ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

মা ভাবেন, এই বুঝি ফিরে এলো পায়েল

মামুন খান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৯:২৬, ৩০ অক্টোবর ২০২০   আপডেট: ১৯:৩৬, ৩০ অক্টোবর ২০২০
মা ভাবেন, এই বুঝি ফিরে এলো পায়েল

মো. সাইদুর রহমান পায়েল (ফাইল ফটো)

পায়েলের ফিরে আসার অপেক্ষায় মা এখনো দুয়ারে দাঁড়িয়ে থাকেন। রাতে সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়েন, তখনো জেগে থাকেন মা। তিনি ভাবেন, এই বুঝি ফিরে এলো পায়েল। কিন্তু পায়েলের যে আর ফেরা হবে না, সে কথা কেউ মাকে বোঝাতে পারেন না। যখনই কেউ বলেন, পায়েল আর ফিরবে না; তখনই তিনি অবুঝ শিশুর মতো হাউমাউ করে কাঁদতে থাকেন। ছেলের জন্য মায়ের এই অপেক্ষা কোনোদিনই শেষ হবে না।

২০১৮ সালের ২১ জুলাই রাতে দুই বন্ধুর সঙ্গে হানিফ পরিবহনের একটি বাসে করে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় ফিরছিলেন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএ’র শিক্ষার্থী মো. সাইদুর রহমান পায়েল। মুন্সীগঞ্জের ভাটেরচর সেতুর কাছে বাস থেকে নেমে প্রস্রাব করতে যান পায়েল। বাসে উঠতে গিয়ে দরজার সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে জ্ঞান হারান তিনি। বাসের স্টাফরা চিকিৎসার ব‌্যবস্থা না করে তাকে সেতু থেকে নিচে ফেলে দেন।

এ ঘটনায় দায়ের করা মামলার রায় রোববার (১ নভেম্বর) ঘোষণা করবেন ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক আবু জাফর মো. কামরুজ্জামান।

পায়েলের মা কহিনূর বেগম বলেছেন, ‘পায়েলের জন্মের আগে থেকে ওর বাবা কাতারে থাকে। ওর বাবার ইচ্ছে ছিল, পায়েল দেশের বাইরে গিয়ে পড়াশোনা করবে। কিন্তু আমি বলেছি, দেশে পড়ালেখার মান ভালো। ও এখানেই পড়াশোনা করে ভালো একটা সরকারি চাকরি করুক। কিন্তু সে আশা আমার আশাই রয়ে গেল। অকালে আমার ছেলেটাকে হারালাম।’

তিনি বলেন, ‘পায়েল নিহত হওয়ার ১০ দিন আগে ওর ভাতিজির জন্ম হয়। তাকে বলেছিলাম, বাবা ভিডিও কলে ভাতিজিকে দেখাই। সে বলে, না মা, আমি সরাসরি এসে দেখব। ভাতিজিকে দেখতে সে বাসায় আসে। ২১ জুলাই চলে যায়। বাসে উঠে আমাকে ফোনে বলে, আম্মু, সিটে বসেছি, গাড়ি ছেড়েছে। এটাই ছিল ওর সাথে আমার শেষ কথা।’

কোনোভাবেই ছেলের কথা ভুলতে পারছেন না কহিনূর বেগম। তিনি বলেন, ‘ফজরের নামাজের জন্য ওকে ডেকে ওঠাতাম। দুজন নামাজ পড়তাম। এখন নামাজ পড়তে গেলে মনে হয়, ও আমার পাশে নামাজ পড়ছে। নামাজ পড়তে গেলে ওর কথা মনে পড়ে। পৃথিবীর সব কথা ভুলতে পারি, কিন্তু পায়েলের কথা ভুলতে পারি না। এক মিনিটের জন্যও ওকে ভুলতে পারি না। প্রতি মুহূর্তে ওর অপেক্ষায় থাকি। প্রতি মুহূর্তে ওর কথা মনে পড়ে। ছেলে ফিরে আসবে না, এটা মানতে পারছি না।’ আসামিদের সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড প্রত্যাশা করেন কহিনূর বেগম।

