ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

পথেঘাটে:১

হাসিনার জীবনযুদ্ধ

আসাদ আল মাহমুদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:০৪, ৩ জুলাই ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
হাসিনার জীবনযুদ্ধ

আসাদ আল মাহমুদ: ২৭ বছর আগে (১৯৯২ সালের মার্চ মাস) স্বামী মো. হাফিজ যখন মোছা: হাসিনাকে (৪৩) ছেড়ে দুনিয়া থেকে চির বিদায় নেন তখন তার তিন বছরের রানী, এক বছরের রিনা আর এক মাসের রাজা নামের তিন সন্তান।

স্বামীর মৃত্যুর পর গরীব বাপের বাড়িতে আশ্রয় নেন তিনি। দুইমাস থাকার পর বাপের বাড়ি (বরিশালের তালতলি) নদীর গর্ভে বিলিন হয়ে যায়। এরপর চোখে অন্ধকার দেখেন হাসিনা। হতাশা এসে গ্রাস করে তাকে। তিনটি সন্তানকে একমুঠো করে ভাত খাওয়াতে হবে- এ জন্য একটা কাজ জোগাড় করতে মরিয়া হয়ে ওঠেন হাসিনা। তার প্রতিবেশী মোসা: মরিয়ম ঢাকায় কাজ করেন। তাঁর প্রতিশ্রুতিতে একদিন (১৯৯২ সালের মে মাসে) দুঃসম্পর্কের নানার কাছ থেকে ৪ হাজার টাকা সুদে এনে তিন সন্তানকে নিয়ে হাসিনা তার সাথে (মরিয়ম) লঞ্চে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন। বিশ্বাস করে লঞ্চ বসে পুরো ৪ হাজার টাকা মরিয়মকে দেন। লঞ্চ থেকে সদরঘাট টার্মিনালে নামেন। সদরঘাট টার্মিনালে হাসিনাকে বসিয়ে রেখে মরিয়ম রিকশা ঠিক করার কথা বলে ৪ হাজার টাকা নিয়ে লাপাত্তা হয়ে যান।

শূন্যহাতে তিনটি অবুঝ সন্তানকে নিয়ে সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে বসে থাকলেন হাসিনা। সকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা, দুপুর, রাত। কোন খবর নেই মরিয়মের। ক্ষুধার যন্ত্রণায় কাঁদতে লাগলো হাসিনার তিন সন্তান। হাজার হাজার মানুষ আসা-যাওয়ার সময় তাকিয়ে দেখলেও শিশুদের কেউ খাবার কিনে দেয়নি। রাতে এই দৃশ্য দেখে সদরঘাটে মাজহারুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তি (ফুটপাতের ব্যবসায়ী) হাসিনার কাছে সবকিছু শুনলেন। নিয়ে গেলেন রাজধানীর মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল এলাকায়। সেই থেকে জীবনযুদ্ধে চড়াই উৎরাই পেরিয়ে হাসিনা এখন থাকেন মতিঝিল কাঁচাবাজার ফুটপাতে, টং ঘরে।

হাসিনা মতিঝিলে ফুটপাতের পাশে রিকশা মেরামতের দোকান চালান। সেখানেই সোমবার তার সাথে কথা হয় দেশের জনপ্রিয় নিউজ পোর্টাল রাইজিংবিডি ডটকমের এ প্রতিবেদকের। হাসিনা শোনান তার জীবনের চরম বাস্তবতার কথা। দুঃসময়ে মাজহারুল ইসলামের পিতৃতুল্য আচরণ, তিন সন্তানকে নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার দু:সাহসিক গল্প।

হাসিনা জানান, বরিশাল সদর উপজেলার তালতলি এলাকার মো. হান্নানের কন্যা তিনি। ১৯৮৮ সালে ক্লাস ফোরে পড়ার সময় বিয়ে হয় তার। স্বামী মো. হাফিজ বরিশালের কাউয়ার চর এলাকার বাসিন্দা। বিয়ের দেড় বছরের মধ্যেই নদী ভাঙনে বসতভিটা হারান। এরপর বাপের বাড়ি আসেন। একে একে সংসার আলো করে আসে তিন সন্তান। ছোট ছেলের বয়স যখন এক মাস তখন স্বামী মারা যান। গরীব বাবার বাড়িতে তাদের ৪ জনের খাবার জোগান দেয়াও কঠিন হয়ে পড়ে। বিষয়টি বুঝতে পেরে কাজের সন্ধান শুরু করেন তিনি।

 

