ঢাকা     রোববার   ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  অগ্রহায়ণ ৩০ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

হাদিকে গুলি করা হয়েছে নির্বাচনী ট্রেন থামিয়ে দিতে

জব্বার আল নাঈম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:১৪, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫   আপডেট: ১৭:৪৪, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫
হাদিকে গুলি করা হয়েছে নির্বাচনী ট্রেন থামিয়ে দিতে

বাংলাদেশে রাজনৈতিক সহিংসতাগুলো এমনভাবে ঘটে যা দেখতে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে সকল শ্রেণি পেশার মানুষ। এখানে ঘাতকের গুলি মস্তক ভেদ করে, এরপর বিবৃতি আসে, প্রশাসন তদন্তের আশ্বাস দেয়—আবার সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ঘটনাটি ঝাপসা হয়ে যায়, আহত, নিহত হওয়া ব্যক্তির মতো ঘাতকের নামও একসময় মানুষ ভুলে যায়। কিন্তু কিছু হামলা থাকে, যেগুলোকে চেনা ছকে ফেলা মুশকিল। ইনকিলাব মঞ্চ ও ঢাকা ৮ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী শরিফ ওসমান হাদির ওপর হামলাটি তেমনই একটি ঘটনা। এটি কেবল একজন মানুষের শরীরে ঢুকে পড়া গুলি নয়; এটি সময় কাঁপিয়ে দেওয়া রাজনৈতিক অশুভ সংকেত। 

হাদির ওপর ঘটে যাওয়া নারকীয় হামলা বুঝতে হলে অনুধাবন করতে হবে সময়। ১২ ডিসেম্বর ২০২৫ অর্থাৎ তফসিল ঘোষণার পরদিন। ফেব্রুয়ারি ২০২৬-এর নির্বাচন সামনে রেখে দেশের গণতন্ত্রমনা ও নির্বাচনমুখী মানুষ যখন আনন্দে ভাসছিল, ঠিক তখনই হাদিকে হত্যার উদ্দেশে গুলির মতো অস্বস্তিকর মুহূর্তটি দেখতে হলো সমগ্র জাতিকে! রাজধানীর বিজয়নগর এলাকায়, প্রকাশ্যে দিবালোকে জুমার নামাজের পরপর, রিকশায় থাকা হাদিকে মোটরসাইকেল আরোহী গুলি করে। এতে লুকোচুরি ছিল না, কৌশল ছিল না। বরং ছিল প্রকাশ্য হুঁশিয়ার বা হুঙ্কার! আমরা পারি টাইপ কিছু একটা! এই ‘পারা’র রাজনীতি ভয়ঙ্কর, এখানে ব্যক্তির স্বার্থের চেয়ে দল বা আদর্শের স্বার্থ বেশি জড়িত। এটা করলে রাষ্ট্রের অস্তিত্ব প্রশ্নের মুখে পড়ে। মানুষ ভাবে, প্রকাশ্যে এমন কিছু হলে অপ্রকাশ্যে না জানি ভয়ঙ্কর কত কিছু ঘটছে—এর জন্য দায়ী রাষ্ট্রযন্ত্র!

প্রশ্ন আসাটা স্বাভাবিক—বার্তাটা কাকে উদ্দেশ্য করে? হাদিকে? না, উত্তরটা এতটা সরল নয়। হাদি এখানে প্রতীক। তিনি এমন একজন, যিনি বড় কোনো রাজনৈতিক দলের সরাসরি ছত্রছায়ায় নেই, আবার রাজনীতির বাইরে থেকেও কথা বলেন না। ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র হিসেবে হাদি পরিচিত। বাংলাদেশের রাজনীতিতে একা বা স্বতন্ত্র হওয়া অনেকটা রোমান্টিসিজমের মতো, দূর থেকে প্রীতি দেখালেও কাছে এসে স্নেহ দেখায় না। বাস্তবতা হলো এটি ভীষণ ঝুঁকিপূর্ণ। বড় দল মানে আদর্শ, কাঠামো, নিরাপত্তা, কিংবা প্রতিপক্ষকে পাল্টা চ্যালেঞ্জ দেয়ার সক্ষমতা। এর ব্যত্যয় মানে অনিরাপদ। হাদির ক্ষেত্রে অনিরাপদ স্বাধীনতাই তাকে সহজ লক্ষ্য বানিয়েছে, ফলশ্রুতিতে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছে হাদি।

