ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

উপকূলে সুপেয় পানির সংকট

রফিকুল ইসলাম মন্টু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:২৭, ১৮ মার্চ ২০২১   আপডেট: ০৭:৫২, ১৯ মার্চ ২০২১
উপকূলে সুপেয় পানির সংকট

‘পানির জন্য বর্ষায় আমরা আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকি। বর্ষাকাল যেন দীর্ঘস্থায়ী হয়, আমরা বিধাতার কাছে প্রার্থনা করি। বছরের ১২ মাসের মধ্যে বর্ষকালের ৩-৪ মাস আমরা ভালো পানি পাই। বাকি সময়টুকু খাবার পানির তীব্র সংকট থাকে। ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগ পানির আধারগুলো আমাদের কাছ থেকে অনেক দূরে সরিয়ে নিয়েছে। ফলে পানির জন্য আমাদের টিকে থাকার লড়াই আরও কঠিন হয়ে পড়েছে।’

কথাগুলো খুলনার দাকোপ উপজেলার সুতারখালী গ্রামের গৃহিণী আলেয়া বেগমের (৩৯)। এলাকাটি ২০০৯ সালের ঘূর্ণিঝড় আইলায় ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। প্রায় ৫ বছর এলাকাটি ছিল পানির নিচে। সে সময় খাবার পানির সব আধার নষ্ট হয়ে গেছে।

আলেয়া বেগমের দৈনিক কাজগুলোর মধ্যে পানিসংগ্রহ-ই প্রধান। ভোরে সূর্য ওঠার আগেই তার এই লড়াই শুরু হয়। পানি না হলে ঘরের অন্য কাজগুলো বন্ধ থাকে। বিকালে ঘরের সব কাজ শেষ করে তিনি আবার পানি সংগ্রহে বের হন। এই দুই কলসি পানি দিয়ে দিনের সব কাজ শেষ হরতে হয় তাকে। এটুকু পানি সংগ্রহ করতে তার ৩ ঘণ্টারও বেশি সময় ব্যয় হয়। আলেয়া একা নন, তার গ্রামের শতাধিক পরিবার এভাবেই পানির জন্য লড়াই করছেন বছরের পর বছর। আর এই লড়াইয়ের অগ্রভাগে থাকেন নারী।

বাড়ির নারী ও শিশুরা সকালে-বিকালে এভাবে খাবার পানি সংগ্রহ করে। খুলনা জেলার দাকোপ উপজেলার কালাবগি গ্রামের ছবি

মাঠ পরিদর্শনে খুলনা জেলার দাকোপ ও কয়রা উপজেলা, সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর ও আশাশুনি উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রামে পানি কষ্ট চোখে পড়ে। পানির সংগ্রহের জন্য মানুষগুলো দীর্ঘ পথ পায়ে হাঁটে। এভাবে পানি সংগ্রহ করতে দেখা যায় শিশু এমনকি বৃদ্ধদেরও। সূত্র বলছে, জলবায়ু পরিবর্তন এই এলাকায় লবণাক্ততা বাড়িয়েছে। আইলার আগে এই এলাকায় এতটা পানির সংকট ছিল না। কিন্ত আইলার প্রলয়ে সুপেয় পানির সবগুলো আধার লবণ পানিতে ডুবে যায়। সেগুলো থেকে এখন আর লবণ পানি সরানো যাচ্ছে না। ফলে মিঠা পানির সংকট দিন দিন বাড়ছে।

খাবার পানির আধারগুলো নষ্ট হয়ে গেছে

খুলনার দাকোপ উপজেলার কালাবগি ঝুলন্ত গ্রামের বাসিন্দা সুফিয়া বেগম বলেন, ‘আগে আমরা এলাকা থেকেই খাবার পানি সংগ্রহ করতে পারতাম। কিন্তু কয়েক বছর ধরে খাবার পানি সংগ্রহ করতে হয় দাকোপ উপজেলা সদর থেকে নৌপথে। ট্রলারে করে ড্রাম ভরে পানি আনা হয়।’

