ঢাকা     রোববার   ০৬ অক্টোবর ২০২৪ ||  আশ্বিন ২১ ১৪৩১

বঙ্গবন্ধু জন্মশতবর্ষে কী পেয়েছি, কী পাইনি

মিনার মনসুর || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:৩০, ১৭ মার্চ ২০২৩  
বঙ্গবন্ধু জন্মশতবর্ষে কী পেয়েছি, কী পাইনি

২০২০ সালে আমরা বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন করেছি। পরের বছর ছিল স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। দুটোই বড় ধরনের ঘটনা আমাদের জাতীয় জীবনে এবং তা পরস্পর অবিচ্ছেদ্যও বটে। কোভিডের উপর্যুপরি বাধা সত্ত্বেও দুটোই আমরা উদযাপন করেছি সর্বোচ্চ নিষ্ঠার সঙ্গে। এখন আমার মনে হয়, জাতির পিতার এই জন্মশতবর্ষে আমরা কী করতে পেরেছি এবং কী করতে পারিনি তার এবং আমাদের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির হিসাব মিলানোর একটি বিষয় আমাদের সামনে এসেছে। 

খুব সংক্ষেপে যদি বলি, মুজিব শতবর্ষে আমাদের প্রাপ্তি অনেক। অনেক কাজ আমরা করেছি এই সময়ে। তার মধ্যে খুব উল্লেখযোগ্য কাজটি হলো বঙ্গবন্ধুকে স্বমহিমায় তুলে ধরা। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে সমাজের সকল স্তরে, বিশেষ করে আমরা যাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম বলি সেই স্তরে প্রচুর কাজ হয়েছে। তারা অনেক কিছুই জানতো না বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে। আমরা জানি, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করা হলো। তারপর থেকে তাঁর নাম মুছে ফেলার এবং তাঁকে অস্বীকার করার সর্বাত্মক চেষ্টা হয়েছে। সংবাদমাধ্যমসহ রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে তাঁর নাম উচ্চারণ পর্যন্ত নিষিদ্ধ ছিল দীর্ঘদিন। ফলে এই সময়ে যেসব প্রজন্ম বেড়ে ওঠেছে, টানা ২১ বছর তারা বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে কিছুই জানতে পারেনি। 

বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে যারা ক্ষমতা দখল করলো তারা বরং মিথ্যা তথ্য দিয়েছে। তৈরি করেছে মারাত্মক সব বিভ্রান্তি। মিডিয়া বলেন, বই বলেন, তথাকথিত বুদ্ধিজীবী বলেন সবাই কিন্তু সুর মিলিয়েছে তাতে। দিনের পর দিন সুপরিকল্পিতভাবে জনগণের মধ্যে এই যে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছিল সেটা অনেকাংশে দূর করা সম্ভব হয়েছে। মুজিব শতবর্ষে নিঃসন্দেহে এটা একটা বড় প্রাপ্তি। যদি আমাকে জিজ্ঞেস হয় যে- আমরা কি সব প্রশ্নের উত্তর পেয়েছি? বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে ঘাতকরা এবং তাদের দেশি-বিদেশি মিত্ররা যেসব জঘন্য মিথ্যাচার ও অপপ্রচার চালিয়েছিল- সব প্রশ্নের উত্তর কি আমরা পেয়েছি? আমি বলবো, না। সব প্রশ্নের যথাযথ উত্তর আমরা এখনো পাইনি। সেইসব প্রশ্নের যুক্তিসংগত উত্তরটি আমাদের অবশ্যই জানতে হবে এবং জানাতে হবে জনগণকে। 

আরো পড়ুন:

অপ্রাপ্তির প্রসঙ্গে পরে আসি। আমাদের প্রাপ্তির তালিকা কিন্তু বিশাল। জন্মশতবর্ষে প্রচুর প্রকাশনা হয়েছে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে। এত প্রকাশনা হয়েছে যে ভাবাই যায় না! বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অজস্র ছড়া, কবিতা, গল্প ও প্রবন্ধ রচিত হয়েছে এই সময়ে। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী বাস্তবায়ন কমিটি থেকে কবি কামাল চৌধুরীর তত্ত্বাবধানে বেশকিছু ভালো বই প্রকাশিত হয়েছে। বাংলা একাডেমি থেকেও প্রচুর বই বের হয়েছে। বেসরকারি প্রকাশনা সংস্থার পাশাপাশি ব্যক্তিগত উদ্যোগেও প্রকাশিত হয়েছে বিপুল সংখ্যক বই। সবগুলোর মান যে খুব ভালো তা আমি বলবো না। তবে বেশকিছু প্রকাশনা রয়েছে যা মানসম্পন্ন। 