হাদি স্পষ্ট ভাষায় জোরে কথা বলেন। তার ভাষা তীক্ষ্ণ, কিন্তু তাকে অস্বীকার করা যায় না—তাকে শোনা হতো। পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনা হতো। রাজনীতিতে এই শোনাটাই বিপজ্জনক। কারণ যে কণ্ঠ শোনা যায়, তাকে থামাতে পারলে অনেক কণ্ঠ আপনাতেই চুপ হয়ে যায়, এটা ভয় ও হুমকির রাজনীতি, হুমকির সংস্কৃতি! এতে হামলার প্রকৃত উদ্দেশ্য স্পষ্ট হয়। এটি একজন মানুষকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা নয় শুধু, ভয়ঙ্কর পরিবেশ তৈরির চেষ্টা। ভয় তৈরি করার চেষ্টা। নির্বাচনের আগে ভয় সবচেয়ে কার্যকর অস্ত্র। ভয় মানুষকে ঘরে ঢুকিয়ে দেয়, কণ্ঠ নরম করে দেয়, প্রশ্নকে সংক্ষিপ্ত করে।  নির্বাচনের মাঠে ভয় থাকলে গণতন্ত্র দুর্বল হয়ে পড়বে, এটাই পরিকল্পনাকারীদের উদ্দেশ্য।

২.
এখানে রাষ্ট্রের ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ৫ আগস্ট ২০২৪-এর পর অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার সময় মানুষের প্রত্যাশা ছিল আকাশচুম্বী—এবার অন্তত রাষ্ট্র শক্ত ভীত পাবে অথবা তৈরি হবে। প্রতিশোধের রাজনীতি থামবে, সহিংসতার জায়গা সংকুচিত হবে, মানুষ প্রকাশ্যে কথা বলার ন্যূনতম নিরাপত্তা পাবে। কিন্তু এক বছরের বেশি সময় পেরিয়ে গেলে সেই প্রত্যাশা পূরণ হয়নি বরং মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির (এইচআরএসএস) তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের ১০ মাসে অন্তত ৭৫৬টি রাজনৈতিক সংঘাতের ঘটনা ঘটেছে। ১১৭ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন অন্তত ৬ হাজার ৯২ জন! 

অথচ রাষ্ট্র বারবার বলছে, আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে! কিন্তু নিয়ন্ত্রণ আর নিশ্চয়তার মধ্যে বিশাল ফারাক, তফসিল ঘোষণার পরদিন দিনের আলোয় গুলি চলে সেই ফারাকটাকেই দৃশ্যমান করেছে। তদন্তের নির্দেশ, গ্রেপ্তারের আশ্বাস—এসব প্রয়োজনীয়, কিন্তু এগুলো সংকটের গভীরতায় পৌঁছায় না।

এই হামলাকে আরও বড় রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে দেখতে ও ভাবতে হবে। বাংলাদেশ এখন দুই বিপরীত রাজনৈতিক আবেগের মাঝখানে দাঁড়িয়ে। একদিকে আছে আওয়ামী লীগ-বিরোধী শক্তির প্রতিশোধের মনোভাব, অন্যদিকে আছে আওয়ামী লীগপন্থীদের রাজনীতিতে ফেরার তীব্র আকুতি। এই দুই স্রোতের সংঘাতে রাষ্ট্রের কাজ ছিল একটি শক্ত মাঝামাঝি জায়গা তৈরি। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে, অনেক সময় রাষ্ট্র আবেগের পেছনে হেঁটেছে, ছুটেছে কিন্তু পরিস্থিতিকে আগেভাগে সামাল দেওয়ার চেষ্টা করেনি।

