ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

অর্থনৈতিক মন্দার ধাক্কা, কতোটা প্রস্তুত পৃথিবী  

অলোক আচার্য || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:৪৮, ৭ অক্টোবর ২০২২   আপডেট: ১২:৫৪, ৭ অক্টোবর ২০২২
অর্থনৈতিক মন্দার ধাক্কা, কতোটা প্রস্তুত পৃথিবী  

২০১৯ সাল থেকে শুরু হওয়া করোনাসৃষ্ট মহামারিতে অসংখ্য মানুষ মারা গেলেও এর ধাক্কাটা ছিল মূলত আর্থিক এবং এর পরেই শুরু হওয়া রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ সেই আর্থিক সংকট আরো ঘনীভূত করেছে। শেষ পর্যন্ত এই অর্থনৈতিক বিপর্যয় কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে সে বিষয়ে স্পষ্ট কোনো ধারণা না-পাওয়া গেলেও আগামী বছর যে পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যেতে পারে সে বিষয়ে পূর্ব সতর্কতা রয়েছে।

যে যুদ্ধ আজকের এই দুঃসময়ের জন্য দায়ী সেই যুদ্ধ এক ধরনের খেলায় পরিণত হয়েছে। আজারবাইজান-আর্মেনিয়া সংঘাত অথবা মধ্য এশিয়ার প্রতিবেশী দেশ দুটির সংঘাতে জড়ানো এটাই নির্দেশ করে। সরাসরি যুদ্ধে না জড়ালেও যুদ্ধ পরিস্থিতিও রয়েছে অনেক স্থানে। সুতরাং একটি সংকটপূর্ণ পরিস্থিতি থেকে ফেরার উপায় যেন ক্রমশ সংকীর্ণ হয়ে আসছে।

এদিকে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি একটি অনিবার্য মন্দার দিকে যাচ্ছে বলেও মনে করা হচ্ছে। কারণ ইতোমধ্যেই মূল্যস্ফীতি বিশ্বকে প্রায় নাজেহাল করে ফেলেছে। বৈশ্বিক মন্দা বা মহামন্দা সম্পর্কে যারা জ্ঞাত তারা জানেন, বিশ্বের জন্যই এটি ক্ষতিকর এবং এখান থেকে ঘুরে দাঁড়াতে হলে সবার আগে রাজনৈতিক পরিস্থিতি শান্ত হতে হবে- এর বিকল্প নেই। খাদ্য উৎপাদন, সরবরাহ এবং বণ্টন নিশ্চয়তার সাথে, শিল্প-কলকারখানার গতি, বেকারত্ব বৃদ্ধিতে লাগাম দেওয়া, মূল্যস্ফীতি কমিয়ে জনগণের জীবনের ওপর চাপ কমানো ইত্যাদি পদক্ষেপ নিতে হলে আগে যুদ্ধ থামাতে হবে। কিন্তু সে সম্ভাবনা আপাতত দেখা যাচ্ছে না। 

বর্তমান পরিস্থিতিতে এই তালিকায় ধনী-দরিদ্র সব দেশ রয়েছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে, খাদ্য নিরাপত্তা বিষয়ক বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বিশ্বব্যাপী খাদ্য ব্যবস্থাপনার এক চিত্রে তুলে ধরা হয় যে, ৪৫টি দেশের ২০ কোটি ৫১ লাখ মানুষ খাদ্য সংকটে ভুগবে এবং ২০২১ সালের তুলনায় ২০২২ সালে তাদের অবস্থা আরও খারাপ হবে। সোমালিয়ার উপকূলবর্তী তিনটি অঞ্চলে অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে প্রবল খাদ্য সংকটের কারণে দুর্ভিক্ষ দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বব্যাপী খাদ্যশস্যের মূল্য ৮ শতাংশ বেড়েছে। একই সঙ্গে রপ্তানি মূল্য সূচক কমেছে ২ শতাংশ। এ থেকেই আঁচ করা যায় পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে। 