‘জলবায়ু পরিবর্তন ও লবণাক্ত এলাকা সম্প্রসারণের প্রেক্ষিতে সুপেয় পানির সন্ধানে’ শীর্ষক প্রতিবেদনে পানি কমিটি বলছে, বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিম উপকূল এলাকায় লবণাক্ততার পাশাপাশি ভূগর্ভস্থ জলাধারের বড় সমস্যা দেখা দিয়েছে। এ এলাকার অবস্থান ব-দ্বীপের নিম্নাংশ। ফলে নদী বাহিত পলির আধিক্য বেশি। এ কারণে ভূগর্ভে জলাধারের জন্য উপযুক্ত মোটা দানার বালু বা পলির স্তর খুব কম পাওয়া যায়। আর পলির স্তর পাওয়া গেলেও এই বালুর স্তরের পুরুত্ব খুবই কম। আর কোথাও কোথাও এই বালুর স্তরের ভূমি থেকে অনেক গভীরে। সেখান থেকে মিষ্টি পানি উত্তোলন অত্যন্ত দুরূহ।’

খাবার পানি সংরক্ষণ আরেক যুদ্ধ। বাড়িতে থাকা সব পাত্রে এভাবে পানি সংরক্ষণ করা হয়

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চলের সাতক্ষীরা, খুলনা ও বাগেরহাট জেলার শ্যামনগর, আশাশুনি, কালিগঞ্জ, তালা, দেবহাটা, কয়রা, পাইকগাছা, দাকোপ, বটিয়াঘাটা, ডুমুরিয়া, মংলা, রামপাল, চিতলমারী, মোড়েলগঞ্জ, বাগেরহাট ও শরণখোলা উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে পানি সংকট আছে। এই এলাকার প্রায় ৫০ লাখ মানুষ কমবেশি খাবার পানির সংকটে রয়েছে। এক কলস পানি সংগ্রহের জন্য মহিলা ও শিশুরা ছুটে যায় এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে। কোনো কোনো গ্রামে মিষ্টি পানির আধার বলতে আছে ২ থেকে ১টি পুকুর। তবে অধিকাংশ গ্রামে পুকুরও নেই।

পানি কমিটি পর্যবেক্ষণে দেখেছে, বাংলাদেশের গভীর নলকূপগুলো সাধারণত ৩০০ থেকে ১২০০ ফুটের মধ্যে হয়। দেশের উত্তরাঞ্চলের ৩০০ থেকে ৪০০ ফুটের মধ্যে গভীর নলকূপ বসানো যায়। কিন্তু দেশের দক্ষিণ পশ্চিম উপকূলীয় এলাকায় এই নলকূপের গভীরতা ৭০০ থেকে ১২০০ ফুটের মধ্যে। পরীক্ষায় দেখা গেছে, এসকল নলকূপের পানি তূলনামূলক কম লবণাক্ত এবং আর্সেনিকমুক্ত। তবে পলি মাটির আধিক্য, পাথরের উপস্থিতি এবং অধিক লবণাক্ততার কারণে উপকূলীয় সব এলাকার গভীর নলকূপ স্থাপন করা সম্ভব হয় না।

গাবুরা ইউনিয়নের ১০ নম্বর সোরা গ্রামের মো. ইদ্রিস মোড়লের স্ত্রী আছমা খাতুনের ঘরে ঢুকেই বোঝা যায় পানির সমস্যা তাদেরকে কতটা সংকটে রেখেছে। ঘরের ভেতরে কলসি, ড্রাম, থালাবাটি এমনকি পলিথিনেও পানি সংরক্ষণ করা হয়েছে। এদের ঘরে একফোঁটা পানির মূল্য অনেক। নারী-পুরুষ ও শিশুরা পায়ে হেঁটে পানি আনেন, আবার কখনো ড্রাম ভরে ভ্যানে করেও আনেন। এতে পানির মূল্যটা আরও বেড়ে যায়। এলাকা ঘুরে জানা যায়, ঘরে একবেলা খাবার যোগাড়ের চেয়েও এই এলাকার মানুষের সুপেয় পানি যোগাড়ে বেশি সমস্যা। চাল, ডাল, নুন, তেল সবাই যোগাড় হলো; কিন্তু ঘরে সুপেয় পানি নেই। এর মানে সবকিছুই অচল।