পায়েলের মামা ও মামলার বাদী গোলাম সোহরাওয়ার্দী বিপ্লব বলেন, ‘মানুষ এত অমানবিক হতে পারে! নির্মমভাবে আমার ভাগ্নেকে হত্যা করেছে ওরা। পায়েল নির্মমতার শিকার। ওদের মৃত্যুদণ্ড প্রত্যাশা করছি, যাতে পরবর্তীতে কোনো বাসের স্টাফ যাত্রীদের সাথে এমন অমানবিক আচরণ করতে সাহস না পায়।’

সংশ্লিষ্ট আদালতের স্পেশাল পাবলিক প্রসিকিউটর আবু আব্দুল্লাহ ভূঁইঞা বলেন, ‘রাষ্ট্রপক্ষ আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে। আশা করছি, আসামিদের মৃত্যুদণ্ড হবে, ভিকটিমের পরিবার ন্যায়বিচার পাবে। পরবর্তীতে আর কেউ এ ধরনের অপরাধ করার সাহস পাবে না।‘

আসামিপক্ষের আইনজীবী হুজ্জাতুল ইসলাম খান বলেন, ‘রাষ্ট্রপক্ষ আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ করতে পারেনি। তাছাড়া, মামলার তদন্তে অনেক ত্রুটি আছে। ত্রুটিগুলো বিবেচনায় নিলে আসামিরা খালাস পাবেন বলে আশা করছি।’

উল্লেখ্য, ২০১৮ সালের ২১ জুলাই রাতে দুই বন্ধুর সঙ্গে হানিফ পরিবহনের একটি বাসে করে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেওয়ার পর নিখোঁজ হন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএ’র শিক্ষার্থী মো. সাইদুর রহমান পায়েল। নিখোঁজের এক দিন পর ২২ জুলাই মুন্সীগঞ্জের ভাটেরচর সেতুর নিচের খাল থেকে পায়েলের লাশ উদ্ধার করে গজারিয়া থানা পুলিশ। এ ঘটনায় ২৪ জুলাই পায়েলের মামা গোলাম সোহরাওয়ার্দী বিপ্লব মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া থানায় মামলা দায়ের করেন। এরপর হানিফ পরিবহনের ওই বাসের সুপারভাইজার জনিকে ঢাকার মতিঝিল এবং চালক জামাল হোসেন ও তার সহকারী ফয়সাল হোসেনকে আরামবাগ থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।

আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে আসামিরা জানায়, গজারিয়া এলাকায় গাড়ি যানজটে পড়ায় প্রস্রাব করার কথা বলে বাস থেকে নেমেছিলেন পায়েল। বাস চলতে শুরু করলে তিন দৌড়ে এসে ওঠার সময় দরজার সঙ্গে ধাক্কা লেগে জ্ঞান হারান। নাক-মুখ দিয়ে রক্ত বের হতে দেখে তাকে হাসপাতালে নেওয়ার বদলে মুখ থেঁতলে দিয়ে ভাটেরচর সেতু থেকে নিচের খালে ফেলে দেন এবং বাস নিয়ে ঢাকায় চলে আসেন আসামিরা।

মামলাটি তদন্ত করে ২০১৮ সালের ৩ অক্টোবর তিনজনের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা গজারিয়া থানার পুলিশ পরিদর্শক মামুন আল রশিদ। এরপর মুন্সীগঞ্জের আদালত থেকে মামলাটি চট্টগ্রামের দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হয়। চট্টগ্রাম দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের ভারপ্রাপ্ত বিচারক মোহাম্মদ আবদুল হালিম তিন আসামির বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করেন বিচার শুরু করেন। পরবর্তীতে মামলাটি ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হয়। 

গত ৪ অক্টোবর ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক আবু জাফর মো. কামরুজ্জামান রাষ্ট্রপক্ষ এবং আসামিপক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে রায়ের তারিখ ১ নভেম্বর ধার্য করেন। মামলার তিন আসামি চালক মো. জামাল হোসেন, সুপাভাইজার মো. জনি ও হেলপার ফয়সাল হোসেন জামিনে ছিলেন। ওই দিন জামিন বাতিল করে আদালত তাদের কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।

ঢাকা/মামুন/রফিক

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়