ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

হিমালয়জয়ী কন্যাদের বিশ্ব বাঙালির অভিবাদন

অজয় দাশগুপ্ত || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৮:৪৩, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২২  
হিমালয়জয়ী কন্যাদের বিশ্ব বাঙালির অভিবাদন

ইতিহাস কীভাবে লেখা হয়? ইতিহাস রচিত হওয়ার আগে তা ভাবাও যায় না। আমাদের মেয়েরা ঝিমিয়ে পড়া কলহমুখর ক্রীড়া জগতে যে ইতিহাস রচনা করে দেখালো তার তুলনা মেলা ভার।

এদের কথা বলার আগে বলি, দেশে ক্রিকেট ক্রেজ মারাত্মক; অনেকটা সংক্রামক রোগের মতো! মিডিয়া সরকার জনগণ মিলে ক্রিকেটই এগিয়ে। কেন এগিয়ে? তার ব্যাখ্যা কেউ দিতে পারবেন না। এমন না যে এই খেলায় দু’একটি বিজয় ধরা দেয়নি। কিন্তু সেগুলো এতো অল্প আর এতো দুষ্প্রাপ্য যে এর পেছনে লগ্নিকৃত টাকা আর পাওয়ার গেমের কাছে তা নিতান্ত তুচ্ছ। উপমহাদেশে ভারত-পাকিস্তানের ক্রিকেট ক্রেজ যে এ বিষয়ে অবদান রাখে তা বলাবাহুল্য। সাথে আছে ক্রিকেট নিয়ে জুয়া আর উন্মাদনা। সে তুলনায় ফুটবল বা সকার এখন একেবারেই পরিত্যক্ত একটি খেলা। পুরুষ ফুটবল একদা আমাদের ঘুম কেড়ে নিতো। মোহামেডান আবাহনী ব্রাদার্স ইউনিয়ন বা ওয়ান্ডার্স ক্লাবের সোনালি অতীত এখন ধূসর পান্ডুলিপি । কোরামিন দিয়েও জাগানো যায়নি তাকে। 

শুরুতে আসুন সাফ ফুটবল চ্যাম্পিয়ন নারী দলের নিলুফার সঙ্গে পরিচিত হই। বাছিরন বলছিলেন, ‘সংসারে অভাব-অনটন ছিল। অভাবে-কষ্টে মানুষ করিচি। ও (নিলুফা) যদি কোনো দিন (ফুটবল) ভালো করতে পারে করুক। বাধা দেব না। মানুষ যত খারাপ বলে বলুক, শেষ দেখে ছাড়ব।’

এসএসসির পর কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার আমলা সরকারি কলেজে ভর্তি হন নিলুফা। সেখান থেকেই এইচএসসি পাস করেন। এরপর খেলোয়াড় কোটায় ভর্তি হন যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে। নিলফুার খেলোয়াড় হয়ে ওঠার পেছনে থানাপাড়া এলাকার আরেকজনের অবদানের কথা জানালেন বাছিরন। সেই ব্যক্তি হলেন আবু ফাত্তাহ। কয়েক বছর আগে তিনি মারা গেছেন। আবু ফাত্তাহ বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের কর্মকর্তা ছিলেন। কুঠিপাড়া এলাকায় চরে নিলুফার ফুটবল খেলা দেখে তিনি মুগ্ধ হয়ে উৎসাহ দিয়েছিলেন। প্রশিক্ষণ, ঢাকায় ভর্তিসহ যাবতীয় কাজে তিনিই সহযোগিতা করেন। সোমবার বেলা ১১টার দিকে নিলুফা বাড়িতে ফোন করেন। মাকে বলেন, ‘দোয়া কোরো মা। খুব টেনশন হচ্ছে। নামাজ পোড়ো আর কালকে (মঙ্গলবার) রোজা রেখো।’ মেয়ের কথামতো আজ রোজা রেখেছেন বাছিরন।

গতকাল সন্ধ্যায় বাছিরন মুঠোফোনে বাংলাদেশ দলের খেলা দেখেছেন। নিলুফা ফাইনালে মাঠে নামেননি। তবে এতে বাছিরনের আফসোস নেই। হেসে বললেন, ‘দলের সব মেয়েই আমার মেয়ে। সংগ্রামে মেয়ে বড় হয়েছে। আমার মেয়েদের বাংলাদেশ জয় পেয়েছে। এটা আমার গর্ব।’

