ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

ক্ষতচিহ্ন নিয়ে দাঁড়িয়ে কালাবগি ঝুলন্ত গ্রাম

রফিকুল ইসলাম মন্টু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:০৩, ২৫ মে ২০২১   আপডেট: ১৪:০৯, ২৫ মে ২০২১
ক্ষতচিহ্ন নিয়ে দাঁড়িয়ে কালাবগি ঝুলন্ত গ্রাম

সকাল থেকে কাজে বিরাম নেই ইলিয়াস হোসেন এবং তার স্ত্রী মর্জিনা বেগমের। চারটি বাঁশের খুঁটি জোড়া লাগাতে না পারলে রাতে ঘরে থাকার উপায় নেই। এই বাঁশের খুঁটির সঙ্গেই জড়িয়ে আছে দুর্যোগে খাপ খাওয়ানোর অভিনব এক গল্প।

এই ছবিটি আমার নোটবুকে উঠেছে বাংলাদেশের পশ্চিম উপকূলের খুলনা জেলার দাকোপ উপজেলার কালাবগি গ্রাম থেকে। গ্রামের কয়েক শত বসতঘর এ ভাবে ঝুলে আছে বাঁশের খুঁটির সঙ্গে। খুঁটির সঙ্গে জোয়ার সমান কাঠের পাটাতন। এর ওপরেই বসতি বছরের পর বছর। না, এই এলাকার মানুষদের কেউ শিখিয়ে দেয়নি এই কৌশল। এরা দুর্যোগের কাছে শিখেছে, এখানে বসবাস করতে হলে এভাবেই ঘর বাঁধতে হবে। অথচ এই গ্রামের সবগুলোর বাড়ি এক সময় ছিল সমতল জমিতে। তখন ঘরের সামনে উঠোন ছিল। উঠোনে খেলাধুলা করতো শিশুরা। ঘরের আশপাশে ছিল সবজির বাগান। কিন্তু সেই দিন কেড়ে নিয়েছে ২০০৯ সালের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় আইলা। সে-কথাই বলছিলেন ঝুলন্ত গ্রামের বাসিন্দা দিনমজুর ইলিয়াস হোসেন।

ইলিয়াস আঙুল তুলে দেখিয়ে বললেন, ‘এই যে শিবসা নদীর ঢেউ দেখছেন; এখানেই ছিল আমার ঘর। কাজকর্ম করে দিনগুলো ভালোই চলছিল। আইলা এসে আমাদের সব শেষ করে দিয়ে গেছে। থাকার ঘরও নেই। শেষে এভাবে ঘর বানিয়ে থাকছি।’

আজ থেকে ১২ বছর আগে ঘূর্ণিঝড় আইলা প্রচণ্ড শক্তি নিয়ে আঘাত করেছিল বাংলাদেশের পশ্চিম উপকূলে। খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা জেলার প্রত্যন্ত এলাকাগুলো ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছিল। খুলনার দাকোপ উপজেলার সুতারখালী, কামারখোলা, সাতক্ষীরার শ্যামনগরের গাবুরা ইউনিয়ন সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছিল। এসব এলাকা থেকে বহু মানুষ অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হয়েছিল। পরে কিছু মানুষ এলাকায় ফিরতে পারলেও অনেকের পক্ষে আর কখনোই এলাকায় ফেরা সম্ভব হয়নি। সুতারখালী ইউনিয়ন আইলার আঘাতের পর থেকে প্রায় পাঁচ বছর লবণ পানির নিচে ছিল। গোটা ইউনিয়ন সবুজহীন হয়ে পড়েছিল।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, আইলার আগে এখানে ছিল সবুজ গ্রাম। সুন্দরবন এবং শিবসা নদীতে নানান কাজে জীবিকা নির্বাহের মাধ্যমে মানুষগুলো বেশ ভালোই ছিল। কিন্তু ঘূর্ণিঝড় আইলা মানুষের সেই সুদিন কেড়ে নেয়। কালাবগি নতুন নাম পায় ‘ঝুলন্ত গ্রাম’। মানুষগুলো জোয়ারের পানির সমার উঁচু মাচা পেতে ঘর বানিয়ে বসবাস শুরু করে। সুতারখালী ইউনিয়নের ৮ এবং ৯ নম্বর ওয়ার্ডজুড়ে এই ঝুলন্ত গ্রামের অবস্থান। অন্তত পাঁচশ’ বাড়ি আছে এখানে, যারা অত্যন্ত মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন এক যুগ ধরে।

গত বছর ২০ মে ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের পরে গ্রামটি আরও বদলে যায়। আস্ত একটি ঝুলন্ত গ্রাম ভেঙে দুই টুকরো হয়ে গেছে আম্ফানের প্রবল ধাক্কায়। এখন গ্রামের একাংশ পরিণত হয়েছে দ্বীপে। সুন্দরবন লাগোয়া সেই ছোট্ট দ্বীপে বসবাস কারে শ’খানের পরিবার। এদের মূল ভূ-খণ্ডে যেতে হয় ভয়াল শিবসা নদী পার হয়ে।