এই মুহূর্তে হাদির শারীরিক অবস্থার প্রশ্নটি যেমন মানবিক, তেমনি রাজনৈতিকও। বেঁচে ফিরলে হয়তো উত্তেজনার লাগাম কিছুটা টানা সম্ভব। ব্যতিক্রম কিছু ঘটলে সেই ক্ষতি শুধু একটি পরিবারের বা একটি প্ল্যাটফর্মের থাকবে না। দেশের রাজনৈতিক পরিসর আরও অস্থিতিশীল করে তুলবে এবং গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়কে প্রশ্নবিদ্ধ করবে।

এমতাবস্থায় সরকারের সামনে করণীয়গুলো আরও স্পষ্ট, সামনে অনাকাঙ্ক্ষিত আরও ঘটনা ঘটতে পারে, সেগুলো মোকাবেলা এবং প্রতিহত করা। চলমান ঘটনার তদন্তের নামে নাটক নয়, বরং স্বচ্ছ ও বিশ্বাসযোগ্যভাবে অগ্রগতি, নির্বাচনী মাঠে নিরাপত্তা কাগজে নয়, বাস্তবভিত্তিক হতে হবে, প্রয়োজনে পুলিশ ও সেনার সংখ্যা বাড়ানোর পাশাপাশি অন্য বাহিনীও যুক্ত করতে হবে। রাজনৈতিক শক্তিগুলোর সঙ্গে সক্রিয় যোগাযোগ, বৈঠক করে উত্তেজনা কমানোর বাস্তবসম্মত উদ্যোগ নিতে হবে। তবে সবচেয়ে জরুরি ও গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ‘নিরপেক্ষতা’ যা কেবল কাগজ-কলমে সীমিত থাকবে না, আচরণে প্রমাণ করতে হবে। এর কারণ অন্তর্বর্তী সরকার গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন দিতে অলরেডি ষোলোমাস সময় নিয়েছে, তারপরও যদি ব্যর্থ হয়, রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ ব্যর্থ হবে, একথা বলা যায় দ্ব্যর্থহীনভাবে। 

কিছুদিন পূর্বে চট্টগ্রাম-৮ আসনে (বোয়ালখালী–চান্দগাঁও) বিএনপি মনোনীত প্রার্থী এরশাদ উল্লাহকে গুলি, আবার তফসিল ঘোষণার পর স্বতন্ত্রপ্রার্থী শরীফ ওসমান হাদিকে লক্ষ্য করে গুলি— তাই প্রসঙ্গটা এখন আর এরশাদ বা হাদির দিকেই নয়, এই গুলি দুজনকে ভেদ করেই নির্বাচনের গায়ে বিদ্ধ হয়েছে! নির্বাচনের মগজ থেকে সার্জারির মাধ্যমে যদি গুলি বের করা না হয়, সংসদ দীর্ঘদিনের জন্য নীরবতাই পালন করবে। আবার যদি হাদির ঘটনাকে আরেকটি ‘দুঃখজনক ঘটনা’ বলে পাশ কাটানো হয়, তাহলে সামনে অন্ধকার নিশ্চিত, পাড়ি দিতে হবে অনেক দূরের পথ, সেটি আর কারও নিয়ন্ত্রণে থাকবে না। অনিয়ন্ত্রিত ও অনিশ্চিয়তা ঠেকিয়ে প্রমাণ করতে হবে; যা রাষ্ট্রের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ—বাংলাদেশ গুলির শব্দে নয়, আইনের শাসনে চলে, যে আইন ব্যবস্থা খুবই মজবুত।

লেখক: কবি ও কথাসাহিত্যিক

ঢাকা/তারা//

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়