কয়েক বছর আগে পাকিস্তানকে হারানোর পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে নিলুফা অর্থ পুরস্কার পেয়েছিলেন। ওই টাকা দিয়ে নিলুফা জমি কিনেছেন। নিলুফার মা আরো বলেন, একসময় যারা মেয়ের খেলোয়াড় হওয়া নিয়ে নানা কথা শোনাতেন, তারা এখন ফোন করে খোঁজ নিচ্ছেন। কটুকথার জন্য আফসোস করছেন। কেউ কেউ ক্ষমাও চাচ্ছেন।’ একটি জাতীয় দৈনিকে মেয়েকে নিয়ে মায়ের এই কথাগুলো প্রকাশিত হয়েছে।   

বাস্তবতায় প্রমিলা তথা মেয়েদের ফুটবল? সে তো নানা কারণে এমনিতেই বাধাগ্রস্ত। এর সামনে পেছনে দুশমনেরা দলবেঁধে দাঁড়িয়ে। মনে রাখতে হবে, আমরা বলছি সামাজিকভাবে বদলে যাওয়া এক বাংলাদেশের কথা। সংবিধান আর খাতা কলমে আপনি একে গণতান্ত্রিক আর সেক্যুলার বলে মনে মনে শান্তি লাভ করতেই পারেন। বাস্তবে এটি এখন কোনমুখি সেটা সবাই জানেন। পোশাক খাদ্যসহ নারীদের ব্যাপারে চরম স্পর্শকাতর সমাজে মেয়েদের খেলাধুলা সবসময় বিপদের মুখে। আমরা ভুলে যাবো না পোশাকের ধূয়া তুলে নারী ফুটবল নিষিদ্ধ করার জন্য মিছিলও হয়েছে দেশে। কুড়িগ্রামসহ দেশের প্রত্যন্ত এলাকায় মহিলা ফুটবল টুর্নামেন্ট বন্ধ করা হয়েছে। অথবা বন্ধ করতে বাধ্য করা হয়েছে। এমন সমাজে কলসুন্দর গ্রামের মেয়েদের হঠাৎ আলোর ঝলকানি বলে দিয়েছিল- তারা আসছে। এখানে সেই সব মেয়েদের কথা বলা হচ্ছে যাদের একজনের কাছে এক সাংবাদিক জানতে চেয়েছিলেন- তারা কী চায়? এর জবাবে তারা জানিয়েছিল দুবেলা খেতে চায়। আর কী চায়? এর উত্তরেও তারা দুবেলা ভাতের কথা জানিয়ে প্রমাণ করেছিল কতটা কষ্টে আছে তারা । 

আমরা নিশ্চয়ই ভুলে যাইনি এদের সাধারণ বাসে চড়ে বাড়ি ফেরার কথা। বিজয়ী হয়ে ফিরে এসেও যথাযোগ্য সম্মান পায়নি তারা। তাদের জয় তাদের অর্জনে মনে মনে সন্তুষ্ট হলেও মুখ খোলেনি অনেকে। একটা কথা বলতেই হবে সব কিছুর সঙ্গে আমাদের মিডিয়াও পরিবর্তনের শিকার হয়েছে। তারা নারীদের খেলাধুলা নিয়ে তেমন কোনো প্রচার করে না। এর দুটি কারণ থাকতে পারে, প্রথমত সমাজের উগ্র অংশটিকে রাগাতে চায় না বা ম্যানেজ করে রাখতে চায়। অন্য কারণটি বাণিজ্যিক। সাকিব তামিম নামের স্টারেরা ঘর থেকে বাইরে পা রাখলেই ক্যামেরা হুমড়ি খেয়ে পড়ে। তাদের খবর জানতে বাধ্য হয় জনগণ। আর নারীরা জয় করে ফিরলেও তাদের কথা বলে না কেউ। 

গতকাল নেপালের কাঠমান্ডু দশরথ স্টেডিয়ামে সাফ ফুটবলের শিরোপা জিতে নেওয়া মেয়েদের কথা জানুন। কোথা থেকে এসেছে তারা? এমন একটি দিনের অপেক্ষায় ছিলেন বাংলাদেশের সাবিনারা। বয়সভিত্তিক ফুটবলে শিরোপা জেতা বাংলাদেশ দলের কাছে সিনিয়র পর্যায়ের শ্রেষ্ঠত্ব ছিল আকাশের চাঁদ। গতকাল কাঠমান্ডু দশরথ স্টেডিয়ামে সেই আকাশই ছুঁয়ে দিলেন বাংলাদেশের মেয়েরা, কৃষ্ণার জোড়া গোল আর শামসুন্নাহারের ম্যাজিকে। এক সময় ক্ষুধা-দারিদ্র্য ছিল যাঁদের নিত্যসঙ্গী, সেই মেয়েদের হাতেই আজ উড়ছে ফুটবলের পতাকা।