এ সময়ে একটি অসাধারণ কাজ হয়েছে- যার সমস্ত কৃতিত্ব মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার। সেটি হলো- ‘সিক্রেট ডকুমেন্টস অফ ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ অন ফাদার অব দি নেশন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’। ইতোমধ্যে গ্রন্থটির ১০টি খণ্ড প্রকাশিত হয়েছে। এই প্রতিবেদনগুলো আমাদের ইতিহাসের খুবই গুরুত্বপূর্ণ দলিল বলে আমি মনে করি। মহামূল্যবান এই দলিলগুলো মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চেষ্টায় শুধু যে সংগ্রহ করা গেছে তাই নয়, তিনি নিজেই দলিলগুলো যাচাইবাছাই করে বই আকারে প্রকাশ করেছেন। এতে করে আমরা বঙ্গবন্ধুর জীবন ও রাজনীতি বিষয়ে এমন ঘটনা জানতে পেরেছি যা কিন্ত অন্য কোনো গবেষণায় আসেনি। এমনকি অনেকের চোখও এড়িয়ে গিয়েছিল বঙ্গবন্ধু ভূমিকা সম্পর্কিত জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বেশকিছু বিষয়।

আমি বিশেষ করে বলব ভাষা আন্দোলন যে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বেই সংগঠিত  হয়েছিল সেটা কিন্তু একেবারেই অস্বীকার করেছিলেন আমাদের দেশের  বেশ ক’জন বরেণ্য বুদ্ধিজীবী। ভাষা আন্দোলন নিয়ে যারা গবেষণা করেছেন, বই লিখেছেন এবং যাদের বই প্রচুর পঠিতও হয়েছে- তারা কিন্তু সুকৌশলে এবং অসাধুতার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর নাম বাদ দিয়েছেন। কিন্তু  গোয়েন্দা ডকুমেন্টসগুলো সামনে আসার পরে জাতি জানতে পেরেছে যে ভাষা আন্দোলনের পরিকল্পনা থেকে নেতৃত্ব দেওয়া পর্যন্ত প্রতিটি স্তরে বঙ্গবন্ধুই ছিলেন মূল ব্যক্তি। তিনি জেল খেটেছেন, জেলের ভেতর থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন ভাষা আন্দোলনের। আমি মনে করি, মুজিব শতবর্ষে এটা খুব বড় একটা প্রাপ্তি। এর জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমাদের ঋণ কখনোই শোধ হওয়ার নয়। 

এই সময়ে আমরা বঙ্গবন্ধুর অসামান্য তিনটি বইও পেয়েছি। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ আগেই প্রকাশিত হয়েছিল। কিন্তু এই সময়ে ‘আমার দেখা নয়াচীন’ ও ‘কারাগারের রোজনামচা’ বই দুটি প্রকাশিত হয়েছে। এবারের বইমেলায় বাংলা একাডেমি বঙ্গবন্ধুর রচনাবলী প্রকাশ করেছে। অমর একুশে বইমেলায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এটির মোড়ক উন্মোচন করেছেন। এ গ্রন্থ তিনটির প্রকাশের পেছনেও রয়েছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অক্লান্ত শ্রম ও নিষ্ঠা।

অপ্রাপ্তি প্রসঙ্গে এবার বলি। আমরা যে বলি ‘বঙ্গবন্ধু সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি’ এটা কিন্তু এমনি এমনি বলি না; একেবারে তথ্যপ্রমাণ ঘেঁটে আমরা বলি। তাঁর মাপের নেতৃত্ব বাংলাদেশ কখনো পায়নি। বঙ্গবন্ধুর এই যে বিশালতা, যে বিশাল চরিত্র নিয়ে তিনি ইতিহাসে দণ্ডায়মান, সেই মানুষটির কিন্তু একটি বড় ভাস্কর্য হওয়া প্রয়োজন ছিল- যেমনটি আমাদের জাতীয় স্মৃতিসৌধ। স্মৃতিসৌধের সামনে দাঁড়ালে- তার আশেপাশের খোলা জায়গা দেখলে আমাদের মন অন্যরকম হয়ে যায়, আমরা আমাদের শহিদদের আত্মত্যাগের মাহাত্ম্য অনুভব করতে পারি। আমাদের সংসদ ভবন- লুই কান যেটি করেছেন সেটির সামনে দাঁড়ালে কিংবা তার চারপাশের বিশালতা যখন আমরা দেখি আমাদের মনের মধ্যে কিন্তু একটা অন্যরকম অনুভূতি তৈরি হয়। সেরকম কিছু আমরা বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষে করতে পারিনি। আমার মনে হয়, এটা আমাদের একটা বড় অপ্রাপ্তি। 