অর্থনীতিতে মন্দা এবং মহামন্দা দুটি শব্দই প্রচলিত। এই দুটি পরিস্থিতির মুখোমুখি এর আগেও বিশ্ব হয়েছে। জাতিসংঘের খাদ্য নিরাপত্তা বিভাগের প্রধান ডেভিড বিসলি নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে এক তথ্যে জানান, বিশ্বের ৮২টি দেশের অন্তত ৩৪ কোটি ৫০ লাখ মানুষ চূড়ান্ত খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে এবং যদি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হয়, সেক্ষেত্রে শিগগিরই এই সংখ্যার সঙ্গে আরও ৭০ কোটি মানুষ যুক্ত হবেন। তিনি আরও বলেন, করোনা মহামারীর শুরুর পর্যায়ে বিশ্বজুড়ে যতসংখ্যক মানুষ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছিল, মহামারীর আড়াই বছরে এই সংখ্যা বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি।

যখন মোট দেশজ উৎপাদন কমে যায় তখন সেই পরিস্থিতিকে অর্থনৈতিক মন্দা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ১৯৩০ সালেও বিশ্ব মহামন্দার মুখোমুখি হয়েছিল। তবে এই মুহূর্তে মূলত ১৯৭০ সালের মন্দার কথাই ঘুরেফিরে আসছে। দ্য গ্রেট ইনফ্লেশনের তথ্যে জানা যায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সমৃদ্ধি এনে দিয়েছিল। সে সময় উৎপাদন বাড়ে, কমে যায় বেকারত্ব, মূল্যস্ফীতিও ছিল অনেক কম, ১ শতাংশের ঘরে। কিন্তু ১৯৬৫ সাল থেকে পরিস্থিতি বদলাতে থাকে। বাড়তে থাকে বেকারত্ব ও মূল্যস্ফীতি। এই পরিস্থিতি ছিল ১৯৮২ সাল পর্যন্ত। এ সময়কেই বলা হয় দ্য গ্রেট ইনফ্লেশন। এ সময়ই আবার মন্দার অভিজ্ঞতাও হয়। এখন সেই সময়ের পরিস্থিতিরি সাথে মিল খুঁজলে মুল্যস্ফীতির ক্রমোত্থান এবং বেকারত্ব দুটোই পাওয়া যায়। এখান থেকে উত্তরণ যে সহজ কথা নয় সেটাও জানা আছে। কিন্তু এই অনিবার্য পরিণতি কীভাবে সম্মিলিতভাবে এড়ানো যায় সেটা নিয়ে কোনো ঐক্যমত চোখে পরছে না। আশঙ্কাটা এখানেই। 

‘বিশ্বমন্দা কি আসন্ন’ শিরোনামে বিশ্বব্যাংকের একটি বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, ১৯৭০ সালের পর এবার অর্থনীতির গতি সবচেয়ে কমে গেছে। বিশ্বের সর্ববৃহৎ অর্থনীতির দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন এবং ইউরোপের প্রবৃদ্ধি দ্রুত নেমে যাচ্ছে। এর প্রভাবে আগামী বছর মন্দায় রূপ নিতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলোতে মুদ্রাস্ফীতি বিগত ৪০ বছরেও দেখা যায়নি। এমন পরিস্থিতিতে আগামী বছর নাগাদ বিশ্বমন্দার যে আশঙ্কা করা হচ্ছে সেটি ঠেকানো সম্ভব কি না সে বিষয়ে বিশ্লেষণ দেওয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, অর্থনীতি যে গতিতে চলছে তাতে উচ্চ মূল্যস্ফীতি অবস্থায় অর্থনীতির সংকোচন বা মন্দা আসন্ন। করোনা পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে পারলেও এখনও পৃথিবীর অনেক দেশ আগের অবস্থায় ফিরে যেতে পারেনি। অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সুদহার বাড়ানোর যে পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে সেগুলো সমন্বিতভাবে করতে হবে। হঠাৎ নেওয়া এই উদ্যোগ ধাপে ধাপে নিলে অর্থনীতিও সহনীয় হবে। নীতি সহায়তাগুলো হঠাৎ তুলে না দিয়ে বাজার চাহিদার সঙ্গে সমন্বয় রেখে করতে হবে। মধ্য মেয়াদে একটি কাঠামোর আলোকে নীতি সহায়তা সাজাতে হবে। শ্রমবাজার, নিত্যপণ্য এবং বাণিজ্যের গতির সঙ্গে নীতিগুলোর সমন্বয় করতে হবে। এর মধ্যে ইউরোপের কথা উল্লেখযোগ্য। সেখানে গ্যাস, পেট্রোলিয়াম ও বিদ্যুতের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কারণে ইউরোপের বেশির ভাগ দেশেই মূল্যস্ফীতি বাড়ছে। গত জুলাইয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২৭টি দেশে মূল্যস্ফীতির গড় হার ছিল ৯.৮ শতাংশ। যা ১৯৯৭ সালের পর সর্বোচ্চ। 

