ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

শত বাধা পেরিয়ে ঢাবিতে পড়ছেন ইয়ামিন

তারেকুর রহমান, কক্সবাজার || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৫:২৯, ১২ আগস্ট ২০২২  
শত বাধা পেরিয়ে ঢাবিতে পড়ছেন ইয়ামিন

প্রায় চার বছর আগে বাবার ছোট ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায়। এতে অন্ধকার নেমে আসে সংসারে। অতিবাহিত করতে হয় দুর্বিষহ জীবনযাপন। পড়ালেখা যেখানে প্রায় বন্ধ হওয়ার উপক্রম সেখানে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে কোনো মতে স্কুল জীবনের গণ্ডি পেরিয়ে কলেজে পা রাখেন ইয়ামিন শাহারিয়ার। 

পারিবারের আর্থিক অনটন, মানসিক বিষাদগ্রস্ততা, স্বপ্নের টানাপোড়ন ও কোচিং ফি বাঁচাতে ৫ মাসের মাথায় কলেজে বিজ্ঞান বিভাগ পরিবর্তন করে মানবিকে বিভাগে চলে যান ইয়ামিন। সেখান থেকে সফলতার সঙ্গে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পান ইয়ামিন। বর্তমানে তিনি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগে পড়ালেখা করছেন। তিনি ২০২০-২১ সেশনের শিক্ষার্থী।

পর্যটন নগরী কক্সবাজারের অদূরে অবস্থিত একমাত্র পাহাড়ি দ্বীপ মহেশখালীতে ইয়ামিনের বাড়ি।

ইয়ামিনের শিক্ষাজীবনের সূচনা হয় মাদরাসায় পড়ালেখার মাধ্যমে। মহেশখালীর গোরকঘাটা মাদরাসার হেফজ বিভাগ থেকে ২০১০ সালে তিনি হিফজ সম্পন্ন করেন।

ইয়ামিন শাহারিয়ার বলেন, দীর্ঘ ৯ বছর পবিত্র রমজান মাসে বিভিন্ন মসজিদে খতমে তারাবির নামাজ পড়াতাম। কওমি মাদরাসায় পড়াকালীন মামাকে দেখে ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন দেখা শুরু। পরবর্তীতে একটি আলিয়া মাদরাসায় সরাসরি অষ্টম শ্রেণিতে ভর্তি হই। চিন্তা করি স্বপ্নের দ্বারে পৌঁছাতে বিজ্ঞান নিয়ে পড়তে হবে। কিন্তু মহেশখালীতে মাদরাসা লেভেলে বিজ্ঞান বিভাগের তেমন সুবিধা নেই। দূরে কোথাও পড়ার সুযোগও ছিল না। তাই বাধ্য হয়ে নবম শ্রেণিতে স্কুলে ভর্তি হতে হই।

কলেজে বিভাগ পরিবর্তনের সময় প্রথমে মেনে নিতে কষ্ট হয়েছিল। মানুষের অনেক কটু কথাও শুনতে হয়েছিল। তাছাড়া, ততদিনে ডাক্তার হওয়ার স্বপ্নও মরে গেছিল। তাই, আমি মনে করি ‘বিভাগ পরিবর্তন’ আমার জীবনের সেরা একটি সিদ্ধান্ত ছিল। ফলশ্রুতিতে, আমার চিন্তাভাবনা ও কাজকে প্রসারিত করার সুযোগ পেয়েছিলাম।

বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শুরুটা জানতে চাইলে ইয়ামিন বলেন ইন্টারমিডিয়েট শেষে ভার্সিটির প্রস্তুতি শুরু করছিলাম। গত বছরের অক্টোবর মাসের ২ তারিখ ঢাবির পরীক্ষা ছিল। সন্তোষজনক না হওয়ায় আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম। এর তিনদিন পর ছিল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা। দূরত্ব বেশি হওয়ায় আম্মু রাজি না থাকায় পরীক্ষা দেওয়ার ইচ্ছে ছিলো না। কিন্তু, ঢাবির পরীক্ষা খারাপ হয়ছিলো সেজন্য হঠাৎ সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে কোনভাবে বাসের একটা সিট ব্যবস্থা করে চট্টগ্রাম থেকে রাজশাহীর উদ্দেশ্যে রওনা দেই। পরীক্ষা দিয়ে মনটা হালকা হলো। এরপর যথাক্রমে চবি এবং গুচ্ছ দিলাম। সব পরীক্ষা ওই অক্টোবর মাসেই ছিলো। এবার ধারাবাহিকভাবে রেজাল্ট আসলো। রাবি ৫৭১ তম, চবি ৩০ তম, ঢাবি ১০২৮ তম, গুচ্ছে স্কোর ৭২.৭৫। অতএব, আলহামদুলিল্লাহ! 

যেদিন রাতে রাবির রেজাল্ট দিয়েছিলো, আমি দেখতে পেয়েছিলাম ১টার দিকে। তখন আম্মু ঘুমে ছিলেন। আম্মুকে ডেকে বললাম– রাজশাহীর রেজাল্ট দিছে, আমি চান্স পেয়েছি। ঘুম থেকে আচমকা উঠে আম্মুর বাঁধ ভাঙা উচ্ছ্বাস আর অশ্রু মাখা হাসি দেখে আমি নিজেই স্তব্ধ হয়ে গেছিলাম। 

ঢাবির রেজাল্ট যেদিন দেয় তখন আমি বাসে। চট্টগ্রাম থেকে বাড়ি যাচ্ছিলাম। সার্ভার ডাউন থাকায় রেজাল্ট দেখতে পাচ্ছিলাম না। পরে এক ভাইকে রোল নম্বর দিয়ে টেলিটক সিম থেকে ম্যাসেজ দিতে বলি। রেজাল্ট আসলো। নিজেই রেজাল্ট দেখে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। রোল নম্বরটা বারবার মিলিয়ে দেখছিলাম। দেখি এটা আমার রোল! বাসে প্রচুর কান্না করছিলাম সেদিন। কাঁদতে কাঁদতে আম্মুকে ফোন দিলাম। শুধু বলছি তোমার ছেলে ঢাবিতে চান্স পেয়েছে। আম্মুও অপর প্রান্ত থেকে কান্না করে উঠলো। কী পরিমাণ পরিশ্রম করছিলাম সেটা উনি জানতেন। এরপর আব্বুকে ফোন দিলাম। বললাম- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজাল্ট দিয়েছে। তোমার ছেলে জাগায় পেয়েছে।

আব্বু বলছিলেন- ‘তুই চান্স পেয়েছিস আলহামদুলিল্লাহ। আমি চুপ করেই ছিলাম। জীবনের অন্যতম কিছু মুহূর্ত ছিলো এগুলো। শুরুটা একটু কষ্ট দিয়ে হলেও শেষটা ছিলো সুন্দর। 

ইয়ামিন পড়ালেখার পাশাপাশি সামাজিক চিন্তাভাবনা ও সমসাময়িক বিভিন্ন বিষয়ে ভিডিও কন্টেন্ট তৈরি করেন। একই সঙ্গে তিনি অনলাইন ও প্রিন্ট মিডিয়ায় প্রতিনিয়ত লেখালেখি করে আসছেন। ইতোমধ্যে তার কিছু কলাম প্রকাশিত হয়েছে জাতীয় পত্রিকায়। 

মাসুদ

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়