প্রাকৃতিক দুর্যোগ পানি সংগ্রহের লড়াই আরও কঠিন করে। খুলনা জেলার দাকোপ উপজেলার কালাবগি গ্রামের ছবি

পানির জন্য কঠিন লড়াই

‘আমরা পানির অভাবের মধ্যে বসবাস করছি। অনেক কষ্টে খাবার সংগ্রহ করতে পারি। কিন্তু পানি সংগ্রহ করা আমাদের জন্য খুবই কঠিন।’ খুলনা জেলার দাকোপ উপজেলার গুনারি গ্রামের রুদ্রা রানী বিশ্বাস কথাগুলো বলেন। এই গ্রামের আরও অনেকে তাদের জীবন জীবিকার জন্য পানি সংকটকেই প্রধান সমস্যা মনে করেন। পানি সংগ্রহে তাদের অতিরিক্ত সময় ও অর্থ অপচয় হচ্ছে। সাতক্ষীরা জেলার আশাশুনি উপজেলার কুড়িকাহুনিয়া গ্রামের মো. শাহজাহান মোড়ল বলেন, ‘বাংলাদেশের পশ্চিম উপকূলে ঠিক পাঁচ বছর আগে যেমন পানিকষ্ট ছিল, এখন সেই সংকট আরও কয়েকগুন বেড়েছে। সংকট সমাধানে উদ্যোগের শেষ নেই। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে নেওয়া হয়েছে নানান পদক্ষেপ। তবে পানিকষ্ট খুব একটা লাঘব হয়নি। ঘরের সবদিকে পানি। অথচ খাবারের পানির জন্য আমাদের যুদ্ধ করতে হয়।’

মাঠ পরিদর্শনে দেখা যায়, খুলনা জেলার দাকোপ উপজেলার সুতারখালী ইউনিয়ন নদীবেষ্টিত। বিভিন্ন সময়ে ঘূর্ণিঝড় এই এলাকার ব্যাপক ক্ষতি করেছে। বহু মানুষ বাড়িঘর ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হয়েছে। ফলে জীবন জীবিকার অন্যান্য সমস্যার সঙ্গে এই এলাকায় খাবার পানি সংকটও তীব্র হয়েছে। এলাকার পানি সংকট নিয়ে সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে যুক্তরাজ্যের ইম্পোরিয়াল কলেজের সমীক্ষা। সেখানে বলা হয়েছে, বছরের ৩-৪ মাস বৃষ্টির পানি এই এলাকার মানুষের পানি সংকট কিছুটা লাঘব করে। অন্য সময় এদের কষ্টের সীমা থাকে না।

দাকোপ উপজেলার কালাবগি ও গুনারী গ্রামের বাসিন্দাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, এইসব এলাকায় খাবার পানির জন্য এখন চারটি পথ খোলা আছে। এগুলো হচ্ছে- ১. বৃষ্টির পানি। বর্ষাকালে এলাকার মানুষ বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে। কিন্তু বড় ট্যাংকির অভাবে অনেক পারিবারের পক্ষে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করা সম্ভব হয় না। ২. স্থানীয় ফিল্টারের পানি। স্থানীয় পর্যায়ে দুটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা লবণ পানি শোধন করে পানি খাবারযোগ্য করে। কিন্তু এর ক্যাপাসিটি মাত্র দুই হাজার পরিবার। ৩. উপজেলা সদর থেকে ফিল্টারের পানি সংগ্রহ। উপজেলা সদরের দূরত্ব প্রায় ২০ কিলোমিটার। সেখান থেকে নৌপথে ড্রামে করে পানি সংগ্রহ করেন অনেক পরিবার। ৪. স্থানীয় পুকুরের পানি। বাধ্য হয়ে কিছু পরিবার পুকুরের পানিতে ফিটকিরি প্রয়োগ করে ব্যবহারযোগ্য করে নেয়। দুর্যোগের কারণে অনেক স্থানের পুকুর ডোবায় পরিণত হয়েছে বা ভরাট হয়ে গেছে।