বাংলাদেশ দলের কোচ গোলাম রব্বানী ছোটনও সহায়-সম্বলহীন মেয়েদের পরিশ্রমে গড়া শিরোপাসৌধের কথা বলেছেন, ‘এই মেয়েরা এসেছে খেটে খাওয়া পরিবার থেকে। ফুটবল না হলে হয়তো তারা অন্য কিছু করত গ্রামের বাড়িতে। ফুটবলের সৌভাগ্য তাদের স্বপ্ন দেখাতে পেরেছে, এর বিনিময়ে এই মেয়েরাও ফুটবলকে দুহাত ভরে দেওয়ার চেষ্টা করে। তাদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ।’ 

কাল দশরথ স্টেডিয়ামে সাবিনা-কৃষ্ণারা রচনা করেছেন অসম্ভবের গল্প। তবে দশরথ বলেই ভয় ছিল। ঘরের মাঠে গ্যালারি উপচে পড়ে, নেপালি সমর্থকদের চিল-চিৎকারে প্রতিপক্ষ দলের খেলায় মনোযোগ ধরে রাখা যেন দ্বিতীয় লড়াই। এই উত্তুঙ্গ সমর্থনও গতকাল তাতিয়ে রাখতে পারেনি রেশমি-অনিতাদের। জীবনযুদ্ধে জয়ী সাবিনা-মনিকা-শামসুন্নাহার-কৃষ্ণারা গ্যালারির প্রতিকুল স্রোতের বিপক্ষে সাঁতরে তীরে উঠেছেন অবলীলায়।

ছোটবেলা থেকেই তাঁরা জীবনসংগ্রামের মধ্যে; ফুটবলই দিয়েছে তাঁদের নতুন জীবনের দিশা। সেখানে দশরথের ভয়ে তাঁরা কুঁকড়ে যাওয়ার মেয়ে নন। দলের উইঙ্গার সানজিদা যেমন ম্যাচের আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘ফাইনালে আমরা একজন ফুটবলারের চরিত্রে মাঠে লড়ব এমন নয়, ১১ জনের যোদ্ধা দল মাঠে থাকবে, যে দলের অনেকে এই পর্যন্ত এসেছে বাবাকে হারিয়ে, মায়ের শেষ সম্বল নিয়ে, বোনের অলঙ্কার বিক্রি করে, অনেকে পরিবারের একমাত্র আয়ের অবলম্বন হয়ে। আমরা জীবনযুদ্ধেই লড়ে অভ্যস্ত। দক্ষিণ এশিয়ার শ্রেষ্ঠত্বের জন্য শেষ মিনিট পর্যন্ত লড়ে যাব।’ 

এসব মেয়েদের কী বলবেন আপনি? আমরা যারা বাংলাদেশী আমরা জানি কতটা প্রতিকুলতা পেরিয়ে তারা এ জায়গায় এসেছে। জোড়া গোল করা কৃষ্ণার মা বিদ্যুতের অভাবে খেলা দেখতে পারেননি। তার বাবা পাশের গ্রামে গিয়ে খেলা দেখেছেন। ভাই উপোস করেছিল দিদি আর দেশের জয়ের জন্য। 

এরা আমাদের দেশের গর্ব। আমাদের জাতির অহঙ্কার। আর এদের বিরুদ্ধে যারা, তাদের কাজ হচ্ছে নারীর শক্তিকে আঘাত করা। তারা জানে নারী শক্তিই আমাদের দেশ জাতিকে এগিয়ে রেখেছে। যার কারণে মৌলবাদ অন্ধত্ব আর আগ্রাসীরা কোণঠাসা। থাক ওদের কথা। আজ আমাদের আনন্দের দিন। দেশে বিদেশে বাংলাদেশীদের জয় পতাকা ওড়ানোর দিন। সে দিনটি যারা এনে দিয়েছে সেই অবহেলিত মেয়েদের জানাই স্যালুট। তারা পারে, তারাই পেরেছে, তারাই পারবে। কন্যা জায়া জননীদের অভিবাদন জানাক বাঙালি জাতি। 

সিডনি
 

/তারা/ 

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়