ঢাকা     সোমবার   ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ||  আশ্বিন ১০ ১৪৩০

বছরভর তাপমাত্রা যখন সঙ্গী হতে যাচ্ছে

হাবিব রহমান  || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৮:০৪, ৭ জুন ২০২৩  
বছরভর তাপমাত্রা যখন সঙ্গী হতে যাচ্ছে

এক ফোঁটা বৃষ্টি না হলেও চলবে, খালি পুরোটা আকাশ থাকুক মেঘাচ্ছন্ন। প্রকৃতি যেন একটু সদয় হয়। গেল ক’দিন ধরেই এমনটা চাওয়া দিনাজপুরবাসীর। ১৯৫৮ সালের পর রেকর্ড ভেঙ্গে তাপমাত্রা এখন ৪১.১ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছুঁয়েছে, যদিও এরচেয়ে বেশিই গরম অনুভূত হচ্ছে। ভয়াবহ এই তাপে রীতিমতো ওষ্ঠাগত মানুষের জীবন। বৃষ্টিরও দেখা নেই। দিনাজপুরবাসীর সাথেই কেবল আবহাওয়ার এই বৈরিতা নয়, রাজশাহী, পাবনা অঞ্চলেও রীতিমতো পুড়ছে তীব্র তাপদাহে। বাদ নেই রাজধানীও।

রাজধানীসহ সারাদেশে গড় তাপমাত্রা প্রায় ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। স্বাভাবিক তাপমাত্রা থাকার কথা ৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আবহাওয়ার এই বৈরী আচরণ মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে। গেল এক যুগের হিসাব করলে দেখা যায় প্রতি বছরই বেড়েছে তাপমাত্রা। এই যেমন ২০১৪ সালে যে গরমের তীব্রতা দেখেছে রাজধানীবাসী, এ মাসে গড় তাপমাত্রা ৩৭.৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস উঠলে সেটি হয়েছে ৯ বছরের মধ্যে সবোর্চ্চ। 

এর পেছনে যুক্তিও অবশ্য দিচ্ছে আবহাওয়া অফিস, দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে মৌসুমী বায়ু প্রবাহিত হওয়ার কথা থাকলেও তা হচ্ছে না। মৌসুমী বায়ুর লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না। এ কারণে তাপমাত্রা বেশি অনুভূত হচ্ছে। দক্ষিণ দিকের মৌসুমী বাতাস প্রবাহিত না হওয়ার কারণে বৃষ্টির দেখা নেই।

এখন আর একমাস দু’মাস নয়, দেশের গরমের কাল বা মাসের সময় দীর্ঘ হচ্ছে। আগে মার্চ, এপ্রিল সর্বোচ্চ মে মাস পর্যন্ত তাপদাহ থাকতো। কিন্তু গেল ১২ বছর ধরে এই গরমের চিত্র বদলে গেছে। তাপদাহ বা গরম থাকে অক্টোবর পর্যন্ত। শুধু গরম কালই নয়, তাপদাহের সময়ও দীর্ঘ হচ্ছে। আগে তিন থেকে চার দিন সর্বোচ্চ একটানা তীব্র গরম অনূভূত হতো কিন্তু এখন সেটি এক সপ্তাহ কোনো কোনো ক্ষেত্রে ১৫ দিন পর্যন্তও হচ্ছে। এ ছাড়া এ বছরই পরপর দু’মাসে টানা দুটি তাপদাহ সৃষ্টি হয়েছে বলে জানায় আবহাওয়াবিদরা। প্রথমটি হয়েছে এপ্রিলের শেষ দিক থেকে শুরু করে ঘূর্নিঝড় মোখা সৃষ্টি হওয়ার আগ পর্যন্ত। দ্বিতীয়টি মে মাসের ২৮ তারিখ থেকে শুরু হয়েছে এখনও তা চলছে। আবহাওয়া অফিস বলছে, এই তাপদাহ চলবে আরো ৭ দিন। আবহাওয়ার এই বৈরী আচরণকে জলবায়ুর পরিবর্তনকেই দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। 

বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে তাপমাত্রা বেড়ে গেছে। গেল ১০০ বছরে বিশ্বের তামমাত্রা বেড়েছে দশমিক ৭ থেকে দশমিক ৮ ডিগ্রী সেলসিয়াস। এর সাথে পাল্লা দিয়ে রাজধানী ঢাকার গড় তাপমাত্রা বেড়েছে ৩ থেকে ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। প্রতি বছরই এমন তীব্র তাপদাহ সৃষ্টি হবে। এমন তাপদাহ নিয়েই এখন চলতে হবে। এ বছর হয়তো তাপদাহ দুবার হয়েছে আগামী বছর হয়তো আরো বেশি হতে পারে।

দিনাজপুরে জুনে সর্বচ্চো ৪১.১ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। যা স্বাভাবিকের চেয়ে প্রায় ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি। গড়ে সারা দেশে তাপমাত্রা বেশি থাকছে ৭ থেকে ১০ ডিগ্রির মতো। আর বাতাসে জলীয়বাষ্প কম থাকায় স্বাভাবিকের চেয়েও ৫ থেকে ৭ ডিগ্রির মত তাপমাত্রা বেশি অনুভূত হচ্ছে।  

তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার আরেকটি কারণ বৃষ্টির পরিমাণ কমে যাওয়া। ২০২৩ সালে এপ্রিল মাসে বৃষ্টিপাত ২০২২ সালের তুলনায় অনেক কম হয়েছে। গত বছরের তুলনায় এবার বৃষ্টিপাত কম হয়েছে ৬৬ শতাংশ। ২০২৩ সালে মে মাসে বৃষ্টিপাত কম হয়েছে প্রায় ৪৪.১ শতাংশ। সাগরে মৌসুমী বায়ুর প্রভাব কম। বৃষ্টি কম হওয়ার কারণে গরম বেশি অনুভূত হচ্ছে। সাগরের যে অবস্থা তাতে খুব সহজেই বৃষ্টিপাত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। আরো এক সপ্তাহ এমন তীব্র তাপদাহ চলবে সারাদেশে। তবে দু’তিন দিনের মধ্যে চট্টগ্রাম টেকনাফ অঞ্চলে বৃষ্টিপাত হলে এখানে কিছুটা তাপমাত্রা কমবে। এছাড়া সারাদেশে হালকা বৃষ্টিপাত হলেও তাতে তাপ কমার সম্ভাবনা নেই।

রাজধানীর সাথে অন্যান্য জেলার তাপমাত্রার পার্থক্যও থাকে ৩ থেকে ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস কম। রাজধানীতে এমন কিছু গ্যাস উৎপাদন হচ্ছে যা শহর উত্তপ্ত করছে। মিথেন, ব্ল্যাক কার্বন, কার্বন-ডাই-অক্সসাইড, নাইট্রজেনসহ নানা গ্যাসের নির্গমন বেড়েছে। এর মধ্যে মিথেন গ্যাস দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশ্বের দশটি শহরের মধ্যে মিথেন গ্যাসের নির্গমন বৃদ্ধির গতি বাংলাদেশের অবস্থান এখন দ্বিতীয়। বর্জ্য, সুয়ারেজ লাইন, গ্যাস লাইন, আর যানবাহন থেকে বিপুল পরিমাণ মিথেন উৎপাদন হচ্ছে। যা শহরের তাপমাত্রা বাড়িয়ে দিচ্ছে। এছাড়া ব্ল্যাক কার্বনও তাপমাত্রা বাড়াতে সাহায্য করছে।  

রাজধানীর যানজটও তাপকে বাড়াতে সাহায্য করছে। দীর্ঘক্ষণ যানজটে আটকে থাকা পরিবহণের চালিত এসি থেকে যে গ্যাস নির্গত হয় তা ঐ এলাকাটিকে উত্তপ্ত করে তোলে। গাড়ির এসি থেকে নির্গত সিএফসি গ্যাস বায়ুমণ্ডল উত্তপ্ত করতে সাহায্য করছে। এছাড়া এবার দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে মৌসুমী বায়ু বাংলাদেশের দিকে কম প্রবাহিত হয়েছে। উত্তর-পূর্ব দিক থেকে কিছু বাতাস প্রবাহিত হয়েছে। যার ফলে বাতাসে জলীয়বাষ্প কম সৃষ্টি হয়েছে। সব মিলিয়ে গরমের তীব্রতা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে।

শুধু তাই নয়, দিন এবং রাতের তাপমাত্রার পার্থক্যও কমে গেছে। রাতে এখন তাপমাত্রা থাকে গড়ে ৩০ থেকে ৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। কিন্তু স্বাভাবিক তাপমাত্রা থাকার কথা ছিলো ২৫ থেকে ২৬ ডিগ্রি সেলসিযাস। গড়ে পাঁচ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বেশি থাকে রাতের বেলাতেই। যেহেতু রাত আর দিনের পার্থক্য অনেক কম তাই রাতের সময়টাতেও ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে মানুষকে। বাতাসে জলীয়বাষ্প কম থাকার কারণে রাতের বেলা গরমটা অসহ্য হয়ে উঠছে। 

গরমের সময়কাল বেড়ে গেলেও শীতের সময় কমে যাচ্ছে। এখন ডিসেম্বর আর জানুয়ারী মাসেই শীতের দেখা মিলে। শীতের চরিত্রটাও ঠিক গরমের মতই। যখন শীত পড়ে সেটা তীব্র আকার ধারণ করছে। বাংলাদেশের ছয় ঋতুর যে ঐতিহ্য তা এখন আর দেখা যাচ্ছে না। জলবায়ু পরিবর্তন, আবহাওয়ার বৈরী আচরন, পরিবেশ ধ্বংসের কারণেই এসব পরিবর্তন লক্ষণ করা যাচ্ছে।  

