‘বাবাকে হারানোর ক্ষত কখনো শুকায় না’
শাওন মাহমুদ || রাইজিংবিডি.কম
শাওন মাহমুদ
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন আমার বয়স ছিল তিন বছর। সেই বয়সে আমি আমার বাবা আলতাফ মাহমুদকে হারিয়ে ফেলেছি। জানতাম না বাবা কোথায় আছে, তারপরেও কখনও মনে হতো না বাবা নেই। স্কুলে পড়াকালীন দেখতাম সহপাঠীদের মা-বাবা স্কুলে আসতেন। অনেকে তাদের সন্তানদেরকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে যেতেন আবার কখনো স্কুল থেকে নিতে আসতেন। আমার মন খারাপ হতো!
আমার বয়সি ছেলে-মেয়েদের দেখতাম ঈদের সময় বাবার সঙ্গে জামা-জুতা কিনতে যেত। তখনও আমিও বাবাকে খুঁজতাম। সেই সময়ের কথা এখনো মনে পড়লে ভাবি, কীভাবে নিজেকে বোঝাতাম! সব কিছুতো এখন অতটা স্পষ্ট মনে নেই। কিন্তু শূন্যতার যে অনুভূতি সেটা মনে আছে। শূন্যতাটুকু বুঝতে শুরু করেছিলাম যে- ওর বাবা আছে, আমার বাবা নেই। বাড়ির সবাইকে প্রশ্ন করতাম— আমার বাবা কেন নেই?
আমাদের দেশে মেয়েদের বাবা কিংবা ভাই থাকা খুব দরকার। বাবা না থাকলে একটি মেয়ের আইডেন্টি ক্রাইসিস তৈরি হয়। এ সব ভাবলে পৃথিবীটাকে খুব নিষ্ঠুর মনে হতো।
মাঝে মধ্যে মনে হতো সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু সবকিছু ঠিক হয় না। বাবাকে হারানোর ক্ষত কখনো শুকায় না। পেশাগত কাজ, সংসার-সন্তান নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ার কারণে মানুষ অনেক কিছু ভুলে থাকে, আমিও ভুলে থাকি। কিন্তু যখনই একটু অবসর মেলে তখন অন্য মানুষের মতো আমারও সুখস্মৃতির চেয়ে ক্ষতগুলো বেশি মনে পড়ে।
ছেলেবেলায় প্রায়ই মনে হতো, বাবা আমাকে অথবা মাকে কেন প্রাধান্য দেয়নি। এখন এই বয়সে এসে মনে হয়—বাবার জায়গায় আমি হলেও বাবা যা করেছেন তাই করতাম। একবারও অন্য কিছু ভাবতাম না। কারণ আমাদের রক্তে প্রতিবাদের বিষয়টি মিশে আছে। এখন মনে হয় না এটা অভিমান। শূন্যতা, ক্ষত থেকে মাঝেমধ্যে হয়তো এমনটা বলেছি!
সেই যে ৩ বছর বয়সে মুক্তিযুদ্ধের ভেতর ঢুকে পড়েছি, বাবাকে খুঁজে বেড়াচ্ছি- সেই থেকে মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে ঘুরপাক খেয়েছি। আর বের হতে পারিনি। সবসময় বাবাকে খুঁজতে গিয়েছি, তিনি কোথায় আছেন? ছোটবেলা কখনো আমাকে বলা হতো না, বাবা আর ফিরবেন না। সবাই সবসময় বলতো— বাবা ফিরবেন।
এইসব আশ্বাস সত্য মনে হতো। প্রত্যাশায় থাকতাম, বাবা ফিরবেন। বড় হয়ে জেনেছি— বাবা আর আসবেন না। কিন্তু এখনো মনে হয় না, বাবা বেঁচে নেই কিংবা বাবাকে দেখিনি। মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক। কারণ আপনার মনের ভেতর সবসময় যখন এই অনুভূতি থাকবে তখন কোনোভাবেই আপনি এখান থেকে বিচ্যুত হতে পারবেন না।
অনুলিখন: আমিনুল ইসলাম শান্ত
ঢাকা/লিপি