সম্প্রতি প্রকাশিত এক পরিসংখ্যানে দেখা যায় যে, ইউরো ব্যবহার করে এমন ১৯টি সদস্য রাষ্ট্রে মূল্যস্ফীতি গড়ে ৮.৯ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। সেখানকার শীর্ষ অর্থনীতির দেশ জার্মানিতে জুলাইয়ে মূল্যস্ফীতি ৮.৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। অর্থনীতির ভয়াবহ অবস্থা আঘাত করেছে প্রধানত ইউরোপে। এই অস্থিরতার পেছনে যে জ্বালানি সংকট কাজ করছে তা আর নতুনভাবে বলার অপেক্ষা রাখে না। সেখানকার দেশগুলো মূল্যস্ফীতির কঠিন অবস্থার সাথে সাথে জ্বালানি সংকট দেখা দিয়েছে। এসব সংকট কোথাও কোথাও রাজনৈতিক অস্থিরতারও জন্ম দিচ্ছে। পরিস্থিতি বিবেচনায় বিশ্লেষকরা আসন্ন মন্দার শুরু ইউরোপ থেকেই বলে মনে করছেন। 

ব্রিটেনের মূল্যস্ফীতি বিগত ছয় দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ অবস্থায় পৌঁছেছে। সম্প্রতি সেখানে লিজ ট্রাস নতুন ক্ষমতায় এসেছেন। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের তথ্য মতে, হাঙ্গেরি, স্লোভাকিয়া এবং চেক রিপাবলিক এই তিনটি দেশ বাজে অবস্থার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। এই তিন দেশে রাশিয়ার গ্যাস সরবরাহ পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে।

একটি যুদ্ধ কি ধরনের পরিবর্তন আনতে পারে তার বাস্তব অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি আমরা। যুদ্ধের অভিজ্ঞতা পৃথিবীতে নতুন নয় কিন্তু যুদ্ধের ফলে পৃথিবীজুড়ে যে সংকট তৈরি হয়েছে তার অভিজ্ঞতা একটু নতুনই বলতে হবে। কারণ হলো, করোনাভাইরাসের মতো একটি অতিমারীর পর এভাবে যুদ্ধের মুখোমুখি আগে কখনও হতে হয়নি। এখন একইসঙ্গে দুটি সংকটের মোকাবিলা করতে হচ্ছে। 

রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করার পর জ্বালানী তেলের মূল্য বিশ্ববাজারে রেকর্ড পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ক্ষতিকর প্রভাবে দরিদ্র দেশগুলোই বেশি ভুগছে। ফলে অর্থনৈতিক টানাপোড়েন, খাদ্য সংকট এবং ভয়াবহ মূল্যস্ফীতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে পৃথিবী। এর মধ্যেই যুদ্ধ বন্ধ হওয়ার পরিবর্তে দীর্ঘায়িত হওয়ার ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। ফলে খুব দ্রুতই যে এই সমস্যার সমাধান হবে সেটাও আশা করা যায় না। পশ্চিম ও মধ্য ইউরোপের দেশগুলো এবং দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো এ মন্দার হাওয়া থেকে বাদ যাবে না। পৃথিবীতে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। এ ধরনের বিপর্যয় সামলে ওঠা আরেকটি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি আমাদের দাঁড়ি করিয়ে দিয়েছে। 

লেখক: প্রাবন্ধিক ও মুক্তগদ্য লেখক
 


  
 

/তারা/ 

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়