খুলনা জেলার দাকোপ উপজেলার সুতারখালী ইউনিয়নের আওতাধীন কালাবগি গ্রাম। আইলার পর সুতারখালী ইউনিয়নের নাম দেশি-বিদেশি মিডিয়ায় এসেছে। তবে উন্নয়ন সে তুলনায় হয়নি। আইলার পরে বেড়িবাঁধ নির্মিত হয়েছিল। গত কয়েক বছরে সেই বেড়িবাঁধ ভাঙনের মুখে। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে সুতারখালী ইউনিয়নের চারিদিকে নতুন বেড়িবাঁধ হয়েছে। কিন্তু সে বাঁধের বাইরেই রয়ে গেছে কালাবগির পাঁচ শতাধিক পরিবার। নদীর তীরে ভাঙন; এ কারণে অনেক দূর দিয়ে বেড়িবাঁধ নির্মিত হচ্ছে। কিন্তু এ বিষয়ে ভাঙন-তীরের মানুষের ব্যাখ্যা ভিন্ন। তারা বলেন, নদীর ভাঙন রোধ না করে যত শক্ত করেই বাঁধ দেওয়া হোক না কেন, তা টিকবে না। এলাকা নিরাপদ করতে হলে ভাঙন রোধের দিকেই আগে নজর দিতে হবে।

দুর্যোগ থেকে বাঁচতে কালাবগি গ্রামের বাসিন্দারা নিজেরাই কৌশল বের করে নিয়েছেন। উপকূলজুড়ে রয়েছে দুর্যোগে টিকে থাকার এমন অনেক গল্প। যেখানে মানুষের ঝুলন্ত ঘর করার সুযোগ নেই; সেখানে ঘর তৈরি হয়েছে উঁচু ভিটেয়। দুর্যোগ থেকে বাঁচতে কেউ ঘরের চারিপাশে রশি টানা দিয়েছেন। দুর্যোগকালে সহজে যাতে ঘর থেকে বের হয়ে যেতে পারেন; এমন কৌশলও নিয়েছেন অনেকে। ঘরের প্রয়োজনীয় মালামাল সংরক্ষণে কাঠের বড় বাক্স রাখেন প্রত্যেক ঘরে।

খুলনা ভিত্তিক বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা রূপান্তর-এর নির্বাহী পরিচালক রফিকুল ইসলাম খোকন বলেন, আইলার পর এলাকাটি বেশি ঝুঁকির মুখে পড়েছে। ভাঙনে স্থানীয় বাসিন্দারা জমি হারিয়েছে। ফলে তাদের দুর্ভোগ আরও অনেকখানি বেড়েছে। এদের সমস্যা সমাধানে উদ্যোগ গ্রহণ কঠিন হয়ে পড়েছে। কারণ অবকাঠামোগত উন্নয়নে কাজ করতে হলে জমি প্রয়োজন। ওই এলাকায় জমিও নেই। ফলে এদের উন্নয়ন করতে হলে এদের অন্যত্র সরিয়ে আনার পদক্ষেপ নিতে হবে। এরপর এদের কী ধরণের সুবিধা নিশ্চিত করা যায়, সেটা দেখতে হবে।

বাংলাদেশের উপকূলে ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রভাব পড়ছে জনজীবনে। এটা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কিনা, সে বিষয়ে দ্বিমত আছে। তবে দুর্যোগগুলো যে মানুষকে অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু করে দিচ্ছে, পরিবেশের চিত্র বদলে দিচ্ছে, তাতে কোনো সন্দেহ নাই। শুধু কালাবগি নয়, বাংলাদেশের উপকূলজুড়ে অনেক স্থানের মানুষ প্রাকৃতিক দুর্যোগের ভার বহন করে চলেছে। উপকূল থেকে ছুটছে শহরের দিকে। এদেরকে যদিও ‘জলবায়ু উদ্বাস্তু’ বলা হচ্ছে। এদের গল্পগুলো মিডিয়ায় সেভাবে আসছে না। বিজ্ঞানিদের ধারণা, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ভবিষ্যতে এই ঝুঁকি আরও বাড়বে।

সায়েন্টিফিক রিপোর্টস জার্নালে প্রকাশিত নতুন সমীক্ষা বলছে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি আগামীতে আরও বিপজ্জনক হতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়া এবং উত্তর ক্যারোলিনা, ফ্রান্স, জার্মানি, ভারত ও চীনের কিছু অংশ এবং বাংলাদেশ বিশেষ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। সমীক্ষায় দেখা গেছে, এই শতাব্দীতে সমুদ্রপৃষ্ঠের উত্থান থেকে অনেক বেশি অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা আরও বাড়তে পারে। শক্তিশালী উপকূলীয় ঝড় আঘাত করতে পারে। ঢেউয়ের শক্তি বাড়তে পারে। উচ্চ জোয়ার হতে পারে। পর্যায়ক্রমে বন্যার ঝুঁকিতে বিশ্বব্যাপী কয়েক মিলিয়ন মিলিয়ন লোক এবং ট্রিলিয়ন ডলার সম্পদের ক্ষতি হতে পারে।

বাংলাদেশ দুর্যোগে ফোরামের আহবায়ক, দুর্যোগে বিশেষজ্ঞ গওহার নঈম ওয়ারা বলেন, পরিবর্তনগুলো আমরা দেখতে পাচ্ছি। গত কয়েক বছরে বাংলাদেশের উপকূলে সাইক্লোনের সংখ্যা অনেক বেড়েছে। সাইক্লোনের শক্তিও বেড়েছে। নদীর ভাঙন এবং জলোচ্ছ্বাসও বেড়েছে। এইসব দুর্যোগে বাংলাদেশের উপকূল অঞ্চলের বহু মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তারা বাড়িঘর হারায়। কিন্তু এদের জন্য যথাযথ ব্যবস্থা আমরা গ্রহণ করতে পারিনি। জলবায়ু ভিকটিম এই মানুষদের যথাযথ পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। 

ঢাকা/তারা

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়