রাজধানীসহ সারা দেশে তীব্র তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাওযার কারণ গাছাপালা ধ্বংস হওয়া। নদ-নদী, জলাশয়, জলাভূমি, পুকুর ভরাট হয়ে যাওয়া। কারণ সূর্যের তাপ শোষন করার উৎস হলো গাছ, নদী, নালা, খাল বিল আর জলাশয়। কিন্তু রাজধানীতে সবুজের অস্তিত্ব হারিয়েছে অনেক আগেই। ১৯৯৫ সালে রাজধানীতে সবুজ গাছপালা ছিল ১৯.৭৮ বর্গ কিলোমিটার। বিশাল এই সবুজ গাছে পরিমাণ ২০২৩ সালে আছে মাত্র ১০.৪২ বর্গ কিলোমিটার। বর্তমানে আছে ৭.০৯ শতাংশ। ফাঁকা জায়গা ছিল ১৯৯৫ সালে ২৮.৫ বর্গ কিলোমিটার ২০২৩ সালে ১৭.৯৮ বর্গ কিলোমিটার। বর্তমানে ফাঁকা জায়গার পরিমান ১২.২৩ শতাংশ। জলাধার আর জলাভূমি ভরাট হয়েছে আরো বেশি। ১৯৯৫ সালে জলাধার আর জলাভূমি ছিল ৩০.২৫ বর্গ কিলোমিটার। দখল দূষণ আর ভরাট হয়ে জলাশয় আর জলাভূমি আছে মাত্র ২.৯১ শতাংশ।

সূর্য থেকে বিকরণ হওয়া তাপ গাছপালা খাল, বিল দীর্ঘ সময় ধরে রাখে। কিন্তু এখন রাজধানীতে শুধুই কংক্রিট। ইটপাথরের তাপ ধারণ ক্ষমতা কম। দ্রুতই তাপ ছেড়ে দেয়। তাই পুরো রাজধানীতেই তাপমাত্রা বেড়ে চলেছে। 

রাজধানীর তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার আরেকটি বড় কারণ পুকুরগুলো ভরাট ও দখল হয়ে যাওয়া। রিভার এন্ড ডেলটা রির্সাস সেন্টারের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ বলেন, ব্রিটিশ টপোগ্রাফিক সার্ভে অনুযায়ী ১৯২৪ সালে আদি ঢাকা শাহবাগ থেকে চর কামরাঙ্গী পর্যন্ত ১২০টি পুকুর ছিল। ১০০ বছরে ৯৬টি পুকুর হারিয়ে গেছে। পুরো ঢাকা সিটিতে এখনও ২৪১টি পুকুরের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। যার ৯০ ভাগ পুকুরই রাজনৈতিক প্রভাব, ভূমিদস্যুদের দখলে। রাজধানীর তাপমাত্রা কমাতে হলে পুকুরগুলো উদ্ধার করার বিকল্প নেই।

উন্নয়নের নামে রাজধানীতে অপরিকল্পিতভাবে গাছ কেটে উজার করা হচ্ছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের গবেষণা প্রমাণ করেছে, যেসব এলাকায় গাছ আছে সেখানা তাপমাত্রা কম থাকে। উদাহরণ হিসাবে রাজধানীর বোটানিক্যাল গার্ডেনে তাপমাত্রা মেপে দেখা গেছে অন্যান্য এলাকার চেয়ে ৩ থেকে ৪ ডিগ্রি তাপমাত্রা কম। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেও তাপমাত্রা কম থাকছে। নগর উন্নয়নের নামে রাজধানীতে গড়ে উঠছে উঁচু অট্টালিকা। কাচের ভবনের সংখ্যাও বাড়ছে। কাচের এসব ভবন তাপমাত্রা বাড়াতে বড় ধরনেরও ভূমিকা রাখছে। দেশে এসি ব্যবহারে হারও বেড়েছে। গরম থেকে বাঁচতে যত্রতত্রভাবে লাগানো হচ্ছে এসি। এসি থেকে নির্গত সিএফসি গ্যাস তাপমাত্রা তুলছে। আর ঘনবসতি শহর হওয়ার কারণেই তামমাত্রা শহনীয় পর্যায়ে থাকছে না।

একটি শহরে কত মানুষ থাকবে, কতগুলো ব্যক্তিগত গাড়ি চলবে, গণপরিবহণের সংখ্যাই বা কত হবে তার কোন হিসাব নেই কারো কাছে। মানুষের চাহিদা মেটাতে অপরিকল্পিতভাবে করা হচ্ছে উন্নয়ন। যার ফলশ্রুতিতে দিনকে দিন রাজধানীর তাপমাত্রা বেড়েই চলেছে। বসবাসেরও অযোগ্য হওয়ার পথে রুপ নিচ্ছে এই শহর। তাপদাহের এই ক্ষিপ্ততা থেকে কেবল শহরবাসীকে নয় পুরো দেশ বাঁচাতে হলে সম্বন্বিত পরিকল্পনা এখন সময়ের দাবি।

লেখক: সিনিয়র রিপোর্টার, একাত্তর টিভি

তারা//

সম্পর্কিত বিষয়:

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়