বঙ্গবন্ধুর একটা খুব ভালো মানের ভাস্কর্য হওয়া প্রয়োজন। দেশের বিভিন্ন জায়গায় অনেকগুলো ছোটখাটো ভাস্কর্য রয়েছে। এগুলো ঠিক বঙ্গবন্ধুকে প্রতিনিধিত্ব করে না। বঙ্গবন্ধুর বিশালতা এসব ভাস্কর্যের মধ্যে আমি খুঁজে পাই না। বরং এই ভাস্কর্যগুলো আমার মনে হয় যে আমাদের ব্যথিত করে, চোখ পীড়িত করে। জাতীয় পর্যায়ে বঙ্গবন্ধুর একটা ভাস্কর্য হওয়া প্রয়োজন বিশাল জায়গা নিয়ে, মানুষ এখানে জাতির পিতাকে শ্রদ্ধা জানাতে আসবে। বঙ্গবন্ধুকে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর আছে। এটা বাঙালির তীর্থস্থান, বাঙালির আরেকটা তীর্থভূমি টুঙ্গিপাড়া। বাঙালি সেখানে যায়, সেখানে যাবে শত শত বছর ধরে এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্ত একটি জাতীয় ভাস্কর্য অবশ্যই দরকার। এটির ঘাটতি রয়েছে। 

দ্বিতীয় অপ্রাপ্তিটা হলো বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে খুব ভালো মানের একটি সিনেমা আমরা নির্মাণ করতে পারিনি। অনেকদিন থেকেই শুনছিলাম বঙ্গবন্ধুর জীবনভিত্তিক একটি ছবি হবে। সেজন্য অনেক কাজও হয়েছে। মুজিব শতবর্ষ এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী চলে গেছে কিন্তু সেই ছবিটি এখনো অবমুক্ত হয়নি এবং আমরা জানি না সেই ছবিটি আমাদের প্রত্যাশা কতখানি পূরণ করতে পারবে। গোটা জাতি যে বঙ্গবন্ধুর জীবনভিত্তিক বিশ্বমানের একটি ছবি দেখতে চায় সেটার জন্য আমরা অপেক্ষায় আছি। 
একজন সামান্য লেখক হিসেবে আমার একটা কষ্ট, পঁচাত্তরের নারকীয় হত্যাযজ্ঞ নিয়ে আমরা একটি ‘বিষাদ সিন্ধু’ রচনা করতে পারিনি আজও। আমি সাহিত্যের ছাত্র। শিল্পগুণ বিচারে আমি বলবো না যে মীর মশাররফ হোসেনের ‘বিষাদ সিন্ধু’ খুব বড় মাপের সাহিত্য। কিন্তু এটি আমাদের হৃদয়ে পাকাপোক্ত জায়গা করে নিয়েছে। আমাদের মায়েরা পড়েছেন, তার আগের প্রজন্ম পড়েছেন, আমরাও পড়েছি। সেটি সত্যি সত্যি আমাদের বিষাদগ্রস্ত করে তোলে। আমার অতৃপ্তি হলো, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে সেরকম একটি মহাকাব্যিক উপন্যাস আজও আমরা লিখতে পারিনি। হয়তো আগামী দিনে এই কাজটি হবে।

এবার আমি একটু অন্য প্রসঙ্গে যাই। কয়েকমাস আগে আমি কলকাতা গিয়েছিলাম চোখের চিকিৎসার জন্য। সেখানে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে নেতাজী সুভাষ বসুর বছরব্যাপী প্রদর্শনী হচ্ছিল। কী চমৎকার একটি প্রদর্শনী! মাল্টিমিডিয়ার দক্ষ ব্যবহারের মাধ্যমে নেতাজী সুভাষ বসুর গোটা জীবন এমনভাবে চিত্রিত করা হয়েছে যা শিশুকিশোরদেরও বোধগম্য হবে। আমি যে ভাস্কর্যের কথা বলছি সেখানে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে একটি আলাদা মিউজিয়াম হতে পারে, যেখানে শিক্ষার্থীরা যাবে এবং প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বঙ্গবন্ধুকে জানতে পারবে। সেখানে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বছরব্যাপী প্রদর্শনী চলতে পারে। 