হাসিনা বলেন, ‘এমন পরিস্থিতিতে আমি দিশেহারা। তখন মরিয়ম নামের এক প্রতিবেশি মহিলার সাথে আমার কথা হয়। তিনি ঢাকায় থাকেন। আমিও সিদ্ধান্ত নিলাম ঢাকায় যাবো। কাজ করে সন্তানদের খাওয়াবো। এলাকার ব্যবসায়ী ও দু:সম্পর্কের নানা তাজুলের কাছ থেকে ৪ হাজার টাকা সুদে নিয়ে মরিয়মের সাথে তিন সন্তানকে কোলে নিয়ে লঞ্চে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। লঞ্চে বসে বিশ্বাস করে পুরো ৪ হাজার টাকা দিলাম মরিয়মকে। সদরঘাট টার্মিনালে নামার পর মরিয়ম বলে, রিক্সা ভাড়া করে নিয়ে আসি, তোমাদের বাসায় নিয়ে যাবো। কিন্তু মরিয়ম আর ফিরে এলো না। দেখতে দেখতে সকাল, দুপুর, রাত হয়ে গেলো। ক্ষুধার জ্বালায় বাচ্চারা কান্নাকাটি করতে লাগলো। এ অবস্থা দেখে একজন লোক এগিয়ে এলেন আমার কাছে। তিনি মাজহারুল ইসলাম (ফুটপাতে জুতার ব্যাবসায়ী) বলে পরিচয় দিয়ে জানতে চাইলেন কোথায় যাবো? আমি তাঁকে সব বললাম। তখন তিনি আমাকে বললেন, সে (মরিয়ম) পালিয়ে গেছে। তার মুখে একথা শুনে আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। কি করবো, কোথায় যাবো বাচ্চাদের নিয়ে, ভাবছিলাম। এক পর্যায়ে আমি তার পা ধরে কান্না শুরু করেছি। বললাম, আপনি আমার বাপ। ‘বাপ’বলে চিৎকার করে আমাকে আশ্রয় দেওয়ার জন্য অনুরোধ করলাম।’

হাসিনা রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘অনেকক্ষণ মাজহার মনে মনে কি যেন ভাবলেন। এরপর আমাকে মতিঝিলে নিয়ে গিয়ে একটি ছোট্ট ছাপড়া ঘরে উঠালেন। পরের দিন আমাকে ৩০০ টাকা ধরিয়ে দিয়ে সবজির ব্যবসা করার জন্য বললেন এবং ফকিরাপুল বাজারের সাথেই কালাম নামের এক সবজির দোকনদারের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। তার কাছ থেকে সবজি এনে বিক্রি করি। সবজি বিক্রি করে ভালোই যাচ্ছিল আমার। দুই সন্তানকে স্কুলে ভর্তি করি। তিন বছর সবজি বিক্রির পর বাসায় কাজ করার পাশাপাশি ফুটপাতে রিকশা সারানোর দোকান দেই। এভাবে অনেক কষ্টে চলতে থাকে সংসার। রিকশা সারানোর দোকান দিয়ে দুই মেয়েকে বিয়ে দিলাম। এখন ছেলেকে নিয়ে দোকান চালাই।’

হাসিনা বলেন, ‘দু:সময়ে তিনি (মাজহার) এসে আমার পিতার দায়িত্ব পালন করেছেন। একজন মানুষ আমার অভিভাবক হয়েছেন, এটি বিরল ঘটনা।’

তিনি বলেন, ‘আয় না থাকায় অভাবের কারণে মেয়েরা ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত পড়ার পর তাদেরকে আর স্কুলে ভর্তি করতে পারিনি। অল্প বয়সে মেয়েদের বিয়ে দিয়েছি। ছেলেটাকে স্কুলে দিতে পারিনি। আমার সাথে দোকানে কাজে লাগাচ্ছি।’

হাসিনা বলেন, ‘কষ্ট করে এগিয়ে চলেছি, ওয়ার্ডের কাউন্সিলরের কাছ থেকে কিংবা অন্য কারো কাছ থেকে কোন সুযোগ সুবিধা কখনও নেইনি।’

এ বিষয়ে সমাজকর্মী আমিনুল ইসলাম রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘হাসিনা জীবনযুদ্ধ করা একজন নারী। বার বার জীবনযুদ্ধে হোচট খেয়েও থেমে থাকেননি। মনের ইচ্ছা শক্তির মাধ্যমে জীবনযুদ্ধ করছেন তিনি।’

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩ জুলাই ২০১৯/আসাদ/শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়