যুদ্ধের জুজু বনাম অস্ত্র ব্যবসা
যুদ্ধ করতে অস্ত্র প্রয়োজন। অস্ত্র যুদ্ধের পরিণতির নিয়ামক। অস্ত্রই সমরনীতির মাতব্বরির মূল। যার অস্ত্র ক্ষমতা বেশি সেই ক্ষমতাবান। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে ইউক্রেনের প্রয়োজন অস্ত্র। শুধু ইউক্রেনের নয়, বিশ্বের প্রতিটি দেশই সুরক্ষিত থাকতে এই অস্ত্রের উপর ভরসা করে। কারণ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে সীমান্তে উত্তেজনা নতুন কোনো ঘটনা নয়। সেই উত্তেজনা পৌঁছে যায় যুদ্ধের কাছাকাছি। তখন কার অস্ত্রভাণ্ডার কতটা সমৃদ্ধ সেই হিসাবনিকাশ শুরু হয়ে যায়।
বলাবাহুল্য পৃথিবীর বড় ব্যবসা হলো অস্ত্রব্যবসা। তবে এই ব্যবসার লাটাই কয়েকটি দেশের হাতে। তারাই জমজমাট অস্ত্রব্যবসা করে। স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এসআইপিআরআই) নতুন তথ্যে দেখা গেছে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে সরবরাহ ব্যবস্থায় কিঞ্চিৎ ভাটা পরলেও রমরমা হয়েছে অস্ত্র ব্যবসা। ২০২১ সালে অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম উৎপাদনকারী বিশ্বের ১০০ বড় কোম্পানির বিক্রি ১ দশমিক ৯ শতাংশ বেড়েছে। এই ১০০ প্রতিষ্ঠানের ৪০টিই যুক্তরাষ্ট্রের। অস্ত্র ব্যবসার অর্ধেকের বেশি তারা নিয়ন্ত্রণ করে।
এই মুহূর্তে বিশ্বে বৈধ অস্ত্র ব্যবসার মোট মূল্য ৫৯২ বিলিয়ন ডলার। বিশ্বজুড়েই অস্ত্র বিক্রি হচ্ছে। ছোট বড় সব দেশ অস্ত্র কিনছে নিজেদের সামরিক ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে। এসআইঅপিআরআই-এর এক জরিপে বলা হয়েছে, ২০১৯ সালে অস্ত্র বিক্রি বৃদ্ধি পেয়েছিল ১ দশমিক ১ শতাংশ। যা ২০২১ সালে ১ দশমিক ৯ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধে একটা বিষয় পরিষ্কার যে, অস্ত্র ক্ষমতা সমৃদ্ধ হলেই ক্ষমতাধর দেশের থেকে নিজেকে নিরাপদ রাখা সম্ভব। আর এই বাজারে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। পোল্যান্ড ও দক্ষিণ কোরিয়া যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে ট্যাংক ও হেলিকপ্টার নিচ্ছে। যুদ্ধের ডামাডোলে অস্ত্র ব্যবসা ফুলে ফেঁপে উঠেছে। তাহলে স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন ওঠে- যুদ্ধও এক প্রকার ব্যবসায়িক সমীকরণ কিনা। আসলে তাই। যুদ্ধ মানেই প্রচুর অস্ত্রের যোগান। সুতরাং অস্ত্র কিনতে হবে। একদিকে ধ্বংস আবার অন্যদিকে ফুলে ফেঁপে ওঠা।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পৃথিবীর রাজনীতি, অর্থনীতি এবং সমরনীতিতে নতুন মেরুকরণ তৈরি করেছে। জোট এবং জোটনীতিতেও নতুন চিন্তা-ভাবনা যোগ হচ্ছে। সেই সাথে বর্তমান পৃথিবীর শক্তিমত্তার অন্যতম নির্ধারক অস্ত্র সমৃদ্ধকরণেও গতি সঞ্চার করেছে। রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে এখন ইউক্রেনের সবচেয়ে বেশি দরকার অস্ত্র। যুক্তরাষ্ট্র এখন পর্যন্ত ইউক্রেনকে অস্ত্র সরবরাহ করছে। যে কোনোভাবে নিজেদের শক্তিমত্তা বৃদ্ধি করা, হুমকি থেকে নিজেকে মুক্ত রাখা এবং এ উদ্দেশ্যে সামরিক খাতে নতুন নতুন অস্ত্র যোগ করে নিজেকে উপযুক্ত করে গড়ে তোলা এখন প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বের প্রবণতা।