৭/৮ মাইল পথ দূর থেকে পনি সংগ্রহ করে আনা হচ্ছে 

সংকট ক্রমেই বাড়ছে

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঘূর্ণিঝড় আইলার রেশ দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলের ক্ষতিগ্রস্ত ১১টি উপকূলীয় জেলার ৬৪টি উপজেলার প্রায় ৫০ লাখ দরিদ্র প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর বড় অংশ বয়ে চলেছে। নেপথ্য কারণ হিসেবে তিনটি সমস্যাকে দায়ী করেন বিশেষজ্ঞরা। এগুলো হচ্ছে: ভূ-প্রাকৃতিক, মানবসৃষ্ট কারণ ও সরকারের সদিচ্ছার অভাব। এ অঞ্চলের মাটিতে বর্তমানে লবণাক্ততার পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭.৬-১৫.৯ পিপিটি; অথচ মাটির সহনীয় মাত্রা ০.৪-১.৮ পিপিটি। লবণাক্ততার কারণে গাছপালার পরিমাণও আশঙ্কাজনকভাবে কমে যাচ্ছে। পুকুরে লবণাক্ততার মাত্রা বৃদ্ধি পেয়ে মাছসহ জলজ প্রাণীও মারা যাচ্ছে।

বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) মাইনর ইরিগেশন ইনফরমেশন সার্ভিস ইউনিট পরিচালিত ‘দক্ষিণাঞ্চলের ভূগর্ভে লবণ পানির অনুপ্রবেশ পূর্বাভাস প্রদান’ শীর্ষক গবেষণায় দেখা গেছে, ভূগর্ভস্থ পানিতে বঙ্গোপসাগর থেকে লবণ পানি এসে মিশছে। ইউনিসেফের তথ্যানুযায়ী, নিরাপদ উৎস থেকে পানি সংগ্রহের সুযোগ নেই এমন ১০ দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। দেশে বর্তমানে প্রায় তিন কোটি মানুষ নিরাপদ পানি সুবিধার বাইরে। যার বেশিরভাগই বাস করে উপকূলীয় ও পার্বত্য অঞ্চলে।

বাংলাদেশ সেন্টার ফর এডভাসড স্টাডিজ (বিসিএএস)-এর নির্বাহী পরিচালক ক্লাইমেট চেঞ্জ এক্সপার্ট ড. আতিক রহমান বলেন, বাংলাদেশকে বলা হয় গ্রাউন্ড জিরো অব ক্লাইমেট চেঞ্জ। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত সম্ভবত বাংলাদেশই হবে। বাংলাদেশের উপকূল অঞ্চল একদম সমতল। এতটাই সমতল যে, এক মিটার পানি বাড়লে ১৭ ভাগ ভূমি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সমুদ্রের উপরের লবণাক্ত পানি নিচের দিকে যায়। ফলে ভূগর্ভস্থ পানির লবণাক্ততা বাড়তে থাকে। সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে পানি ভেতরে ঢুকছে। যে পানি ঢুকছে, সেটা লবণ পানি। এই লবণ পানি ক্রমেই বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ছে। শুধু জলবায়ু পরিবর্তন নয়, লবণাক্ততা বৃদ্ধির অন্যান্য কারণও আছে। আরেকটি কারণ হচ্ছে, উপরের দিকে গঙ্গার পানি প্রবাহ কমে যাওয়া।

ঢাকা/তারা

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়