আরেকটা গুরুতর ঘাটতি আমাদের রয়ে গেছে। সেটি হলো, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বড় মাপের গবেষণা হয়নি। বঙ্গবন্ধুর জীবন ও দর্শন নিয়ে গবেষণা হওয়া দরকার। বিশেষ করে বঙ্গবন্ধুর দর্শনভিত্তিক গবেষণার ক্ষেত্রে আমাদের দীনতা এককথায় অমার্জনীয়। এখানে বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পরে ঘাতকরা তাঁর বাকশাল তথা দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচিকে অব্যাহতভাবে আক্রমণ করেছে। বঙ্গবন্ধু এক দলীয় শাসন ব্যবস্থা চালু করেছেন, গণতন্ত্র নস্যাৎ করেছেন। মত প্রকাশের স্বাধীনতা হরণ করেছে এমন অনেক ভিত্তিহীন অপপ্রচার তারা করেছে দিনের পর দিন। কিন্তু এই অপপ্রচারগুলোর যথাযথ উত্তর দেয়ার জন্য যে গবেষণাটা দরকার ছিল তা কিন্তু হয়নি। যে-মানুষটি সারা জীবন গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করেছেন, গণতন্ত্রের সাধনা করেছেন, এমনকি জেলখানার ভেতরেও আইন মেনে চলেছেন, সেই মানুষটি কেন দ্বিতীয় বিপ্লবের পথে হাঁটলেন? তিনি তো এমনিতেই যতদিন ইচ্ছা ক্ষমতায় থাকতে পারতেন। কেননা নির্বাচনে তাঁকে পরাজিত করার মতো দল বা নেতৃত্ব তৎকালীন বাংলাদেশে ছিল না। তার পরেও কেন তিনি ঝুঁকিপূর্ণ পথে পা বাড়ালেন? তিনি কেন বললেন যে আমি প্রশাসন সংস্কার করব, আমি ভূমি ব্যবস্থার সংস্কার করব, আমি উৎপাদন ব্যবস্থার সংস্কার করব, বিচারব্যবস্থা সংস্কার করব। একইসঙ্গে তিনি সংস্কারের কর্মসূচিও ঘোষণা করলেন। তিনি বললেন, আমার প্রশাসনকে একেবারে তৃণমূল পর্যন্ত নিয়ে যাব, জনগণের ক্ষমতা জনগণকেই ফিরিয়ে দেব- কী ভয়ঙ্কর কথা!

আপনি যখন ভূমিব্যবস্থায় হাত দিবেন ,আপনি যখন প্রশাসনে হাত দিবেন, আপনি যখন উৎপাদন ব্যবস্থায় হাত দিবেন- তারা কি বসে থাকবে? এ সবে তো ঝুঁকি রয়েছে, তাই না? সেখানে যারা বসে আছেন, সেখান থেকে যারা বেনিফিট পাচ্ছে তারা তো এটাকে সহজে নেবে না। এসব জেনেও কেন তিনি দ্বিতীয় বিপ্লবের পথে পা বাড়ালেন? এটা নিয়ে ভালো মানের একাধিক গবেষণা হওয়া দরকার ছিল। কিন্তু দুঃখের সঙ্গে আমি বলি, আমাদের দেশে অনেকগুলো ইউনিভার্সিটি রয়েছে। তারা সকলেই বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষে অনেক কর্মসূচি নিয়েছেন। কিন্তু কোনো ভালো গবেষণা অন্তত আমার চোখে পড়েনি। আমি মনে করি, বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লব নিয়ে ভালো মানের গবেষণা হওয়া দরকার যে কেন তিনি এ কাজটি করেছিলেন।

