ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

নবনীকে ঘিরে নাদিয়ার স্বপ্ন  

মিনহাজুল ইসলাম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:৫০, ১৪ অক্টোবর ২০২১  
নবনীকে ঘিরে নাদিয়ার স্বপ্ন  

জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের ‌‘নবনী’র নাম শোনেননি এমন সাহিত্যমনা খুব কমই পাওয়া যাবে আমাদের দেশে। কারণ এটি একটি জনপ্রিয় উপন্যাস, যা কিনা লেখা হয়েছিল ভালোবাসার প্রেক্ষাপট থেকে।নাদিয়া নায়লা নোশিনের ‌‌‌‌‘নবনী’ অনেকটা ভালোবাসার জায়গা থেকেই তৈরি হয়েছে। যেখানে নাদিয়া ঠিক করেছেন এমন সুন্দর একটি নাম দিয়ে তার বিজনেস প্ল্যাটফর্মকে সবার কাছে পরিচয় করিয়ে দেবেন। 

নবনী নামটি মিষ্টি এবং সহজেই বলা যায় বলে বইপড়ুয়া নাদিয়া এই নামটি বেছে নিয়েছেন। উপন্যাসে নবনী মারা গেলেও নাদিয়ার সৃষ্টিশীল কাজের মাধ্যমে নতুনরূপে বেঁচে থাকবে। বলছিলাম এমন একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর কথা, যিনি কিনা নারীশক্তির এক অনন্য দৃষ্টান্ত। ফেসবুক পেজ ‘Noboni-নবনী’র মাধ্যমে নিজের বানানো আকর্ষণীয় কাঠের গহনা বিক্রি করেন তিনি। এছাড়া ইনস্টাগ্রাম আইডি এবং ওয়েবসাইটও রয়েছে।

তার এই জার্নি শুরু হয়েছিল ২০১৯ সালে এসএসসি পরীক্ষার পর। পরীক্ষা শেষে লম্বা ছুটি। সেই সময়ে বাজার থেকে বিভিন্ন আকৃতির কাঠের ফ্রেম, মেটাল ও পুতি কিনে বানিয়েছিলেন কানের দুল, চুড়ি ও এক সেট মালা। সেই থেকে শুরু। তিনি এখন মালা, আংটি, কানের দুল, খোঁপার কাঁটা, আয়না, পায়েল, কাঠের বালা, সুতা দিয়ে নকশা করা চুড়ি, চাবির রিং, কপালের টিপ, চুলের ক্লিপ বানানোর পাশাপাশি শাড়ি, পাঞ্জাবিতে এবং স্মার্টফোনের ব্যাক কভারে সুন্দর ডিজাইন করে থাকেন, যা সবার কাছে অনেক প্রিয়।

নাদিয়ার বাবা বিআইডব্লিউটিএতে (বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ) কর্মরত এবং মা গৃহিণী। তার বেড়ে ওঠা যৌথ পরিবারে। মায়ের কাছ থেকে অনুপ্রেরণা এবং স্বাবলম্বী হওয়ার সাপোর্ট পান সবসময়। তাই তিনি সাধারণ থেকে অসাধারণ হয়েছেন। কোনো কাজকে কখনো ছোট না ভেবে গুরুত্বের সাথে করে যাওয়াকে সম্মানের সাথে গ্রহণ করেছেন। অনেকের কাছেই মনে হতে পারে এসব করার কি দরকার। মেয়েরা শুধু পড়াশুনা, খাওয়া-দাওয়া এবং বড় হলে রান্নাবান্না নিয়ে থাকবেন। তবে অল্প বয়সে এবং শিক্ষার্থী থাকা অবস্থায় যিনি কিছু করতে পারেন এবং বেশ ভালোভাবেই করতে পারেন, তার উজ্জল দৃষ্টান্ত তিনি।

নাদিয়া শুধু নিজ এলাকা থেকে নয়, অর্ডার পান সারা বাংলাদেশ থেকে। রেডিমেড গহনার পাশাপাশি কাস্টমাইজড গহনা বানিয়ে নেওয়া যায় বলে এক আস্থার নামও নবনী। তার সার্ভিস নিয়ে সবাই অনেক সন্তুষ্ট। কারণ বরাবরই কাস্টমার রিভিউ ভালো আসছে।

জীবনের টার্নিং পয়েন্ট কোনটি, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমার জীবনের টার্নিং পয়েন্ট বগুড়া সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়। কারণ পড়াশুনা, জনপ্রিয়তা, কো-কারিকুলার এক্টিভিটিসে অংশগ্রহণে সবচেয়ে বড় ভূমিকা ছিল এই প্রাণের স্কুলের। আমাকে দিয়েছে জীবনের সেরা মুহূর্ত।

