলে যায়। এ কথা নিঃসন্দেহ যে প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন এই মুহূর্তে প্রচণ্ড চাপে আছেন। যদিও তিনি পদত্যাগ করেছেন কিন্তু যতদিন না নতুন প্রধানমন্ত্রী আসেন তত দিন তিনি দায়িত্ব চালিয়ে যাবেন। এখন জনসনের স্থলে নতুন প্রধানমন্ত্রী কে হবেন তার জন্য সময়ের অপেক্ষামাত্র। 

নিয়মানুযায়ী ব্রিটেনের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হবেন ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ দলের নির্বাচিত কোনো নেতা। প্রথমে রক্ষণশীল দল দুইজন প্রতিদ্বন্দ্বী বেছে নেবে। তারপর তাদের মধ্যে থেকে একজনকে চূড়ান্তভাবে বেছে নেওয়া হবে যিনি প্রধানমন্ত্রীর পদে বসবেন। ইতিমধ্যেই অনেকের নামই সামনে এসেছে। তবে একটি ভালো শুরুর পর শেষটা ভালো হলো না বরিস জনসনের। কিন্তু যিনি বরিস জনসনের স্থলে আসবেন তাকে অবশ্যই কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে যেতে হবে। তার সামনে বড় সমস্যাগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো জনগণের জীবনযাত্রায় ব্যয় কমানো। করোনা পরবর্তী সময়ে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বাজারের ব্যয় যেভাবে বাড়ছে তাতে এ পরিস্থিতি সামাল দেওয়া বেশ কষ্টসাধ্য। যাই হোক, পরবর্তী প্রধানমন্ত্রীর দক্ষতার ওপরই নির্ভর করছে পরবর্তী ব্রিটেনের গতিপথ।  

শিক্ষক ও মুক্তগদ্য লেখক
 

/তারা/ 

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়