আরেকটি গবেষণা হওয়া দরকার যে কারা বঙ্গবন্ধু হত্যার পটভূমি রচনা করেছিলো? আমরা বলি বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হয়েছে। ঘাতকদের শনাক্ত করা হয়েছে। কিন্তু বিচার তো হয়েছে তাদের যারা ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে গিয়ে বন্দুকের ট্রিগার টিপেছিল। যারা শেখ ফজলুল হক মণির বাসায় গিয়ে গুলি করেছিল। কিন্তু যারা কলকাঠি নেড়েছিল, যারা এর মাস্টারমাইন্ড, যারা পরিকল্পনা করেছিল তাদের তো আমরা কোনো সন্ধান অদ্যাবধি পাইনি। আমার মনে হয়, এটা আমাদের একটা বড় ব্যর্থতা। আমরা মাস্টারমাইন্ডদের চিহ্নিত করতে পারিনি। এই যে একটা সুযোগ আমাদের চলে গেল তা কি সহজে আর পূরণ হবে? জন্মশতবর্ষে বঙ্গবন্ধুর নিজের হাতে গড়া দল ক্ষমতায় কিন্তু আমরা আজও নেপথ্য কুশীলবদের চিহ্নিত করতে পারিনি। আমি মনে করি, অনতিবিলম্বে একটি কমিশন গঠন করে এদের চিহ্নিত করা প্রয়োজন। তাদের চিহ্নিত করা প্রয়োজন এ কারণে যে ভবিষ্যত প্রজন্মকে যেন জানতে পারে বঙ্গবন্ধু হত্যার, শিশু হত্যার, নারী-হত্যার পটভূমি কারা রচনা করেছিল। কারা পরিকল্পনা করেছিল এটা সাক্ষী-প্রমাণসহ বের করা দরকার। যত দিন যাচ্ছে সাক্ষী-প্রমাণ কিন্তু বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। 

আরেকটা কাজ করা দরকার এই যে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর কতগুলো মধ্য পর্যায়ের কিছু সেনা কর্মকর্তা বঙ্গভবন দখল করে রাখল দিনের পর দিন, এই যে একুশ বছর তারা রাষ্ট্রক্ষমতা পরিচালনা করল, বিদেশে গেল, চাকরি নিল, সংসদে গেলো, নেতা হলো- এদের পেছনে কারা ছিল? কারা এই একুশ বছর খুনিদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিলো? তাদের তো নিজেদের পায়ের তলায় মাটি ছিল না; তারা তো বঙ্গভবনে আবদ্ধ ছিলো কিন্তু সমাজের ভেতর থেকে কারা তাদের সহায়তা করলো? রাষ্ট্রের ভেতর থেকে কারা তাদের প্রশ্রয় দিলো? দীর্ঘ ২১ বছর কারা সমর্থন দিয়ে গেল এই ঘৃণ্য ঘাতক চক্রটিকে? কমিশনের কাজ হবে আমাদের বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে কারা ছিল, আমাদের শিক্ষকদের মধ্যে কারা ছিল, আমাদের সাংবাদিকদের মধ্যে কারা ছিল- তাদের নামগুলো প্রমাণসহ তালিকাবদ্ধ করে একটা পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন প্রকাশ করা যাতে করে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তাদের চিনতে ও জানতে পারে।

বঙ্গবন্ধু হত্যার পর থেকে আমরা বলে আসছি যে আমরা ‘শোককে শক্তিতে পরিণত করতে চাই’। শোককে শক্তিতে পরিণত করার একমাত্র উপায় হলো বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে ধারণ, গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা। বঙ্গবন্ধু যে দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি দিয়ে গেছেন, সেটি ছিল তাঁর সারাজীবনের স্বপ্ন। তিনি ৭ মার্চের ভাষণে বলেছেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। তিনি কিন্তু মুক্তির কথা আগে বলেছেন, স্বাধীনতার কথা পরে বলেছেন। কার মুক্তি? বাংলার দরিদ্র জন্মদুঃখী মানুষের মুক্তি। তিনি তাদের মুখে হাসি ফোটাতে চেয়েছেন। বিপ্লবের কর্মসূচি ঘোষণার সময় তিনি বারবার বলেছেন, যেভাবে রাষ্ট্র চলছে এভাবে দেশের দরিদ্র ও শোষিত-বঞ্চিত মানুষের উন্নয়ন সম্ভব নয়। তাই তিনি ‘সিস্টেম’ ভেঙে ফেলতে চেয়েছেন, পরিবর্তন করতে চেয়েছেন। যেই ব্যবস্থা বাংলার গরিব মানুষকে শত শত বছরের দুঃখ-দারিদ্র্য ও বঞ্চনা থেকে মুক্তি দিতে পারবে সেই ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমেই বঙ্গবন্ধুর প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন সম্ভব বলে আমি মনে করি।

মিনার মনসুর: কবি ও প্রাবন্ধিক। পরিচালক, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র
 

তারা//


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়