সমালোচকদের উদ্দেশ্যে এক বাক্যে তিনি বলতে চান, সমালোচকদের তিনি ভালোবাসেন। কারণ তারা যদি সমালোচনা না করতেন তাহলে আরও ভালো কিছু করার তাগিদ অনুভব করতেন না। তাদের এই সমালোচনা বুঝিয়ে দেয় তিনি ঠিক পথে এগোচ্ছেন। নিন্দুকেরা বা সমালোচকরা একদিক থেকে অনুপ্রেরণা এবং সাহস দেয়।

ভবিষ্যতে নিজেকে কোথায় দেখতে চান? তিনি বলেন, ভবিষ্যতে মানুষের পাশে থাকতে চাই, বাবা-মায়ের আস্থার জায়গা হতে চাই। যেহেতু আমার কোনো ভাই নেই, আমি পরিবারের বড় মেয়ে। তাই আমি চাই পরিবারটাকে নিজে হ্যান্ডেল করবো। এমন পজিশনে থাকবো, যেন‌ বাবা-মায়ের মনে না হয় মেয়ে সন্তান জন্ম দিয়ে তারা কোনো ভুল করেছেন বা কোনো আফসোস যেন না থাকে।

নাদিয়া আরও বলেন, অনেক তাড়াতাড়ি রেগে যাই। অনেক বেশি শর্ট টেম্পারড। রেগে গিয়ে‌ সেটা মানুষের উপর প্রকাশ করতে পারি না ঠিকভাবে। দেখা যায়, অনেকের সাথে সম্পর্ক খারাপ হয়ে যায় বা সে সময়ে আমাকে ভুল‌ বুঝে বা আমি নিজেই কান্না করে ঘরবন্দি হয়ে যাই। একা লাগে খুব। তাই রাগ ‌কন্ট্রোল করাটা খুব দরকার। আগের চেয়ে অনেক কমেছে। তবে আরও কমানো‌ দরকার। কারণ, রাগ ভালো কাজকে ধ্বংস করে। অতীতে‌ যাওয়ার সুযোগ থাকলে অতিরিক্ত আবেগ মুছে দিতাম।

আজ‌‌ পর্যন্ত সবচেয়ে সুন্দর অভিজ্ঞতা কোনটি? তিনি বলেন, আমি আমার মায়ের সন্তান। আমি মায়ের গর্ভে জন্মিয়েছি এটা লাইফের সবচেয়ে বড় এচিভমেন্ট, সবচেয়ে বড় পাওয়া, সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। আমার মা না থাকলে হয়তো আমি এত বড় হতে পারতাম না। আমার মা আমার কাছে সবকিছু।

সফলতার সংজ্ঞা কী, জানতে চাইলে তিনি বলেন, একজন ভালো মানুষ হওয়া। অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানো, সহযোগিতা করা, আমার কাজের মাধ্যমে তারা যেন উপকৃত হন এটা আমার কাছে সফলতার সংজ্ঞা। বাবা-মায়ের স্বপ্ন আমার মাধ্যমে পূর্ণ হচ্ছে।

নাদিয়া নবনীতে সময় দেওয়ার পরেও গুছিয়েছেন নিজের পড়াশুনা। বগুড়া সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়াশুনা করেছেন। বর্তমানে সরকারি আজিজুল হক কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী। গার্লস গাইড, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের বইপড়া প্রতিযোগিতা, অন্যের হাতে মেহেদি রাঙানোসহ সৃজনশীল কাজে তিনি অংশগ্রহণ করেছেন। এতে রয়েছে তার অনেক অর্জন। 

২০১৭ সালে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের বইপড়া প্রতিযোগিতায় সবচেয়ে বেশি বই পড়ে পুরস্কার জিতেছেন। ২০১৭ ও ২০১৮ সালে জেলা-উপজেলায় শ্রেষ্ঠ গার্লস গাইড এবং ২০১৮ সালে রাজশাহী বিভাগের সেরা গার্লস গাইড নির্বাচিত হয়েছেন। একই বছর বাংলাদেশ গার্লস গাইড অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ শিল্প ও অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন তিনি। স্কুল নাট্যদলে অভিনয়ের পাশাপাশি বগুড়া থিয়েটার আয়োজিত স্কুল নাট্যোৎসবে নিয়মিত অংশ নিয়েছেন তিনি।

নাদিয়ার নিজ উদ্যোগে ব্যবসায়ী হওয়ার গল্প শুনে অনেক নারী স্বাবলম্বী হতে স্বপ্ন দেখবেন। চেষ্টা করবেন সমাজের কাছে নিজের গুরুত্বটা তুলে ধরতে। এগিয়ে যাবেন নারীরা। সমৃদ্ধশালী হবে আগামীর বাংলাদেশ।

লেখক: শিক্ষার্থী, দ্বাদশ শ্রেণি, সরকারি আজিজুল হক কলেজ, বগুড়া।

/মাহি/

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়