বিশ্বের এখন চাই আরো আধুনিক অস্ত্র। যেমন হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র। আধুনিক অস্ত্রগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম বলে মনে করা হচ্ছে। ইউক্রেন যুদ্ধেও রাশিয়া হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করেছে। এখন পর্যন্ত হাতে গোণা দুচারটি দেশ এই অস্ত্র তৈরিতে সক্ষম হয়েছে। বাকিরা চেষ্টা করছে। সুতরাং এখন এটাই অন্যতম বড় নির্ধারক। ফলে ক্ষমতাধর দেশগুলোর মধ্যে হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র পেতে তীব্র প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে।
এই অস্ত্র সম্পর্কে যা জানা যায় তা হলো- এই ক্ষেপণাস্ত্র শব্দের চেয়ে নয় গুণ বেশি গতিতে উড়তে পারে। ফলে শত্রুর চোখ ফাঁকি দিয়ে লক্ষ্যবস্তুতে নির্ভুল আঘাত করতে সক্ষম। আর মাঝপথে ধ্বংস করাও প্রায় অসম্ভব। নিরাপত্তা উদ্বেগ বেড়ে যাওযায় হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রের গবেষণা ও উন্নয়নে বিনিয়োগ করছে বাইডেন প্রশাসন। এতেই বোঝা যায়, সমরক্ষেত্রের আধুনিকায়নে ব্যস্ত প্রতিটি দেশ। কেউ অস্ত্র তৈরি করছে আবার কেউ অস্ত্র কিনছে। এর কারণও আছে। বিশেষ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর রাশিয়ার ইউক্রেনে সর্বাত্মক সামরিক অভিযানের ফলে ইউরোপজুড়ে নতুন করে নিজেদের প্রতিরক্ষার বিষয়টি ভাবতে হচ্ছে। ফলে অস্ত্র ব্যবসাও ফুলে ফেঁপে উঠেছে। এ অঞ্চলের কোনো কোনো দেশ অস্ত্র বিক্রিতে নতুন রেকর্ড করতে যাচ্ছে। যে তালিকায় সামনের সারিতে রয়েছে পোল্যান্ড। দেশটি আগামী এক দশকে অস্ত্রখাতে বিনিয়োগ দ্বিগুণ করার পরিকল্পনা নিয়েছে। আবার চেক প্রজাতন্ত্র ১৯৮৯ সালের পর অস্ত্র রপ্তানি খাতে নতুন রেকর্ড গড়তে চলেছে এমন তথ্য পাওয়া যায়।
২০১৭ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে বিশ্বে অর্থ রপ্তানির হার ৪ দশমিক ৬ শতাংশ কমে গিয়েছিল। কিন্তু ইউক্রেন সংকটের কারণে অনেক দেশ অস্ত্রের আমদানি ও উন্নয়নে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয়ের ঘোষণা দিয়েছে। আঞ্চলিক নিরাপত্তা এবং সীমান্ত ঝুঁকি মোকাবেলায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদারের স্বার্থে সমরাস্ত্র আধুনিকায়নের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে, তবে এ ধরনের প্রতিযোগিতা পৃথিবীকেই অস্তিত্ব সংকটে ফেলে দিতে পারে।
এ ক্ষেত্রে কোনো দেশই পিছিয়ে থাকতে চাইছে না। পিছিয়ে থাকার কোনো কারণও নেই। প্রতিটি দেশেরই বহিঃশত্রুর হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার অধিকার রয়েছে। সেই অধিকার থেকেই নিজেকে সুরক্ষার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে তারা। যদিও এর চেয়ে অনেক বেশি জরুরি পৃথিবী বসবাসযোগ্য করে গড়ে তোলা।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট
তারা//
আরো পড়ুন